সঙ্গের ভদ্রলোকটিই কাচের দরজাটা টেনে খুলে আমাদের বললেন, যান, বড়বাবু ভিতরে আছেন–
পর্দা সরিয়ে আমরা ভিতরে প্রবেশ করতেই নাতি প্রশস্ত একটি ঘর আমাদের নজরে পড়ল। ঘরের দু পাশে দুটি লোহার সিন্দুক। এবং এক কোণে একটি কাচের টেবিলের সামনে সবুজ ঘেরাটোপ দেওয়া টেবিল ল্যাম্পের নীলাভ আলোয় চোখে পড়ল টাকমাথা এক ব্যক্তি, মাথা নীচু করে কি যেন পরীক্ষা করছেন। তাঁর সামনে নানা আকারের ছোট বড় জুয়েলয়ের বাক্স। পাশে কাচের কেসের মধ্যে একটি ওয়েয়িং অ্যাপারেটাস।
টেবিলের সামনে দেখা গেল খান-তিনেক আধুনিক ডিজাইনের স্টীলের চেয়ার।
মাথা না তুলেই সেই ব্যক্তি মৃদুকণ্ঠে আমাদের আহ্বান জানালেন, আসুন-বসুন।
বলা বাহুল্য আমরা এগিয়ে গিয়ে চেয়ারে বসলাম।
কাজ করতে করতেই ভদ্রলোক প্রশ্ন করলেন, আমেদাবাদ থেকে আসছেন?
কিরীটী এবারও মৃদু কণ্ঠে বললে, না, আসলে করাচী থেকে আসছি।
সঙ্গে সঙ্গে ভদ্রলোক মুখ তুললেন।
চোখে কালোমোটা সেলুলয়েড ফ্রেমের চশমা। চশমার কাচের ভিতর দিয়ে এক জোড়া চোখের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আমাদের উপরে ন্যস্ত হল। মুহূর্তকাল সেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টি যেন কিরীটীর ও আমার উপরে স্থির রইল।
আপনারা–
মিঃ সরকার, আমার নাম ইসমাইল খান—আমার সঙ্গে ইনি আমার দোস্ত মধুবাবু— আমি একটা বিশেষ কাজে আপনার কাছে এসেছিলাম—একেবারে খাস হিন্দীতে কথাগুলো বললে কিরীটী।
বলুন?
কিছু বেলজিয়ান হীরা আমার কাছে আছে।
বেলজিয়ান হীরা!
হ্যাঁ। হীরাগুলো বিক্রি করতে চাই।
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আবার কিছুক্ষণ চেয়ে রইল রাঘব সরকার। তারপর মৃদুকণ্ঠে বললেন, হীরা বিক্রী করতে চান?
হ্যাঁ।
অপরিচিত কারো কাছ থেকে তো কখনো আমি কোনো জুয়েলস্ কিনি না।
ব্যবসা করতে বসেছেন আপনি মিঃ সরকার, তাই ভেবেছিলাম—
কি ভেবেছিলেন মিঃ খান?
যাদের সঙ্গে কারবার করেন নিশ্চয়ই সকলেই আপনার পরিচিত আসেন না—সম্ভবও নয় তা।
না, তা আসেন না বটে—তবে—
বলুন?
আপনি এ দেশের হলে কথা ছিল না—কিন্তু আপনি আসছেন করাচী থেকে!
তা হয়ত আসছি, তবে একজনের কাছে আপনার নাম শুনেই এসেছিলাম।
কে সে?
ক্ষমা করবেন, নামটা বলা সম্ভব নয়।
অতঃপর রাঘব সরকার মুহূর্তকাল কি যেন ভাবলেন, তারপর বললেন, বেশ নিয়ে আসবেন, দেখব।
একটা স্যাম্পল এনেছি, যদি দেখতে চান তো দেখাতে পারি।
স্যাম্পল এনেছেন?
হ্যাঁ। কারণ দরদস্তুর একটা মোটামুটি স্থির না হলে মিথ্যে হীরাগুলো বয়ে নিয়ে এসে তো কোন লাভ হবে না।
কিরীটীর শেষোক্ত কথায় আবার রাঘব সরকার কিরীটীর দিকে মুখ তুলে তাকালেন।
আমি লোকটির—অর্থাৎ রাঘব সরকারের দিকে তাকিয়ে দেখছিলাম।
বয়স লোকটার যে পঞ্চাশের নীচে নয় তা দেখলেই বোঝা যায়। কপালের কাছে এবং রগের দু পাশের চুলে পাক ধরেছে। কপাল ও নাকের পাশে বলিরেখা জাগতে আরম্ভ হয়েছে, বয়সের চিহ্ন। কিন্তু সত্যি সুপুরুষ ভদ্রলোক!
শকুন্তলা চৌধুরী মিথ্যা বলে নি, রাঘব সরকারের রূপবর্ণনায় এতটুকু অত্যুক্তি করে নি। মাথার চুল পাতলা হয়ে এসেছে, মধ্যস্থলে টাক দেখা দিয়েছে। প্রশস্ত কপাল। দীর্ঘ চক্ষু। চক্ষুর দৃষ্টিতে বুদ্ধির দীপ্তি। রোমশ জোড়া জ্ব। খাড়া নাক। দৃঢ়বদ্ধ চোয়াল। বৃষস্কন্ধ। টুকটকে গৌর গাত্রবর্ণ। পরিধানে ঢোলা পায়জামা ও পাঞ্জাবি। পাঞ্জাবির তলা থেকে নেটের গেঞ্জীর কিয়দংশ ও রোমশ বক্ষঃস্থলের কিছুটা দেখা যাচ্ছে।
কই দেখি কি স্যাম্পল এনেছেন? রাঘব সরকার আবার বললেন।
সেরওয়ানীর পকেটে হাত চালিয়ে একটি মরক্কো লেদারের ছোট কেস বের করল কিরীটী এবং বাক্সের গায়ের বোতামটি টিপতেই, স্প্রিং অ্যাক্সনে বাক্সের ডালাটা খুলে যেতেই বাক্সের মধ্যস্থিত প্রায় দশ রতির একটি হীরা ঘরের ঈষৎ নীলাভ আলোয় যেন ঝিলমিল করে উঠল।
এই দেখুন—কিরীটী বাক্সসমেত হাতটা এগিয়ে ধরল রাঘব সরকারের দিকে।
রাঘব সরকার কিরীটীর হাত থেকে হীরাটা নিলেন বাক্স থেকে দু আঙুলের সাহায্যে তুলে। এবং বেশ কিছুক্ষণ সময় হীরাটা আলোয় পরীক্ষা করে বললেন, বেলজিয়ান হীরাই। কতগুলো হীরা আছে আপনার কাছে, মিঃ খান?
কিছু আছে—
হুঁ। তা এ হীরা আপনি কোথা থেকে পেলেন মিঃ খান?
কিরীটী মৃদু হেসে বললে, হীরা বেচতে এসেছি, ঠিকুজী বেচতে তো আসি নি মিঃ সরকার।
রাঘব সরকার কিরীটীর কথায় আবার ওর মুখের দিকে তাকালেন পূর্ববৎ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে এবং ক্ষণকাল তাকিয়ে থেকে মৃদু হেসে বললেন, এত দামী জিনিসের কারবার তো ঠিকুজী না জানলে হয় না মিঃ খান!
কেন বলুন তো?
কারণ ঠিকুজীর উপরই যে অনেক সময় দামটা নির্ভর করে।
ওঃ, এই কথা! তা বেশ তো, কি রকম ঠিকুজী হলে আপনার পছন্দ হবে বলুন?
মানে?
কথাটা তো আমার অস্পষ্ট বা দুর্বোধ্য নয় মিঃ সরকার, বিশেষ করে আপনার মত একজন অভিজ্ঞ কারবারীর পক্ষে।
তাহলে—
ধরে নিন না, আপনি যা ভেবেছেন তাই। বলুন এবারে দর।
আবার ক্ষণকাল যেন স্তব্ধ হয়ে চেয়ে রইলেন রাঘব সরকার কিরীটীর মুখের দিকে। তারপর বললেন নিম্নকণ্ঠে, দরের জন্য আটকাবে না। যত হীরা আপনার কাছে আছে নিয়ে আসবেন।
চেকে কিন্তু পেমেন্ট নেব না।
নগদই পাবেন। কবে আসছেন বলুন?
ফোনে জানাব।
বেশ।
অতঃপর রাঘব সরকারকে নমস্কার জানিয়ে আমরা বের হয়ে এলাম তার ঘর থেকে।
.
রাস্তায় বের হয়ে আবার একটা ট্যাক্সি নেওয়া হল এবং ট্যাক্সিতে উঠে প্রশ্ন করলাম, হীরাটা কার রে?