- বইয়ের নামঃ রত্নমঞ্জিল
- লেখকের নামঃ নীহাররঞ্জন গুপ্ত
- বিভাগসমূহঃ গোয়েন্দা কাহিনী
০১. দুই বন্ধু
আহারাদির পর দুই বন্ধু এসে বসবার ঘরে বসে।
শীতের রাত। শীতটাও কয়েকদিন ধরা যেন জাঁকিয়ে বসেছে। ঘরের কোণে ইলেকট্রিক হিটার জ্বলছিল, তারই উত্তাপে ঘকটা বেশ আরামপ্রদ হয়ে উঠেছিল। দুজনে দুটো সিগারেট ধরিয়ে টানছে —বামাদেব অধিকারী আর কিরীটী রায়। বামাদেব অধিকারীর পূর্বপুরুষষেরা এককালে বহরমপুরের নামকরা জমিদার ছিলেন। এখনো জমিজমা কিছু আছে বটে কিন্তু তার প্রাচুর্যের আসল উৎসটা ব্যবসা-কঁচা মালের আমদানি রপ্তানির ব্যবসা দেশ-বিদশে। এবং বিরাট ফলোয়া ব্যবসা।
আর কিরীটী রায় তখনো হ্যারিসন রোডের মেস বাণীভবনে থাকে। একদা বামদেবের কলেজ-জীবনের সহধ্যায়ী বন্ধু।
কিরীটী হাতের সিগারেটটায় দীর্ঘ এক টান দিয়ে বললে, তারপর বল কিসের পরামর্শ করার জন্য আমায় ডেকেছিস? কোনরকম ভণিতা না করেই কিরীটী শুরু করল বলতে।
ব্যাপারটা হচ্ছে একটা সুবৰ্ণ হীরাখচিত কঙ্কন—বামদেব বললে।
কি রকম? কিরীটী কৌতূহলী হয়ে বলল।
আগে কঙ্কনটা দেখ, তারপর বলছি। সব কথা। বামদেব বললে।
উঠে গিয়ে আয়রণ সেফ থেকে পাশের ঘরের একটি সাবেককেলে লেদারের চৌকো। বাক্স নিয়ে এল বামদেব! বাক্সের ডালা খুলতেই দেখা গেল একখানি কঙ্কন—হীরকখচিত সুবৰ্ণ কঙ্কন। সত্যিই অপূর্ব কারুকার্যমণ্ডিত কঙ্কনটি-চোখ যেন ফেরানো যায় না। মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে কঙ্কনের দিকে কিরীটী।
আরো আধঘণ্টা পরে।
কিরীটী ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে টেবিলের ওপরে রক্ষিত ডোমে-ঢাকা বৈদ্যুতিক টেবিল ল্যাম্পের আলোয় মুগ্ধ বিস্ময়ে হস্তধৃত হীরকখচিত সুবৰ্ণ কঙ্কনখানি দেখছিল। ওজনে তিন ভরি তো হবেই—সেকেলে জড়োয়া গহনা যাকে বলে, একেবারে খাঁটি পাকা সোনার তৈরী। ভিতরটা গালা ভরা নয়, একেবারে নিরেট।
হীরকখচিত কঙ্কন। দু’পাশে হতে দুটো হাঙ্গরের হিংস্র মুখ যেন পরস্পরের সঙ্গে এসে ঠেকেছে। আজকালকার হালফ্যাসানের যুগে এ ধরনের ভারী অথচ সুক্ষ্ম কাজ বড় একটা চোখেই পড়ে না। ছোট ছোট হীরা কঙ্কনটির সারা গায়ে বসানো, ল্যাম্পের আলোয় সব ঝলমল করছে। অনেকক্ষণ ধরে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে সম্মুখে চেয়ারের ওপরে উপবিষ্ট বামদেব অধিকারীর হাতে সেটা এগিয়ে দিল কিরীটী এবং প্রশ্ন করল, কিন্তু একটি কঙ্কন কোন-আর একটি কোথায়?
বামদেব মৃদু কণ্ঠে বলল, জানি না।
জানিস না মানে?
সত্যিই জানি না। এর অন্য কঙ্কনটি কোথায়, কিরীটী!
ঠিক বুঝলাম না।
সেই কথা বলবার জন্যই এবং কি ভাবে অন্য কঙ্কনটি উদ্ধার করা যেতে পারে সেই পরামর্শ নেবার জন্যই তোকে ডেকে এনেছি–
সব কথা আমায় খুলে বল বাম। অন্য কঙ্কনটির কথা কিছুই তুই জানিস না—কিছুই জানিস না?
শুনেছি হারিয়ে গিয়েছে–
হারিয়ে গিয়েছে!
হ্যাঁ। সেই রকমই আমার পিসেমশাইয়ের মুখে শুনেছি। কঙ্কন জোড়া আমার পূর্বপুরুষের সম্পত্তি। আমার প্রপিতামহী বিন্ধ্যবাসিনী দেবী তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর একমাত্র পুত্রবধু শরৎশশী দেবী আমার পিতামহীর হাতে আসে ঐ কঙ্কন জোড়া। আমার ঠাকুর্দার এক ছেলে ও এক মেয়ে। মেয়ে আমার পিসিমা মৃন্ময়ী দেবী ছিলেন আমার বাবার চাইতে বয়সে প্রায় চোদ্দ বছরের বড়।
বামদেব বলে চলে, দীর্ঘদিন পর্যন্ত আমার ঠাকুর্দার কোন পুত্রসন্তান না হওয়ায় মাত্র এগার বৎসর বয়সে কন্যা মৃন্ময়ীর বিবাহ দিয়ে পিসেমশাইকে ঘরজামাই করে রাখলেন— পুত্রের মতই! তের বৎসর বয়সে অর্থাৎ বিবাহের পরবৎসরই পিসিমার একটি পুত্র জন্মাল— আমার পিসতুত ভাই অনিলন্দা এবং অনিলন্দার জন্মের দেড় বৎসর পরে জন্মাল বাবা–
তাহলে তোর বাবা তোর পিসতুত ভাই অনিলদার থেকে বয়সে ছোট?
হ্যাঁ প্রায় দেড় বৎসরের ছোট।
তারপর?
বামাদেব অধিকারী পুনরায় শুরু করে তার কাহিনী, আমার পিসেমশাই শ্যামসুন্দর চক্রবর্তীর সংসারের প্রতি কোনদিনই তেমন আকর্ষণ ছিল না। দিবারাত্ৰ জপতপ নিয়েই থাকতেন—শোনা যায় তিনি নাকি একজন রীতিমত সাধক ছিলেন।
তাই বুঝি?
হ্যাঁ, দিবারাত্রি বেশীর ভাগ সময়েই জপ-তপ পূজাআর্চা নিয়েই থাকতেন। প্রথম যৌবনে শুনেছি আগুনের মত প্রখর রূপ ছিল আমার পিসেমশাইয়ের। বাবরী চুল, কটা চোখ, বিরাট দশাসই চেহারার পুরুষ আমার পিসেমশাইকে একবার দেখলে তাঁর দিক থেকে নাকি চোখ ফেরানো যেত না। প্রথম যৌবনে নাকি তিনি নিয়মিত কুস্তি ও ডনবৈঠক করায় দেহেও ছিল তাঁর অসুরের মতই বল। গরীব যজমোন পুরোহিতের একমাত্র সন্তান ছিলেন পিসেমশাই। সেই জন্যই এবং তাঁর রূপে মুগ্ধ হয়ে ঠাকুর্দা তাঁর একমাত্র মেয়ের সঙ্গে তাঁর বিবাহ দিয়ে ঘরজামাই করে এনেছিলেন। কিন্তু পিসেমশাই সরল সাধক এবং সংসারের প্রতি ও সেই সঙ্গে স্ত্রীর প্রতি বিশেষ কোন আকর্ষণ না থাকায় বোধহয় বিবাহটা শেষ পর্যন্ত সুখের হলো না।
কেন? শুধু কি ঐ কারণেই বিবাহটা সুখের হয়নি?
না, আমার মনে হয় আরো কারণ ছিল। ধনশালী জমিদারের একমাত্র দুহিতা আমার পিসিমা ছিলেন যেমন গর্বিতা তেমনি অত্যন্ত নিষ্ঠুর প্রকৃতির স্ত্রীলোক, আর আমার পিসেমশাই ছিলেন ঠিক ভিন্ন প্রকৃতির—শান্ত সহিষ্ণু ও সদাহাস্যময় পুরুষ। তা সত্ত্বেও শুনেছি পিসেমশাই যথাসাধ্য মানিয়ে চলবোরই চেষ্টা করেছেন দীর্ঘদিন ধরে, কিন্তু পিসিমার দিক থেকে বোধ করি কোন কমপ্রোমাইজের ইচ্ছা ছিল না—তাই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে প্রতি মুহুর্তে বিবাদ-বিসম্বাদ লেগেই ছিল। এবং সেই বিসম্বাদ চরমে উঠল অনিলদার জন্মের পর হতেই এবং যার ফল হল অতিবড় সহিষ্ণু ও শান্তপ্রকৃতির লোক পিসেমশাইকেও বাধ্য হয়ে একমাত্র স্বামী-স্ত্রীর লৌকিক সম্পর্কটা ছাড়া অন্য সমস্ত সম্পর্কই তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে ছিন্ন করে জমিদারবাড়ির বাইরের মহলে নিজেকে একেবারে নির্বাসিত করতে হল। ঐ ঘটনার কিছুদিন পরেই আমার বাবার জন্ম। বাবার জন্মের কিছুদিন পর হতেই কিন্তু পিসিমা যেন সম্পূর্ণ ভিন্নরূপ নিলেন—চেষ্টা করতে লাগলেন পিসেমশাইয়ের সঙ্গে আবার নতুন করে সৌহার্দ স্থাপনের জন্য। কতদূর তাঁর প্রচেষ্টা সফল হয়েছিল জানি না, তবে পিসেমশাই কিন্তু অন্দরে আর ফিরে এল না। নিরুদ্দিষ্ট হওয়ার আগে পর্যন্ত বাইরের মহলেই রাত কাটাতে লাগলেন ও দিনের বেলাটা নির্জন একটা অন্ধকার ঘরে পূজাআচর্গ নিয়েই কাটাতে লাগলেন। যখন আমার বাবার বছর দেড়েক বয়স সেই সময় একদিন মা ও মেয়ে অর্থাৎ পিসিমা ও আমার পিতামহীর সঙ্গে প্রচণ্ড একটা বিবাদ হয়ে গেল।