না। কাল সন্ধ্যার ডাকে অফিসের ঠিকানায় এই চিঠিটা পেয়েছি মাত্র। তারপর হঠাৎ থেমে কতকটা চিন্তান্বিত ভাবেই বললেন, না সত্যিই তুমি যে আমায় ভাবিয়ে তুললে বিনয়।
দাসীর হাতে ট্রেতে করে চায়ের সরঞ্জাম নিয়ে সুজাতা ঐ সময় কক্ষমধ্যে এসে প্রবেশ করল।
সামনের ত্ৰিপয়ের ট্রে-টা নামিয়ে রেখে কাপে কাপে চা ঢালতে ঢালতে ঘাড় ফিরিয়ে বামদেবের দিকে তির্যক দৃষ্টিতে চেয়ে আব্দারের সুরে সুজাতা বলে, অফিস থেকে ফিরে এসেই কি ফুসুর-ফুসূর গুজুর-গুজুর লাগিয়েছ বাবা।
তাই তো মা, বিনয় যে আমাকে বড় চিন্তায় ফেলে দিল—
বাঁকা দৃষ্টিতে একবার বিনয়ের দিকে তাকিয়ে সুজাতা জবাব দেয়, কে কি আবোল-তাবোল বাজে বকল, তাই নিয়ে মিথ্যে কেন মাথা ঘামোচ্ছ বাবা! তার চাইতে ওপরে চল, রেডিওতে আজ খুব ভাল রবীন্দ্র-সঙ্গীত আছে!
এমন সময় ভৃত্য এসে সংবাদ দিল বাইরে একজন বাবু এসেছেন দেখা করতে।
এ সময় আবার কে এল!
ভৃত্য বললে, নাম বললে পিয়ারীলাল—
রাণার দূত! বিনয়, আমার মনে হচ্ছে লোকটা—
আপনি যান নীচে। দেখুন। আবার কি সে বলে। কিন্তু কোন কথা দেবেন না। তারপর চলুন, আজই একবার কিরীটীবাবুর সঙ্গে গিয়ে দেখা করি।
কোনমতে গরম গরম চা-টা গলাধঃকরণ করেই উঠে পড়লেন বামদেব। গায়ের ওপরে শালটা চাপিয়ে বললেন, তাহলে তুমি একটু অপেক্ষা কর। দেখি আমি হঠাৎ এ অসময়ে আবার রাণার দূত কেন! তারপর একসঙ্গেই না হয় বের হওয়া যাবে!
০৭. বামদেব ঘর হতে বের হয়ে গেলেন
একটু যেন চঞ্চল পদেই বামদেব ঘর হতে বের হয়ে গেলেন।
সুজাতা বিনয়ের ব্যবহারে একটু যেন বিস্মিতই হয়েছিল। ক্ষণপূর্বে ও বিনয়কে খোঁচা দিয়েই কথা বলেছে এবং ইতিপূর্বে কোনদিনই বিনয় খোঁচা খেয়ে খোঁচা নির্বিবাদে হজম করেনি, বিশেষ করে সুজাতার কাছ থেকে খোঁচা খেলে বরং দ্বিগুণ উৎসাহে দ্বিগুণ চোখা বক্রোক্তিই সে ফিরিয়ে দিয়েছে।
বিনয় বুঝতে পারে কৌতূহলে সুজাতা ফেটে পড়বার উপক্রম, তথাপি সে নির্বিকারভাবে শিস দিয়ে যায়। বেশীক্ষণ কিন্তু বিনয় নির্বিকার থাকতে পারে না। সামনে উপবিষ্ট মেয়েটিকে এবারে শান্ত করা দরকার!
ইঃ মেয়ের মুখখানা দেখ না।–বেজায় চটেছে।
হঠাৎ এমন সময় অন্যমনস্কভাবে পকেটে হাত যেতেই বিনয়ের একটা কথা মনে পড়ে যায় এবং সঙ্গে সঙ্গে ওষ্ঠ্যপ্রান্তে বিচিত্ৰ হাসি দেখা যায়। .
বিনয়-সুজাতার মধ্যে লৌকিক চক্ষে যত গরমিলাই থাক, পরস্পরের মধ্যে যে পরস্পরের একটা সত্যিকারের গাঢ় প্রীতির সম্পর্ক আছে। অন্য কেউ না জানলেও পরস্পরের নিকট সেটা অবিদিত নেই।
তৃতীয় কেউ না জানলেও পরস্পর পরস্পরকে মধ্যে মধ্যে দু-চার ছত্রের এক-আধখানা দেয়। অবশ্য সে চিঠিতে কোন সম্বোধন বা চিঠির নীচে ইতির শেষে কোন নাম বা পরিচয়সংজ্ঞা না থাকলেও, চিঠি যে যখন পায় এবং যে যখন চিঠি লেখে তারা উভয়েই বুঝতে পারে এবং জানেও কার চিঠি এবং কে কাকে লিখেছে। এবং ঐ ভাবে গোপনে চিঠি লেখালেখির ব্যাপারটা দুজনের মধ্যে একটা বিচিত্র আকর্ষণের সূত্র হয়ে দাঁডিয়েছিল এবং অমনি একখানা চিঠি মাত্র দিন দুই আগে বিনয় পেয়েছে এবং পকেটে হাত যেতে সেই চিঠিটাই হাতে ঠেকতে ওর ওষ্ঠ্যপ্রান্তে বিচিত্ৰ হাসি দেখা দিয়েছিল।
উৎসাহে এতক্ষণে বিনয় সোজা হয়ে উঠে বসে। এবং নিজের সঙ্গেই যেন নিজে কথা বলছে এইভাবে বলে ওঠে, তাই তো, সেই মেয়েটির একখানা চিঠি তো পরশু পেয়েছি! জবাব দেওয়া তো এখনো হয়নি। নাঃ, কি ছাই যে ভোলা মন হয়েছে আমার! মেয়েটি এত করে চিঠি লিখলে, অথচ একটা উত্তরও দেওয়া হল না!
কথা বলতে বলতে চিঠিখানা বের করে বেশ একটু উচ্চকণ্ঠেই এবারে বিনয় পড়তে শুরু করে।
সবুজ রংয়ের একটা চিঠির কাগজ। চিঠিটা পকেট থেকে বের করতেই মৃদু মিষ্টি একটা বিলাতী ল্যাভেণ্ডারের গন্ধ পাওয়া যায়। পড়তে গিয়ে কিন্তু বিনয়ের মাথার মধ্যে একটা দুষ্টুমি চাড়া দিয়ে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে নিজের মন থেকে কল্পনায় বানিয়ে বানিয়ে ঈষৎ উচ্চকণ্ঠে পড়তে শুরু করে :
ওগো, তোমার নীরবতা যে আর আমি সহ্য করতে পারছি না! তুমি কি নিষ্ঠুর-হৃদয় বলে কি তোমার কোন পদার্থই নেই! আমার এ রক্তাক্ত হৃদয় তোমার পদতলে লুণ্ঠিত করে–
এই পর্যন্ত বিনয় বলেছে, হঠাৎ মুখ ভেংচে সুজাতা বলে ওঠে বিকৃত কণ্ঠে, এঃ, রক্তাক্ত হৃদয় তোমার পদতলে-মিথ্যুক কোথাকার! বয়ে গিয়েছে লুষ্ঠিত হতে কারো হাতীর মতো গোদা পায়ে!
হো হো করে বিনয় গলা ছেড়ে এবার হেসে ওঠে।
আরো রেগে যায়। সুজাতা বিনয়ের হাসিতে, কোন মেয়ের তো খেয়েদেয় কাজ নেই, ঐ হোঁৎকা নাকেশ্বরের গোদা পায়ে লুষ্ঠিত হতে যাবে!
কিন্তু যদি এমন কোন মেয়ে থাকে–
ককখনো না। থাকতেই পারে না।
কিন্তু শ্ৰীমতী কালোজিরে বোধ হয় সম্যক জ্ঞাত নন যে, বিগত যুগে মুনিঋষিরাও বলে গিয়েছেন যে নারী-মন বিচিত্র! নচেৎ যে মেয়েটি আমার প্রেমে গদগদ হয়ে এই পত্ৰবাণ নিক্ষেপ করেছেন–
বয়ে গিয়েছে নাকানন্দ নাকেশ্বরের প্রেমে গদগদ হতে!
আহা রে! সত্যি বলছি কালিন্দী, ক্যামেরটা এসময় সঙ্গে নেই, নচেৎ ঐ মুখ-চন্দ্ৰিমার এই অবিস্মরণীয় মুহুর্তের একখানি ছবি তুলে নিতে পারলে-হায় হায়, কি ভয়ঙ্কর অপূরণীয় ক্ষতি! হায় পৃথিবীর মনুষ্যগণ, তোমরা কি হারাইলে তোমরা জান না! বাইবেলের ভাষার বঙ্গানুবাদে বলতে ইচ্ছা করছে, ঈশ্বর তোমাদের প্রেম দিতে চাহিয়াছিলেন–