ঠিক আছে, এক কাজ করা যাক, সামনেই টিপু সুলতান রোডে অমিয় চক্রবর্তী থাকে। এককালে এম-এস-সি ক্লাসে পরিচয় হয়েছিল—চল–
কিরীটী কথাটা বলেই হঠাৎ চলার গতি যেন বাড়িয়ে দিল।
সে-রাত্রে টিপু সুলতান রোডে অমিয়র ওখানে ঘণ্টা-দুই কাটিয়ে কিরীটীর বাসায় যখন ফিরে এলাম রাত তখন সাড়ে এগারোটা।
.
কিরীটীর অনুমানটা অর্থাৎ শকুন্তলা চৌধুরী তার কাছে আসার ব্যাপারটার মধ্যে যে সত্যিই কোনো গুরুতর কারণ ছিল সেটা প্রমাণিত হতে কিন্তু খুব বেশী দেরি হল না। চব্বিশ ঘণ্টাও পুরো অতিবাহিত হল না।
পরের দিন রাত তখন ন টা হবে, নিত্যকার মত কিরীটীর গৃহে বসে বিকেল থেকে আড্ডা দিতে দিতে রাত নটা যে বেজে গিয়েছে টের পাই নি।
আরো একটা ব্যাপার নজরে পড়েছিল, আড্ডা দিলেও কিরীটী যেন কেমন একটু অন্যমনস্ক। এবং ব্যাপারটা একা আমারই নজরে পড়ে নি, কৃষ্ণাও লক্ষ্য করেছিল, কৃষ্ণার কথাতেই সেটা একসময় ধরা পড়ল।
কথার মাঝখানে হঠাৎ একসময় কৃষ্ণা বললে, সেই সকাল থেকে লক্ষ্য করছি কেমন যেন অন্যমনস্ক তুমি, কি ভাবছ বল তো?
কিরীটী তার ওপ্রান্ত থেকে অর্ধদগ্ধ সিগারেটটা হাতে নিয়ে সিগারেটের অগ্রভাগ থেকে অ্যাসট্রেতে ছাইটা ঝাড়তে ঝাড়তে বললে, সত্যিই ভাবছি একটা কথা কৃষ্ণা কাল থেকে।
আমরা দুজনেই ওর মুখের দিকে যুগপৎ সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালাম।
কৃষ্ণা শুধাল, কি?
অভিজ্ঞান শকুন্তলম্–
সে আবার কি? প্রশ্নটা করে কিরীটীর মুখের দিকে তাকাল কৃষ্ণা।
শকুন্তলার হাতের হারানো আংটিটা খুঁজে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই রাজা দুষ্মন্ত শকুন্তলাকে চিনতে পেরেছিল যদিও সেটা নাটকীয়–কিন্তু–
কি?
কিন্তু আমি বুঝতে পারলাম না কেন গত সন্ধ্যায় এ যুগের শকুন্তলা দেবীর মনের কথাটা! কেন ধরতে পারলাম না!
কালকেই সেই মেয়েটার কথাই ভাবছিস নাকি?
হ্যাঁ। শকুন্তলা কেন এসেছিল আমার কাছে? আর যদি এসেছিলই তো আসল কথাটা বলতে পারল না কেন? কি ছিল তার মনে?
কি আবার থাকবে?
তাই তো ভাবছি। তার সারা মুখে যে আশঙ্কার দুর্ভাবনার ছায়াটা দেখেছিলাম সে তো মিথ্যা নয়। শি মাস্ট–ইয়েস—শি মাস্ট—অ্যান্টিসিপেটেড সামথিং! ভয়ের কালো ছায়া সে দেখেছিল—ভয়–
কথাটা কিরীটীর শেষ হল না, ক্রিং ক্রিং করে ঘরের কোণে টেলিফোনটা বেজে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে যেন তড়িৎবেগে কিরীটী উঠে দাঁড়ায় এবং ফোনের দিকে যেতে যেতে নিম্নকণ্ঠে বলে, নিশ্চয়ই শকুন্তলা–
ফোনের রিসিভারটা তুলে নিল কিরীটী, হ্যালো! হা হ্যাঁ, কিরীটী রায় কথা বলছি। কে শকুন্তলা দেবী? হা হ্যাঁ—আই ওয়াজ সো লং এক্সপেকটিং ইউ! কি-কি বললেন, আপনার কাকা মারা গেছেন! হ্যাঁ, হ্যাঁ—যাবো, নিশ্চয়ই যাবো–আচ্ছা—ফোনটা রেখে দিল কিরীটী।
তারপর ফোনগাইড দেখে একটা নাম্বারে ফোন করল, কে—শিবেন? হ্যাঁ, আমি কিরীটী রায় কথা বলছি-বেলগাছিয়া তো তোমারই আণ্ডারে, তাই না? শোন—ঠিক ট্রাম ডিপোর পিছনে নতুন যে বাড়িগুলো হয়েছে—তারই একটা বাড়ি-নম্বর হচ্ছে পি ৬/১, অধ্যাপক বিমল চৌধুরীর বাড়ি—অধ্যাপক চৌধুরী,—হ্যাঁ, প্রবাবলি হি হ্যাজবিন কিল্ড! হ্যাঁ-হ্যাঁ— যাও–কি বললে—হ্যাঁ-হ্যাঁ–যাও। হ্যাঁ আমি আসছি, দেখা হলে সব বলব।
কিরীটী ফোনটা রেখে দিল।
কি ব্যাপার?
শুনলে তো শিবেন সোম থানা-ইনচার্জকে কি বললাম! অধ্যাপক বিমল চৌধুরী হ্যাজবিন কিল্ড।
সত্যিই?
আমার অনুমান তাই।
কে ফোন করছিল, শকুন্তলা চৌধুরী?
হ্যাঁ। কথাটা বলে কিরীটী গিয়ে ভিতরের ঘরে প্রবেশ করল। বুঝলাম সে প্রস্তুত হবার জন্যই ভিতরে গেল।
এতটুকুও আর বিলম্ব করবে না। এখুনি বেরুবে।
.
আমি ভাবছিলাম ব্যাপারটা সত্যি সত্যিই তাহলে যাকে বলে ঘনীভূত হয়ে উঠল।
মনে পড়ল ঐ সঙ্গে, আজই অধ্যাপক বিমল চৌধুরীর জন্মতিথি উৎসব ছিল। শকুন্তলা গতকাল বলে গিয়েছিল অধ্যাপকের জীবনের ঐ দিনটি বিশেষভাবে পালিত হয়। অতিথি, আত্মীয়, বন্ধুবান্ধবদের দল সব ঐ দিনটিতে আসেন বিমল চৌধুরীকে শুভকামনা জানাবার জন্য।
আজও নিশ্চয়ই এসেছিল সবাই এবং যা বোঝা গেল সেই উৎসবের ও আনন্দের মধ্যেই অকস্মাৎ মৃত্যুর কালো ছায়া নেমে এসেছে। আনন্দরস মৃত্যু-বেদনায় নীল হয়ে গিয়েছে।
কিরীটীর কণ্ঠস্বরে সম্বিৎ ফিরে এল, চল সুব্রত, একবার ঘুরে আসা যাক।
মনটা ইতিমধ্যে আমারও বুঝি কিরীটীর সঙ্গে যাবার জন্য প্রস্তুত হয়েছিল। উঠে দাঁড়ালাম। বললাম, চল–
বিমল চৌধুরীর বাড়িটা খুঁজে পেতে আমাদের দেরি হয় নি। বাড়ির সামনেই পরিচিত কালো পুলিসভ্যান দাঁড়িয়েছিল এবং দুজন লালপাগড়ি দরজার গোড়ায় প্রহরায় ছিল।
বাড়িটা নতুন নয়। পুরাতন দোতলা বাড়ি। সামনে কিছুটা জায়গা জুড়ে বাগানের মত। নানা জাতীয় ফল ও ফুলের সব গাছ।
পরে জেনেছিলাম দীর্ঘদিন ভাড়াটে হিসেবে থেকে মাত্র বছর তিনেক পূর্বে কিনে নিয়েছিলেন অধ্যাপক বাড়িটা।
সেকালের পুরাতন স্ট্রাকচারের বাড়ি। দীর্ঘদিনের সংস্কারের অভাবে কেমন যেন একটা জীর্ণতার ছাপ পড়েছে বাড়িটার গায়ে। সামনেই একটা টানা বারান্দা। মোটা মোটা পাথরের কাজকরা সেকেলে থাম। বারান্দাটা অর্ধচন্দ্রাকৃতি ভাবে উত্তর থেকে পশ্চিমে ঘুরে গিয়েছে। বাড়িটার পিছনদিকে একটা দীঘি ও নারিকেল গাছ। তার ওদিকে খোলা মাঠ। অর্থাৎ সামনের দিকে শহর আর পিছনে গ্রাম।