কিরীটী বললে, আড্ডি জুয়েলার্স থেকে এনেছি—কাল ফিরিয়ে দিতে হবে। অতঃপর ঘণ্টাখানেক ট্যাক্সিতে শহরের এদিক ওদিক উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুরে সাদার্ন অ্যাভিনুর কাছাকাছি এসে ট্যাক্সির ভাড়া মিটিয়ে ট্যাক্সি ছেড়ে দেওয়া হল।
রাত তখন প্রায় সাড়ে নটা।
কিরীটী লেকের দিকে হাঁটতে শুরু করল। আমিও ওকে অনুসরণ করলাম।
এতক্ষণ কিরীটী একটি কথাও বলে নি। একেবারে চুপ ছিল। লেকের দিকে হাঁটতে হাঁটতে এতক্ষণে কথা বলল, মিস শকুন্তলা চৌধুরীর কথা যদি সত্যই হয় সুব্রত তাহলে বলবতার পক্ষে ঐ রাঘব সরকারকে এড়ানো সত্যিই কঠিন হবে।
কঠিন হবে।
নিশ্চয়ই। বুঝতে পারলি না লোকটাকে দেখে, ওর কথাবার্তা শুনে—সত্যি সত্যিই একটি খাঁটি রাঘব বোয়াল লোক। গ্রাস যখন করে সম্পূর্ণভাবেই গ্রাস করে ও-জাতের লোকগুলো।
তুই কি রাঘব সরকারকে স্রেফ দেখবার জন্যই ইকনমিক জুয়েলার্সে গিয়েছিলি নাকি কিরীটী? প্রশ্নটা না করে পারি না।
শুধু দেখবার জন্যে হবে কেন?
তবে?
আরো প্রয়োজন ছিল।
কি শুনি?
প্রথমতঃ মিস্ চৌধুরীকে আসতে বলেছি যখন—জানা তো আমার প্রয়োজন সত্যিই তাকে সাহায্য করা শেষ পর্যন্ত আমার পক্ষে সম্ভবপর কিনা!
হ্যাঁ, তা তো বটেই।
কি বললি?
না, বিশেষ কিছু না। এই বলছিলাম—
কি?
সুন্দর মুখের জয় তো সর্বত্রই।
আজ্ঞে না।
আর শাক দিয়ে মাছ ঢাকবার চেষ্টা কেন বন্ধু!
মাছ যে শাক দিয়ে ঢাকা যায় না তুইও যেমন জানিস আমিও জানি।
সত্যি বলছিস?
হ্যাঁ। সত্যিকারের রহস্যের ইঙ্গিত না পেলে ইকনমিক জুয়েলার্সে রাঘব সরকারকে দেখবার জন্য আর যেই যাক—কিরীটী রায় যেত না।
রহস্যের ইঙ্গিত? মানে তুই সেনরায়কে সেদিন যে কথা বলছিলি—
যাক সে কথা, তোর কেমন লাগল রাঘব সরকার লোকটাকে বল্?
বুদ্ধিমান নিঃসন্দেহে। কিন্তু—
সত্যি সত্যি লোকটার সঙ্গে কেন দেখা করতে গিয়েছিলি বল্ তো!
দেখতে গিয়েছিলাম শ্রীমান দুষ্মন্তর প্রতিদ্বন্দ্বীটি কি ধরনের—
সত্যিই কি তাই?
তা ছাড়া আর কি!
তা কি বুঝলি?
বুঝলাম, লোকটা সত্যিকারের ধনী আর—
আর?
আর সত্যিই যদি হাত বাড়িয়ে থাকে ও শকুন্তলার দিকে, তাকে সে করায়ত্ত করবেই। তাছাড়া আরো একটা কথা নিশ্চয়ই তোর মনে আছে সুব্রত–
কি?
শকুন্তলার কাকা ঐ রাঘব সরকারকে ঘৃণা করা সত্ত্বেও শকুন্তলাকে বলেছেন ওকেই নাকি বিয়ে করতে হবে তাকে।
হ্যাঁ, মনে পড়ছে বটে।
অথচ বিমল চৌধুরী—মানে শকুন্তলার কাকা অধ্যাপক বিমল চৌধুরীর সঙ্গে আমার পরিচয় না থাকলেও তাকে আমি জানি।
জানিস তুই ভদ্রলোককে?
জানি। অধ্যাপক বিমল চৌধুরী হচ্ছেন সেই শ্রেণীরই একজন যারা পাব্লিক-এর চোখে একজন চিহ্নিত হয়ে দাঁড়াবার জন্য একটার পর একটা চেষ্টাই করে এসেছেন কিন্তু নেভার বিন সাকসিডেড়! কৃতকার্য হতে পারেন নি। হতাশের দলে—ডিফিটেড-এর দলে এবং তারা হাতের কাছে কোন সুযোগ পেলে যেমন ছাড়তে পারেন না তেমনি সেই সুযোগের জন্য তাঁরা অনেক কিছুই বিসর্জন দিতে পারেন। আর রাঘব সরকার হচ্ছে সেই শ্রেণীর একজন–যাঁরা ঐ ধরনের সুযোগের বেচা-কেনা করে উচিত মূল্য পেলে
কি বলছিস তুই কিরীটী?
ঠিক ঐ কথাটাই বলতে চেয়েছি আমি, অর্থাৎ রাঘব সরকারের যদি সত্যিই লোভ হয়ে থাকে শকুন্তলার ওপরে—অনন্যোপায় বিমল চৌধুরীকে তা মেনে নিতেই হবে।
.
০৪.
কিরীটী পথ চলতে চলতেই বলতে লাগল, কিন্তু আমি ভাবছি এখনো মিস শকুন্তলা চৌধুরী আমার কাছে আগমনের তার সত্যিকারের কারণটা কেন শেষ পর্যন্ত বলতে পারল না!
কেন, সে তো বললেই, বিয়েটা কোনমতে বাধা দেওয়া যায় কিনা তাদের—
আদৌ না। সে তুই বুঝবি না। তুচ্ছ কারণে সে আমার কাছে আসে নি।
তবে?
সে এসেছিল সত্যিকারের কোন বিপদের আভাস পেয়ে—
বিপদের!
হ্যাঁ, কিন্তু কথাটা আমাকে শেষ পর্যন্ত যে কোন কারণেই হোক বলতে পারে নি।
তবে?
অবিশ্যি বিয়ের ব্যাপারটাও একটা কারণ ছিল। কিন্তু তার পশ্চাতে নিশ্চয়ই ছিল আরো একটা গুরুতর কারণ—যেজন্য সে ছুটে এসেছিল আমার কাছে।
কিন্তু–
কিরীটীর দিক থেকে আর কোন সাড়া পাওয়া গেল না। কথা বলতে বলতে হঠাৎ যেন সে চুপ করে গেল। পকেট থেকে একটা চুরুট বের করে সেটায় অগ্নিসংযোগ করে পুনরায় হাঁটতে লাগল।
লেকের ভিতর দিয়ে আমরা শর্টকার্ট করছিলাম।
লেকটা ইতিমধ্যেই নির্জন হয়ে গিয়েছে। ভ্রমণকারী ও বায়ুসেবীর দল অনেক আগেই চলে গিয়েছে। কদাচিৎ এক-আধজনকে চোখে পড়ছিল। অদ্ভুত একটা শান্ত স্তব্ধতা যেন চারিদিকে ঘনিয়ে উঠেছে।
কৃষ্ণপক্ষের রাত। কালো আকাশে কেবল তারাগুলো পিটপিট করে জ্বলছে।
কিরীটীর নাম ধরে একবার ডাকলামও, কিন্তু কোন সাড়া দিল না কিরীটী, যেমন হেঁটে চলছিল তেমনই হেঁটে চলতে লাগল। কোন একটা চিন্তা চলেছে কিরীটীর মনের মধ্যে। বরাবর দেখেছি মনের ঐ অবস্থায় কখনো সে কথা বলে না।
অগত্যা আমিও ওর পাশে পাশে হেঁটে চললাম।
বোধহয় একটু অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলাম হঠাৎ কিরীটী দাঁড়িয়ে পড়ল, সুব্রত—
অ্যাঁ! কিছু বলছিলি?
হুঁ, বলছিলাম ভবিকে ভোলাতে পারি নি। নিম্নকণ্ঠে কথাগুলো বলল কিরীটী।
কি বললি?
রাঘব সরকারের লোক আমাদের ফলো করছে—
সে কি!
হ্যাঁ—পিছনে ফিরে দেখ—
সত্যিই ফিরে তাকিয়ে দেখলাম, আমাদের হাত-পনের দূরে একটা মূর্তি অদূরবর্তী লাইট পোস্টটার নীচে দাঁড়িয়ে।