উপরে ও নিচে খান-আষ্টেক ঘর। বেশ বড় সাইজের ঘরগুলি। পশ্চিম দিক থেকে চওড়া সেকেলে বেলোয়ারী কাচের রঙিন টুকরো বসানো সিঁড়ি। সিঁড়ির শেষপ্রান্তে নীচের তলার মতই বারান্দা।
দোতলায় পিছনের দিকে প্রশস্ত একটি খোলা ছাদ। সেই ছাদেই সামিয়ানা খাটিয়ে ও চেয়ার টেবিল পেতে অতিথিদের অভ্যর্থনার আয়োজন হয়েছিল।
এবং জলখাবারের ব্যবস্থা হয়েছিল নীচের হলঘরে।
.
নীচের তলায়ই শিবেন সোমের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। প্রথমে কিরীটীর মুখে নামটা শুনে ভদ্রলোকের চেহারাটা মনে করতে পারি নি।
কিন্তু সামনাসামনি দেখা হতেই মনে পড়ে গেল, বছর চারেক পূর্বে একটা আফিম চোরাইয়ের তদন্তের ব্যাপারে কিরীটীর ওখানেই ভদ্রলোকের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল আমার। ভদ্রলোক, শিবেনবাবু আমাদের বয়সীই হবেন। তবে বয়সের অনুপাতে একটু যেন বেশী বুড়িয়ে পড়েছেন—গাল কুঁচকে গিয়েছে, কপালে ভাঁজ পড়েছে, মাথার চুল বেশীর ভাগই পেকে গিয়েছে।
এসো এসো কিরীটী, তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম, আহ্বান জানালেন শিবেন সোম।
কিছু জানতে পারলে সোম?
না, এখনো সরেজমিন তদন্তই করি নি। ডেড় বডিটা দেখেছি আর ব্যাপারটা মোটামুটি শুনেছি।
কি শুনলে?
যতটুকু শুনেছি ও দেখেশুনে যা মনে হচ্ছে—
কি?
সেরকম কিছু নয়। ন্যাচারাল ডেথ-স্বাভাবিক মৃত্যু বলেই মনে হচ্ছে। তাছাড়া শুনলামও, ভদ্রলোক কিছুদিন যাবৎ রক্ত-চাপাধিক্যে নাকি ভুগছিলেন।
কিরীটী ঐ কথার কোন উত্তর না দিয়ে সম্পূর্ণ অন্য প্রশ্ন করল, কিন্তু বাড়িটা যেন কেমন চুপচাপ মনে হচ্ছে! নিমন্ত্রিতরা সব চলে গিয়েছেন নাকি?
হ্যাঁ, বেশীর ভাগই চলে গিয়েছেন। সামান্য চার-পাঁচজন আছেন, কিন্তু এখানে যে অনেক নিমন্ত্রিত আজ উপস্থিত ছিলেন তুমি জানলে কি করে?
কথাটা বলে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে শিবেন সোম কিরীটীর মুখের দিকে তাকালেন।
ওঁর ভাইঝি—মানে অধ্যাপকের ভাইঝি যে গত সন্ধ্যায় আমার ওখানে গিয়েছিলেন, তার মুখেই শুনেছিলাম আজকের উৎসবের কথাটা।
কে, মিস্ শকুন্তলা চৌধুরী?
হ্যাঁ।
ওঃ, তা তোমার সঙ্গে মিস্ চৌধুরীর পূর্ব-পরিচয় ছিল নাকি?
না। গতকালই প্রথম তাকে দেখি ও প্রথম পরিচয়।
কি রকম?
কিরীটী সংক্ষেপে তখন গত সন্ধ্যার ব্যাপারটা খুলে বলল, কেবল ইকনমিক জুয়েলার্সে হানা দেবার কথাটা বাদ দিয়ে।
আই সী! তাহলে তুমি কি মনে কর–
কি?
ঐ দুষ্মন্তবাবুই—মানে ঐ দুষ্মন্ত রায়ই—
তিনি আসেন নি?
এসেছেন, তবে ঘটনার সময় তিনি ছিলেন না, পরে এসেছেন—
পরে? কখন?
আমি আসার মিনিট কয়েক আগে শুনলাম এসেছেন।
এখনো আছেন নিশ্চয়?
আছেন। কেউই যান নি ঐ ঘটনার পর।
আর কে কে আছেন?
বিমলবাবুর এক সতীর্থ সুধীর চক্রবর্তী, ওঁর এক ভাগ্নে রঞ্জন বোস, এই পাড়ারই এক রিটায়ার্ড জজ মহেন্দ্র সান্যাল, ইকনমিক জুয়েলার্সের মালিক রাঘব সরকার–
আর?
বিমলবাবুর ছেলেবেলার এক বন্ধু–বিনায়ক সেন।
কতক্ষণ আগে ব্যাপারটা জানা গিয়েছে?
তা ধরো ঘণ্টা দুই হবে।
হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে কিরীটী বললে, এখন সোয়া দশটা। তাহলে আটটা পঁয়তাল্লিশের মত সময়ে–
ঐ রকমই হবে—ওঁরা বলছিলেন—
কে–কে বলছিলেন?
শকুন্তলা দেবী।
তিনি কোথায়?
উপরে তার ঘরে।
মৃতদেহ কোথায় পাওয়া গিয়েছে?
তাঁর নিজের ঘরে। বিমলবাবুর বেডরুমেই।
নিজের শোবার ঘরে?
হ্যাঁ, তার শয়নঘরে আরামকেদারাটার উপরে শায়িত অবস্থায়।
মৃতদেহ নিশ্চয়ই ডিসটার্ব করা হয় নি?
না, ঠিক যেমনটি ছিল তেমনটিই আছে।
ভদ্রলোকের তাহলে স্বাভাবিক মৃত্যুই হয়েছে, তাই তোমার ধারণা সোম?
সেই রকমই তো মনে হয়। তাছাড়া তো শুনলে ভদ্রলোক কিছুদিন যাবৎ হাইপারটেনসনে ভুগছিলেন, তাতেই মনে হয় সাডেন স্ট্রোক-এ-
হতে পারে অবিশ্যি, অসম্ভব কিছু নয়। তা ডাক্তার ডাকা হয়েছিল?
আমি এসে ডাক্তারকে আসবার জন্য ফোন করেছি।
মানে এঁরা করেন নি?
না। এভরিওয়ান ওয়াজ সো ননপ্লাস!
.
০৫.
আশ্চর্য, এখনো ডাক্তারই একজন ডাকা হয় নি! কতকটা যেন আত্মগত ভাবেই কথাটা উচ্চারণ করে কিরীটী।
না, হয় নি—তাছাড়া মাত্র তো ঘণ্টাখানেক আগে ব্যাপারটা জানা গিয়েছে, সোম বললেন।
ওঁর মৃত্যুর ব্যাপারটা প্রথমে কার নজরে পড়ে সোম এ-বাড়িতে?
এ বাড়ির অনেকদিনকার পুরাতন ঝি সরমা। সে-ই সর্বপ্রথমে নাকি ব্যাপারটা জানতে পারে, সোম বললেন।
ঠিক ঐ সময় বাইরে একটা গাড়ি থামার শব্দ শোনা গেল।
বোধহয় ডাক্তারবাবু এলেন কিরীটী, সোম বললেন, তুমি একটু অপেক্ষা করো, আমি দেখে আসি।
কথাটা বলে সোম ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।
থানা অফিসার শিবেন সোমের অনুমান মিথ্যা নয়, একটু পরে এক প্রৌঢ় ডাক্তারকে সঙ্গে নিয়ে সোম এসে ঘরে ঢুকলেন।
ডাক্তার কথা বলতে বলতে এসে ঘরে ঢুকলেন, শুনে হয়ত আশ্চর্য হবেন, আমি ঘণ্টাদেড়েক আগে একবার একটা ফোনে কল পেয়েছিলাম। এই বাড়ি থেকেই কেউ ফোন করেছিল, অধ্যাপককে তাড়াতাড়ি একটিবার দেখে যাবার জন্য। কিন্তু অন্য এক জায়গায় জরুরী একটা কল পেয়ে আমি তখন বেরুচ্ছি, তাই দেরি হয়ে গেল—
সঙ্গে সঙ্গে কিরীটী যেন বাধা দিয়ে তাকে প্রশ্ন করে, কি বললেন ডাক্তার? ঘণ্টা দেড়েক আগে ফোন করেছিল, এ-বাড়ি থেকে আপনাকে কেউ?
হ্যাঁ।
কে? নাম বলে নি?
নাম! না বলে নি—আর তাড়াতাড়িতে আমিও জিজ্ঞাসা করি নি—
আপনাকে ফোন করেছিল পুরুষ না মেয়ে?