খিলখিল করে এবারে সমস্ত কষ্টকল্পিত গাম্ভীর্য ও বিরাগের মুখোশটা খুলে ফেলে দিয়ে অভিমানের গুমোটটা কেটে যায়।
সুজাতার সঙ্গে হাসিতে যোগ দেয় বিনয়ও। বিনয় জানত, বাইবেলের ঐ ধরনের অদ্ভুত বঙ্গানুবাদ সুজাতাকে কি ভাবে হাসায় —তাই বরাবরই কপট মান-অভিমানের কলহের শেষে ঐ ব্ৰহ্মাস্ত্র প্রয়োগেই সুজাতার সঙ্গে সন্ধি করত। আজও শেষ পর্যন্ত তাকে সেই আশ্রয়ই গ্রহণ করতে হল।
হসির মধ্যে দিয়েই ভাব হয়ে গেল।
সুজাতা অতঃপর প্রশ্ন করে, বাবার সঙ্গে কি আলোচনা হচ্ছিল?
সেই চিরাচরিত সহজাত নারীমনের কৌতূহল। বিনয় হাসতে থাকে।
না না, নাকু সত্যি বল না, কিসের চিঠি তোমাকে পড়তে বাবা দিয়েছিলেন?
জনৈক শুভাকাঙ্ক্ষী ব্যক্তির—
তার মানে?
সত্যিই তাই। জনৈক শুভাকাঙ্ক্ষী ব্যক্তি মেসোমশাইকে সাবধান করে দিয়েছেন, রত্নমঞ্জিল যেন বিক্রি করা না হয়। অন্যথায় তাঁকে নাকি সমূহ ক্ষতিগ্রস্ত হতে হবে।
না, না–be serious!
এমন সময় সিঁড়িতে বামদেবের জুতোর শব্দ পাওয়া গেল।
বামদেব আসছেন।
দুজনেই ঠিক হয়ে গুছিয়ে সরে বসে। বামদেব ঘরে এসে ঢুকলেন। মুখে তাঁর চিন্তার রেখা সুস্পষ্ট।
সোফার উপরে বসতে বসতে বামদেব বললেন, বোধ হয় তোমার কথাই ঠিক, বিনয়। পিয়ারীলাল কেন এসেছিল জান!
কেন?
পঞ্চান্ন হাজারের উপরে রাণা আরো কিছু বেশী দিতে প্রস্তুত এবং আরো দশহাজার অগ্রিম দিতে চায়। এবং বললে, সামনের মাসের পনের তারিখের আগে বিক্রয়-কোবলাটা রেজোষ্ট্ৰী হয় তাদের ইচ্ছা–
আপিন কি বললেন?—
আমার হাতে অনেক কাজ বর্তমানে—সেটা সম্ভব নয়। তাই বলে দিলাম। কাল-পরশুর। মধ্যে একবার রাণার অফিসে যেতে বলে গেল।
কি বললেন। আপনি? যাবেন নাকি?
তাই ভাবছি।
কিন্তু আমার মনে হয় না যাওয়াই আপনার ভাল। সত্যি আমি যেন ব্যাপারটার মাথামুণ্ড কিছুই বুঝতে পারছি না!
এদিকে আবার কি হয়েছে জান?
কি?
রাঘব সাহা যে আবার এইমাত্র ফোন করেছিল!
রাঘব সাহা-মানে ঐ অ্যাটর্নি?
হ্যাঁ।
সে আবার ফোন করেছিল কেন?
A new offer–
হ্যাঁ, কে এক নাকি আবার নতুন খরিদ্দার জুটেছে বাড়িটার–সে নাকি আরও কুড়ি হাজার বেশী দাম দিতে চায়।
বলেন কি!
তাই তো বললে সাহা।
হুঁ, আমার এখন কি মনে হচ্ছে জানেন মেসোমশাই!
কি?
এই রত্নমঞ্জিলের মধ্যেই কোন একটা রহস্য আছে–
তাই তোমার মনে হচ্ছে?
হ্যাঁ, নচেৎ একটা ভাঙা বাড়ি নিয়ে এমন টানা-হ্যাচড়া শুরু হত না। তা নতুন খরিদ্দারটি আবার কে এলেন, শুনলেন কিছু?
তার নামধাম তো কিছু বলল না, কেবল বললে টাকার কথা—
বলছিলাম কি, একবার চলুন না। আপনার বন্ধু কিরীটী রায়ের ওখান থেকে ঘুরে আসা যাক এখুনি!
আগে একবার ফোন করে দেখ। তাহলে উনি আছেন কিনা?
বামদেবের নির্দেশে বিনয় ফোন করবার জন্য ফোনের কাছে গিয়ে মাউথপিসটা তুলে নিল।
প্রায় মিনিট দশেক চেষ্টার পর কানেকশন পাওয়া গেল।
মিঃ রায় আছেন?
কথা বলছি, বলুন!
ধরুন, মিঃ অধিকারী আপনার সঙ্গে কথা বলবেন।
বামদেব এসে ফোনটা ধরলেন, কে কিরীটী নাকি?
হ্যাঁ, বল।
আমি বামদেব কথা বলছি–
ওপাশ হতে মৃদু হাস্যধ্বনির সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন এলো, কি ব্যাপার রত্নমঞ্জিলের আবার কোন নতুন offer এসেছে বুঝি অন্য কারো কাছ থেকে?
আশ্চর্য! ঠিক তাই, কিন্তু তুমি জানলে কি করে?
অনুমান! কিন্তু তোমার কাছে রাণার লোক যায়নি?
আশ্চর্য, তাও তো এসেছিল! তার চাইতেও একটা আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে গতকাল একটা চিঠি পেয়েছি—
চিঠি! কার?
কোন নাম-স্বাক্ষর নেই, লেখা আছে জনৈক শুভাকাঙ্ক্ষী ব্যক্তি–
চিঠিতে কি লেখা আছে?
বাড়ি বিক্রি করতে নিষেধ করেছে। বিক্রি করলে নাকি ক্ষতিগ্রস্ত হব!
আমি জানতাম, জানতাম-I smelt it—অস্পষ্ট আত্মগতভাবেই যেন শেষের কথাগুলো উচ্চারণ করে কিরীটী।
অ্যাঁ, কি বললে!
দেখ, আমাদের একবার বহরমপুরে অবিলম্বে যাওয়া প্রয়োজন—
বহরমপুর?
হ্যাঁ। কালই চল, রওনা হওয়া যাক।
কিন্তু—
না, এর মধ্যে আর কোন কিন্তু নেই। প্রস্তুত থেকে-কালই।
বেশ।
তাহলে স্টেশনেই আমাদের দেখা হবে।
***
কালই বহরমপুর যাচ্ছি বিনয়—
আমিও আপনাদের সঙ্গে যাব মেসোমশাই।
তুমি! কিন্তু। তোমার অফিস?
ছুটি পাওনা আছে, ছুটি নিয়ে নেব।
সুজাতা বলে, তাহলে আমিও কিন্তু যাব বাবা তোমাদের সঙ্গে—
তুই! তুই কোথায় যাবি?
ঐ তো বললাম, বহরমপুর তোমাদের সঙ্গে—
দেখি তোর মাকে তাহলে গিয়ে বলি। বামদেব ভিতরে চলে গেলেন।
উঁহু, পথে নারী বিবর্জিত–বিনয় বলে।
মুখ ভেংচে প্রত্যুত্তর দেয়। সুজাতা, কি আমার নির রে! নাকেশ্বর, নাকানন্দ, নাকসর্বস্ব!
তবু কালোজিরে যাচ্ছেন না—
যাচ্ছি—যাব!
উঁহু।
যাবই।
নৈব নৈব চ।
হুঁ, if নাকু goes–I go!
তবে বল বিয়ে করবে আমায়?
নৈব্য নৈব চ। এ জীবনে নয়।
বহরমপুর যাওয়ার সময় সুজাতাও ওদের সঙ্গী হল।
কন্যার প্রতি দুর্বলতায় বামদেবের শেষ পর্যন্ত ইচ্ছা না থাকলেও মুখে না করতে পারলেন না। এবং যাবার সময় বিনয় মুখখানা গভীর করে থাকলেও মনে মনে খুশি হল, মেয়েটা শেষ পর্যন্ত তার জিদ বজায় রেখেছে দেখে ও মেশোমশাই বামদেবেও কন্যার প্রতি দুর্বলতার খাতিরে সুজাতাকে সঙ্গে নিলেন দেখে।
যাহোক নির্বিবাদেই সকলে বহরমপুরে এসে পৌঁছল।
সারাটা দিন সুজাতা পুরাতন রত্নমঞ্জিলের সর্বত্র হৈচৈ করেই বেড়াল।
কলকাতার বদ্ধ জীবনের পর বহরমপুরের খোলা মুক্তির মধ্যে সুজাতা যেন নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করে এবং না হোক দশ-বারো বার বামদেবকে বললে, এই বাড়ি তুমি কেন বিক্রি করবে। বাবা! এ-বাড়ি তুমি কিছুতেই বিক্রি করতে পারবে না।