স্ত্রীলোকের কণ্ঠস্বর মনে আছে আমার।
স্ত্রীলোকের কণ্ঠস্বর?
হ্যাঁ।
এ বাড়ির সঙ্গে কি আপনার কোন পূর্ব-পরিচয় ছিল ডাক্তারবাবু? কিরীটী প্রশ্ন করে।
জবাব দিলেন থানা-অফিসার শিবেন সোম, হ্যাঁ, ডাঃ ঘোষ তো এ বাড়ির ফ্যামিলি-ফিজিসিয়ান। মিস চৌধুরীর মুখে ওঁর নাম শুনে তাই তো ওঁকেই আমি ফোন করেছিলাম–
আপনি এ বাড়ির ফ্যামিলি-ফিজিসিয়ান তাহলে ডাঃ ঘোষ?
হ্যাঁ।
কতদিন এঁদের সঙ্গে আপনার পরিচয়?
তা বছর বারো-তেরো তো হবেই—এ পাড়ায় আমি আসা অবধি ওঁরা আমার পেসেন্ট।
তাহলে তো খুব ভালই হল, অধ্যাপকের স্বাস্থ্য সম্পর্কে আপনি ডিটেলস্ খবর দিতে পারবেন! কিরীটী বলে।
তা পারব বৈকি। কিন্তু তার আগে একবার বিমলবাবুকে—
হ্যাঁ দেখবেন বৈকি, চলুন—সোম বললেন।
অতঃপর সকলে আমরা সিঁড়ি দিয়ে দোতলার দিকে অগ্রসর হলাম।
সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতেই কিরীটী ডাঃ ঘোষকে পুনরায় প্রশ্ন করে, ডাঃ ঘোষ, বিমলবাবু রক্তচাপে ভুগছিলেন শুনলাম–
হ্যাঁ, বেশ কিছুদিন ধরে ভুগছিলেন।
রক্তচাপ কি খুব বেশী হয়েছিল?
তা একটু বেশীই ছিল—
ওষুধ খেতেন না উনি?
মধ্যে মধ্যে খেতেন, তবে—
তবে?
রেগুলার কোন ওষুধ খেতেন না।
কেন?
কারণ প্রেসারটা ফ্লাকচুয়েট করত—
ভদ্রলোকের মেজাজ কেমন ছিল?
খুব কুল ব্রেনের লোক ছিলেন।
কিন্তু সাধারণত শুনেছি রক্তচাপাধিক্যে যাঁরা ভোগেন তারা একটু রগচটা প্রকৃতির হন। কিরীটী সহসা প্রশ্ন করে।
না, সে-রকম বড় একটা তাকে মনে হয় নি কখনন, ডাঃ ঘোষ বললেন, এবং শুধু তাই নয়, রাগারাগি চটাচটি বিশেষ তিনি পছন্দ করতেন না এমনও শুনেছি।
আচ্ছা ডাঃ ঘোষ—
বলুন?
বিমলবাবুর শেষ ব্লাডপ্রেসার কবে নিয়েছিলেন, কিছু মনে আছে?
থাকবে না কেন—মাত্র দিন চারেক আগেই তো নিয়েছি।
আপনি মধ্যে মধ্যে নিশ্চয়ই এসে বিমলবাবুর ব্লাডপ্রেসারটা পরীক্ষা করে যেতেন।
না, প্রেসার নেওয়াটা তিনি বিশেষ পছন্দ করতেন না। তবে সেদিন তিনি নিজেই আমাকে ফোন করে ডেকেছিলেন—
কেন?
কিছুদিন থেকে মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছিল তাই—
তার কোন কারণ ঘটেছিল কি?
ঠিক বলতে পারি না, অত্যন্ত চাপা প্রকৃতির লোক ছিলেন তো। তবে–
তবে?
তবে সেদিন তাঁকে দেখে মনে হয়েছিল মনের মধ্যে যেন কিছু একটা দুশ্চিন্তা চলেছে, কেমন যেন একটু বিশেষ আপসেট-বিচলিত মনে হয়েছিল তাকে।
বিচলিত হবার মত কোন কারণ–
না, আমিও জিজ্ঞাসা করি নি তিনিও বলেন নি।
.
দোতলায় যে ঘরের মধ্যে মৃতদেহ ছিল আমরা এসে সেই ঘরের দরজা ঠেলে প্রবেশ করলাম—ডাঃ ঘোষ, থানা-অফিসার শিবেন সোম, কিরীটী ও আমি।
ঘরটা বেশ বড় আকারেরই, দক্ষিণ-পূবমুখী।
সিঁড়ি দিয়ে উঠে বারান্দা দিয়ে দক্ষিণমুখী এগুলে প্রথম দরজাটা দিয়েই সেই ঘরে প্রবেশ করতে হয়। দরজাটা ভেজানো ছিল এবং দ্বারে একজন লালপাগড়ী মোতায়েন ছিল।
ভিতরে প্রবেশ করে কিরীটী দাঁড়িয়ে গেল। ঘরের পূর্ব-দক্ষিণ কোণে একটা বেতের আর্মচেয়ারে শোয়া অবস্থায় ছিল মৃতদেহ।
হঠাৎ দেখলে মনে হয় যেন ভদ্রলোক চেয়ারে শুয়ে ঘুমিয়ে আছেন। নিমীলিত চক্ষু। একটি হাত বুকের উপরে ন্যস্ত, অন্য হাতটি বামপাশে ঝুলছে অসহায় ভাবে। পরিধানে গরদের পাঞ্জাবি ও দামী শান্তিপুরী ধুতি। সামনেই এক জোড়া কটকী চটি পড়ে আছে।
সামনে ত্রিপয়ের উপর সেদিনকার সংবাদপত্র ও একটি গোল্ড ফ্লেকের সিগারেট টিন, দেশলাই ও চিনামাটির একটি অ্যাশট্রে।
ঘরের উত্তরদিকে দুটি প্রমাণ সাইজের কাঠের আলমারি। একটির পাল্লায় আয়না বসানোঅন্যটিতে বই ঠাসা, কাচের পাল্লা দেওয়া।
ঘরের মধ্যে প্রবেশের তিনটি দরজা, তার মধ্যে উত্তরদিকের ঘরের মধ্যবর্তী দরজাটি বন্ধ ছিল এবং বাথরুমে যাবার দরজাটি ও অন্য দরজাটি খোলাই ছিল।
দক্ষিণমুখী তিনটি জানালাই খোলা ছিল। জানালায় পর্দা দেওয়া।
দক্ষিণ দিক ঘেঁষে জানালা বরাবর খাটের উপরে শয্যা বিস্তৃত। তার পাশে একটি বুকসেলফ। সেলফ-ভর্তি বই।
শয়নঘরটি যে কোন অধ্যাপকের দেখলেই বোঝা যায়।
দেখলাম কিরীটী বেশ কিছুক্ষণ ঘরের চারিদিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে ধীরে ধীরে এক সময় এগিয়ে গেল মৃতদেহের দিকে।
ইতিমধ্যে ডাক্তার ঘোষের মৃতদেহ পরীক্ষা করা হয়ে গিয়েছিল।
কিরীটী মৃদুকণ্ঠে ডাক্তার ঘোষকে প্রশ্ন করে, কি মনে হয় ডাক্তার ঘোষ? ডেথ ডিউ টু থম্বসিস বলেই কি মনে হয়?
শান্ত মৃদুকণ্ঠে না শব্দটি উচ্চারণ করলেন ডাঃ ঘোষ। এবং সঙ্গে সঙ্গে শিবেন সোম ও আমি ডাক্তার ঘোষের মুখের দিকে তাকালাম।
কিরীটী কিন্তু তাকায় নি। বরং দেখলাম, প্রশ্নটা করে সে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে যেন মৃতের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।
ডাক্তার ঘোষের কথাটা তার কানে গিয়েছিল কিনা বুঝতে পারলাম না। কারণ একটু পরেই দেখি সে মৃতদেহের একেবারে সামনাসামনি এগিয়ে গিয়ে মৃতের মুখের কাছে একেবারে ঝুঁকে পড়ে কি যেন তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে লক্ষ্য করছে এবং দেখতে দেখতেই পকেট থেকে একটা লেন্স বের করে সেই লেন্সের সাহায্যে মৃতের মুখের উপরে কি যেন পরীক্ষা করতে লাগল।
তারপর একসময় লেন্সটা পকেটে রেখে সোজা হয়ে দাঁড়াল এবং এতক্ষণে কথা বলল, ইয়েস, আই এগ্রি উইথ ইউ ডাক্তার ঘোষ—আপনার সঙ্গে আমি একমত। এবং ইফ আই অ্যাম নট রং—আমার অনুমান যদি ভুল না হয়ে থাকে তো-ডাক্তার ঘোষের মুখের দিকে তাকিয়ে কিরীটী তার কথাটা শেষ করল, ওঁর মৃত্যু ঘটেছে কোন ত্বরিৎক্রিয়াশীল বিষে–