রঞ্জন সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে যেন তাকাল কিরীটীর মুখের দিকে।
হ্যাঁ ভুল, আপনি ভেবেছিলেন অধ্যাপকের অর্থাৎ আপনার মামার সঙ্গে মনোমালিন্য হওয়ায় শেষ পর্যন্ত হয়তো তিনি শকুন্তলা দেবীকে তার যাবতীয় সম্পত্তি ও টাকাকড়ি লিখে দিয়ে যাবেন আপনাকে বঞ্চিত করে—
না, ভুল করি নি—তিনি তাই আমাকে স্পষ্ট বলেছিলেন!
কিন্তু তিনি তা করতেন না। আর করলেও তা আইনে টিকত না। কারণ শকুন্তলা দেবীর তো তার সম্পত্তির উপরে আইনতঃ কোন অধিকারই বর্তাতো না!
কি বলছেন।
ঠিকই বলছি, শকুন্তলা তার কেউ নয়।
কেউ নয়?
না, চৌধুরী-বাড়ির কেউ নয় সে–
সহসা ঐ সময় দড়াম করে ঘরের ভেজানো দরজা খুলে গেল এবং উদ্ভ্রান্তের মতই শকুন্তলা ঘরে এসে ঢুকল।
কি–কি বললেন মিঃ রায়?
কিরীটী চুপ।
মিঃ রায়, চুপ করে আছেন কেন, বলুন-তবে কে আমি? কেন এ বাড়িতে আমি– বলুন মিঃ রায় বলুন–
তিনি দয়া করে এখানে আপনাকে স্থান দিয়েছিলেন—
দয়া করে!
হ্যাঁ।
কিন্তু কেন? কেন তার এ দয়া?
যেহেতু তিনি ছিলেন সত্যিকার মহৎ ব্যক্তি। আপনি—সরমা দেবী ও বিনায়কবাবুর সন্তান।
কি—কি বললেন? আমি—আমি—বাকী কথাগুলো আর শকুন্তলা উচ্চারণ করতে পারল না। জ্ঞান হারিয়ে ঘরের মেঝের উপর পড়ে গেল।
কিরীটী তাড়াতাড়ি ছুটে গিয়ে তাকে মাটি থেকে তুলে নিল কোলের উপরে।
.
আরো ঘণ্টা দুই পরে।
থানায় শিবেন সোমের অফিস ঘরে বসেছিলাম আমরা।
শকুন্তলাকে রামচরণের জিম্মায় রেখে চলে এসেছি আমরা রঞ্জন ও বিনায়কবাবুকে অ্যারেস্ট করে সঙ্গে নিয়ে।
কিরীটী বলছিল, তাই আমি বলছিলাম শেষ পর্যন্ত অধ্যাপকের ব্যাপারটা ট্র্যাজেডি অফ এরর এ পর্যবসিত হয়েছিল।
কিন্তু আপনি বিনায়ক সেনকে সাসপেক্ট করলেন কি করে?
সরমার জবানবন্দীর পরই সে-রাত্রে আমি বুঝতে পেরেছিলাম ঐ সরমাকে কেন্দ্র করে কোন একটি গোপন ইতিহাস আছে বিমলবাবুর হত্যার পশ্চাতে। তারপর অকুস্থলের জিওগ্রাফি–অধ্যাপকের পাশের ঘরেই রঞ্জনবাবু থাকতেন, তাতে করে মনে হয়েছিল তিনি অর্থাৎ রঞ্জনবাবু হয়তো অনেক কিছুই জানেন বা জানতে পেরেছেন আড়ি পেতে। আরো রঞ্জনবাবুই অধ্যাপককে ফোনের সংবাদটা সরবরাহ করেছিলেন। স্বাভাবিক ভাবে অবিশ্যি তাতে করে রঞ্জনবাবুর উপরেই সন্দেহ পড়ার কথা, কিন্তু বাড়িতে অত লোকজনের উপস্থিতির মধ্যে রঞ্জনবাবুর একার পক্ষে অত বড় রিস্ক নেওয়া আদৌ সম্ভবপর ছিল না বলেই আমার মনে হয়েছিল, আরো কেউ ওর পিছনে আছে এবং কথাটা মনে হওয়ার সঙ্গেসঙ্গেই আমি আর কার পক্ষে ঐ ব্যাপারে লিপ্ত থাকা সম্ভবপর ছিল ভেবেছি। ইতিমধ্যে ময়না তদন্তের রিপোর্টটা পেয়ে গেলাম এবং ময়না তদন্ত রিপোর্টে মৃত্যুর কারণ ডিজিট্যালিন জানতে পেরে ঐ সন্দেহটা আমার দৃঢ় হয় যে, রঞ্জনবাবুর সঙ্গে আরো কেউ আছে। কিন্তু কে সে? কার পক্ষে থাকা সম্ভব? এদিকে যেভাবে নিহত হয়েছিলেন অধ্যাপক, তাতে করে একটা সন্দেহ আমার প্রথম থেকেই মনের মধ্যে বদ্ধমূল হয়েছিল—যে-ই অধ্যাপককে হত্যা করুক না কেন সে তার বিশেষ পরিচিত এবং পরিচয়ের ঐ সুযোগটা নিয়েই সে অর্থাৎ হত্যাকারী আকস্মিক আঘাত হেনেছিল অধ্যাপককে। এখন প্রশ্ন, পরিচিতের মধ্যে সে-রাত্রে ঐ সময় অকুস্থানে কে কে উপস্থিত ছিল! দুষ্মন্ত, শকুন্তলা ও সরমাকে আমি আগেই সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ দিয়েছিলাম। কারণ দুষ্মন্ত ঐ সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিল না এবং পরে খবর নিয়েও জেনেছিলাম সত্যিই সে হত্যার সময়টা তার কলেজের রিসার্চরুমে ব্যস্ত ছিল। এবং বাকী দুজনকে বাদ দিয়েছিলাম তারা নারী বলে। কোন নারীর পক্ষে ঐভাবে হত্যা করা সম্ভবপর আদৌ ছিল না। তাহলে এখন বাকী থাকে তিনজন—বিনায়ক সেন, রাঘব সরকার ও রঞ্জন বোস। রঞ্জন বোস সম্পর্কে আগেই ভেবেছি—বাকী রইল বিনায়ক সেন। বিনায়ক সেন সম্পর্কে আমি অনুসন্ধান শুরু করি। এবং অনুসন্ধানের ফলে দুটো ব্যাপার আমি জানতে পারি। প্রথম তার বর্তমান আর্থিক অবস্থা শোচনীয় হয়ে উঠেছিল। দ্বিতীয়, একদা ফোর্থ ইয়ার পর্যন্ত সে ডাক্তারী পড়েছিল। কাজেই হত্যার কারণ ও উপায়ের দিক থেকে তারই ওপর গিয়ে আমার সন্দেহ পড়ে। আরো একটা ব্যাপার এর মধ্যে ছিল, সেটা হচ্ছে সরমার উপরে আমার সন্দেহ। আমার কেমন যেন প্রথম থেকেই ধারণা হয়েছিল সরমা হত্যাকারী কে জানতে পেরেছিল—কিন্তু আশ্চর্য লেগেছিল আমার কথাটা ভেবে যে, সরমা হত্যাকারী কে জানা সত্ত্বেও ব্যাপারটা গোপন করে গেল কেন? ভাবতে শুরু করি এবং ভাবতে ভাবতে হঠাৎ আমার মনে হয়, সরমার অতীতের সঙ্গে ঐ বিনায়ক সেন জড়িত নয় তো! কারণ দীর্ঘদিন সরমা অধ্যাপকের গৃহে আছে এবং বিনায়ক অধ্যাপকের বাল্যবন্ধু। ঠিক সেই সংশয়ের মুহূর্তে শকুন্তলাকে আমি অ্যারেস্ট করবার জন্য শিবেনবাবু আপনাকে বলি। সেদিন আপনাকে কোন রিজ দিই নি, কিন্তু আজ বলছি, সরমা ও শকুন্তলার ফটো থেকে উভয়ের মধ্যে অদ্ভুত সৌসাদৃশ্য দেখবার আগেই ওদের দুজনের মুখের বিশেষ তিলটি ও উভয়ের মুখের একই ধরনের গঠন আমার দৃষ্টিকে আকর্ষণ করেছিল সেই কারণেই আমি ফটোর কথা বলেছিলাম এবং সেই সন্দেহের আমার নিরসনের জন্যই শকুন্তলাকে অ্যারেস্ট করতে বলেছিলাম। তীর ছুঁড়েছিলাম আমি সরমার প্রতিই এবং আমার অনুমান যে মিথ্যা নয় তা প্রমাণ হয়ে গেল সেই রাত্রে যে মুহূর্তে সরমা এসে আমার গৃহে উপস্থিত হল শকুন্তলার অ্যারেস্টের পর। সে-রাত্রে নীচে গিয়ে সরমাকে বিদায় দেবার সময় বিনায়ক সেনের প্রতি আমার সন্দেহের কথাটা বলাতেই সরমার। মুখের দিকে তাকিয়ে তার মুখে যে পরিবর্তন দেখেছিলাম, আমার তাতে করে আর কোন সন্দেহই রইল না যে শকুন্তলার বাপই ঐ বিনায়ক সেন। তার পরের ব্যাপার তো আপনারা সকলে জানেনই।