চা না হয় এক কাপ কোকো কিংবা এক কাপ কফি।
এক গ্লাস এঁদো পুকুরের পচা জলও নয়। কি আমার গুরুঠাকুর এলেন রে!
বোঝা যাবে দাও কি না। একবার সাতপাক ঘোরাই—
আমিও চোদ্দাপাক ঘুরিয়ে নাকচ করে না দিই তো আমার নাম সুজাতা নয়।
তাতে করে আরো শক্ত হবে বাঁধান। হা-হা করে হেসে ওঠে বিনয়।
ঘরে এসে প্রবেশ করলেন বামদেব ঐ সময়, এই যে বিনয়; কখন এলে?
এই কিছুক্ষণ।
সুজাতা দ্রুতপদে ঘর ছেড়ে চলে যায়।
বস, আমি জামাটা ছেড়ে চলে আসি।
বিনয় সোফার ওপর একা একা বসে সুজাতার বইয়ের পাতা ওন্টাতে থাকে।
একটু পরে বামদেব ফিরে এলেন, তোমাকে আমি ডেকে পাঠিয়েছি। একটা পরামর্শের জন্য বিনয়।
পরামর্শ!
হ্যাঁ!
কিসের পরামর্শ মেসোমশাই?
তুমি জান বহরমপুরে রত্নমঞ্জিলটা এক গুজরাটি ভদ্রলোককে বিক্ৰী করব বলে বায়না নিয়েছিলাম, আশাতীত মূল্য আবার পাওয়া যাচ্ছিলও—
হ্যাঁ, মনে আছে।
গতকাল ডাকে একটা অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির চিঠি পেয়েছি! চিঠিটা অদ্ভুত। চিঠির নীচে কারো নাম সই নেই, কেবল লেখা আছে জনৈক ব্যক্তি। এই সেই চিঠি, পড়ে দেখ।
এগিয়ে দিলেন বামদেব চিঠিটা বিনয়ের দিকে। সংক্ষিপ্ত চিঠি।
শ্রীযুক্ত বামদেব অধিকারী সমীপেষু,
জানিলাম আপনি রত্নমঞ্জিল বিক্রয় করিতেছেন। পূর্বপুরুষের ভিটা এভাবে টাকার জন্য হস্তান্তর করিবেন না। করিলে সমূহ ক্ষতিগ্রস্ত হইবেন। মঙ্গল চান তো বায়না ফেরত নিন।
-ইতি
শুভাকাঙ্ক্ষী জনৈক ব্যক্তি
ব্যাবসাক্ষেত্রে ঐ শেঠ জাতটার একাধিপত্য থাকলেও এবং লোকগুলো প্রচণ্ড ধনী হলেও চিরদিন বিনয়ের ওদের প্রতি কেমন যেন একটা বিদ্বেষই ছিল। তাছাড়া অর্থই যে সর্বতোভাবে জীবনের একমাত্র মানদণ্ড নয়, স্বপ্নবিলাসী বিনয় সেটা বিশ্বাস করতো।
বিক্রয়ের ব্যাপারে যখন রতনলালের সঙ্গে বামদেবের দরকষাকষি চলছিল তখনই সে বলেছিল, কিছু ভাববেন না মেসোমশাই ও বোকা শেঠের যখন একবার মাথায় রত্নমঞ্জিল প্রবেশ করেছে, শেষ পর্যন্ত দেখবেন ঐ পঞ্চান্ন হাজারেই বেট টোপ গিলবে। স্রেফ চুপ করে থাকুন না এবং কার্যক্ষেত্রে হলও তাই।
কিন্তু আজ বামদেব-প্রদত্ত চিঠিটা পড়ে ওর পূর্বের সমস্ত চিন্তাধারা যেন ওলট-পালট হয়ে গেল। রত্নমঞ্জিল ক্ৰয়ের ব্যাপারে রাণার জিদ ও শেষ পর্যন্ত পঞ্চান্ন হাজার স্বীকৃতি সব কিছুর মূলে যেন এখন ওর মনে হচ্ছে কোথায় একটা রহস্য লুকিয়ে আছে।
বিনয়কে নিঃশব্দে চুপ করে বসে থাকতে দেখে বামদেব প্রশ্ন করেন, কি মনে হচ্ছে এখন বিনয়? চিঠিটার মানে কিছু বুঝতে পারলে?
না। তবে চিঠির মানে যাই হোক না কেন, আপাতত সামনের মাসের পনের তারিখে বাড়ি রেজিস্ট্রি করা হবে না এটা ঠিক।
কিন্তু জানি তো বায়না নেওয়া হয়ে গিয়েছে।
তা হোক, তবু যে ভাবেই হোক আমাদের কিছুদিন সময় নিতেই হবে, যদি একান্তই বায়নার টাকা ফেরত না দেওয়া যায়—
কি তুমি বলতে চাও বিনয় খুলে বল!
এই চিঠির নিশ্চয়ই কোন অর্থ আছে—
অর্থ! বিস্মিত বামদেব বিনয়ের মুখের দিকে তাকালেন।
হ্যাঁ। অবশ্য এখুনি চট্ করে আপনাকে সঠিক কিছু আমি বলতে পারছি না, দুটো দিন ভাবতে দিন।
আচ্ছা একটা কাজ করলে কেমন হয়?
বলুন!
তুমি হয়ত জান না, এ বাড়িতে গত দু-মাস ধরে চোরের উপদ্রবের ব্যাপারে আমার বন্ধু কিরীটী রায়কে পরশু রাত্রে আমি ডেকে এনেছিলাম—
সত্যি!
হ্যাঁ।
তিনি কি বললেন? ব্যগ্র কৌতূহল উৎকণ্ঠা বিনয়ের চোখেমুখে।
সঠিক কিছুই বলেনি, তবে যা বললে-তার ধারণা হচ্ছে হীরকখচিত সোনার আমাদের পূর্বপুরুষের সেই কঙ্কন, রত্নমঞ্জিল ও এখানে চোরের উপদ্রব গত কিছুদিন ধরে—সব কিছুর মধ্যে কোথায় যেন একটা যোগাযোগ আছে।
বিনয় এবার বলে, মেসোমশাই, আপনার কথা শুনে আমারও কেমন যেন মনে হচ্ছে, আপনার বাড়িতে কিছুদিন ধরে যে চোরের উপদ্রব হচ্ছে সেটা সামান্য তুচ্ছ একটা ব্যাপার নয়। এর পিছনে কোন একটা গভীর উদ্দেশ্য আছে। আমারও মনে হচ্ছে কিরীটীবাবুর ধারণা হয়ত মিথ্যে নয়।
বামদেব বিনয়ের কথাগুলো শুনে এবাবে যেন সত্যিই একটু চিন্তিত হয়।
বিনয় আবার বলে এবং মনে হচ্ছে সব কিছুর মূলে সত্যিই ঐ রত্নমঞ্জিলই আর তাই ঐ শেঠজীর ঐ ভাঙা রত্নমঞ্জিলের ব্যাপারে এত আগ্রহ-এত উৎসাহ!
তোমার কথা কিছুই আমি বুঝতে পারছি না। যদিও কষ্টকল্প তা হলেও চোরের উপদ্ৰব ও কঙ্কনের সঙ্গে একটা যোগাযোগ থাকলেও থাকতে পারে, কিন্তু তার সঙ্গে রত্নমঞ্জিলের যে কি সম্পর্ক থাকতে পারে সেটাই বুঝতে পারছি না!
ঠিক যে কি সম্পর্ক তা হয়ত এখনো বোঝা যাচ্ছে না বটে, কিন্তু এটা কি একবারও ভেবে দেখেছেন, কেনই বা শেঠজীর বহরমপুরের ঐ পুরাতন বাড়িটা সম্পর্কে এত আগ্রহ? খাগড়ার বাসনের ফ্যাক্টরী করবে। একটু অস্বাভাবিক নয় কি? তাছাড়া শেঠজী ঐ বাড়িটার খোঁজ পেলেই বা কি করে? এবং, ফ্যাক্টরীই যদি করবার ইচ্ছা ওর বহরমপুরে, একমাত্র ঐ রত্নমঞ্জিল ছাড়া কি আর কোন বাড়ি বা জায়গা নেই ঐ তল্লাটো? সবচাইতে বড় কথা, কেউ আত টাকা ঢালে ঐ পুরাতন একটা বাড়ির জন্য? শেষ পর্যন্ত আর একটা ব্যাপার ঐ সঙ্গে ভেবে দেখুন, বায়না নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এ বাড়িতে চোরের উপদ্রব শুরু হয়েছে–
এমনও তো হতে পারে, সব কিছুই একটা যোগসূত্রহীন আকস্মিক ব্যাপার!
হতে যে পারে না তা বলছি না মেসোমশাই, তবে ঐ সঙ্গে এও তো ভাবা উচিত, নাও হতে পারে। ব্যাপারগুলো যা পর পর ঘটেছে, কোনটাই তার আকস্মিক বা উদ্দেশ্যহীন নয়। না মেশোমশাই, কিরীটী রায়ের সঙ্গে পরামর্শ করে ঠিকই করছেন। ভাল কথা, এ চিঠির কথা তাঁকে জানিয়েছেন?