তার মুখের দিকে তাকিয়ে সেই মুহূর্তে আমার মনে হল কিরীটী যেন রীতিমত এক সংশয়ে পড়েছে।
অতঃপর কাহিনীর শেষাংশ সে উদঘাটিত করবে কি করবে না এবং কেন যে তার ঐ দ্বিধা তাও আমি বুঝতে পারছিলাম।
সরমা—সরমার কথা ভেবেই সে হঠাৎ চুপ করে গেল।
কিরীটী মনে মনে কি ভাবল সে-ই জানে—তবে মনে হল তার মুখের দিকে তাকিয়ে, অতঃপর বাকিটুকু সে বলবে বলেই মনে মনে স্থির করেছে। এবং আমার অনুমান যে মিথ্যা নয়, পরমুহূর্তেই বুঝলাম।
সে বলতে শুরু করল পুনরায়:
বুদ্ধিমতী সরমা ব্যাপারটা জানতে পেরেছিল ইতিমধ্যে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, সে অধ্যাপককে ভুল বুঝেছিল—সে ভেবেছিল বুঝি ইচ্ছা করেই অধ্যাপক নিজের স্বার্থের জন্য শকুন্তলাকে রাঘব সরকারের হাতে তুলে দিচ্ছেন। এবং শুধু যে সরমাই ভুল বুঝেছিল অধ্যাপককে তাই নয়, বিনায়কবাবুও ভুল বুঝেছিলেন তাঁর বাল্যবন্ধু অধ্যাপক বিমলবাবুকে। তিনি অর্থাৎ মিঃ। সেন ভেবেছিলেন—এই পর্যন্ত বলেই কিরীটী আবার থামল এবং হঠাৎ শকুন্তলার দিকে ফিরে তাকিয়ে বলল, মিস চৌধুরী যদি কিছু মনে না করেন তো-বড্ড পিপাসা পেয়েছে একটানা বকে বকে, যদি একটু চায়ের ব্যবস্থা করতেন–
শকুন্তলা তাকাল কিরীটীর মুখের দিকে।
কিরীটী ব্যাপারটা বুঝতে পেরেই বোধ হয় মৃদু হাস্যসহকারে বলে, না, আপনি না ফিরে আসা পর্যন্ত আমি চুপ করেই আছি—তবে একটু তাড়াতাড়ি করবেন।
মনে হল একান্ত যেন অনিচ্ছার সঙ্গেই শকুন্তলা দেবী ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।
.
২৪.
কিরীটী যেন কান পেতেই ছিল, শকুন্তলার পায়ের শব্দটা মিলিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই কিরীটী ইঙ্গিতে দরজাটা ভেজিয়ে দেবার জন্য বলল।
আমি এগিয়ে গিয়ে দরজাটা ভেজিয়ে দিলাম।
শিবেনবাবু, উনি ফিরে আসবার আগেই আমাকে শেষ করতে হবে—আই মাস্ট ফিনিশ ইট বিফোর সি কামস্ ব্যাক্! হ্যাঁ, বলছিলাম বিনায়কবাবুও তার বাল্যবন্ধু অধ্যাপককে ভুল বুঝেছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন বিনায়কবাবুর পীড়াপীড়ির হাত থেকে শকুন্তলার রাঘবের সঙ্গে বিবাহের ব্যাপারে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্যই হয়তো শেষ পর্যন্ত অধ্যাপক রাঘবের কাছে। শকুন্তলার সত্যিকারের জন্মবৃত্তান্তটা খুলে বলবেন। রাঘব তা হলে জেনেশুনে সমাজের জন্মপরিচয়হীন এক মেয়েকে নিশ্চয়ই বিবাহ করবে না এবং তার ফলে এক ঢিলে দুই পাখীই। মারা হবে। রাঘবের হাত থেকেও নিষ্কৃতি পাওয়া যাবে এবং শকুন্তলাকেও দুঃখ দেওয়া হবে। কিন্তু বিনায়কবাবু বুঝতে পারেন নি—অধ্যাপকের পক্ষে ঐ কাজ কখনোই সম্ভবপর ছিল না–
সহসা ঐ সময় এতক্ষণে বিনায়ক সেন কথা বলে উঠলেন, ছিল—ইউ ডণ্ট নো হিম—
মিঃ সেন!
হ্যাঁ, হ্যাঁ—অ্যাণ্ড ইন ফ্যাক্ট হি থ্রেটে মি, আমাকে সে শাসিয়েছিল।
তবু আমি বলব তিনি তা করতেন না।
করতেন—আর তা করতেন বলেই দেয়ার ওয়াজ নো আদার অল্টারনেটিভ—
মিঃ সেন!
ইয়েস-হ্যাঁ হ্যাঁ, আই কিল্ড হিম! আমি তাকে হত্যা করেছি ইয়েস—আমি স্বীকার করছি তাকে আমি হত্যা করেছি—
আমি জানতাম মিঃ সেন—আমি জানতে পেরেছিলাম পরের দিনই ব্যাপারটা টেলিফোন অফিসে এনকোয়ারি করে। আপনার বাড়ি থেকেই সেরাত্রে আপনার পূর্ব-নির্দেশমতই এখানে ফোন-কল এসেছিল এবং আপনার ও রঞ্জনবাবুর পূর্ব-প্ল্যানমত সেই ফোন আসা মাত্রই রঞ্জনবাবু ফোনটা অধ্যাপকের ঘরে নিয়ে গিয়ে রেখে তাকে সংবাদ দেন—তাই না রঞ্জনবাবু?
মৃদু কণ্ঠে রঞ্জন বলল, হ্যাঁ।
তারপর—কিরীটী বলতে লাগল, বেচারী যখন ঘরে ঢুকে নিশ্চিন্তে ফোন তুলে নিয়েছেন। —বিনায়কবাবু রঞ্জনবাবুর ঘর থেকে দুই ঘরের মধ্যবর্তী দরজাপথে এসে পশ্চাৎ থেকে অতর্কিতে ক্লোরোফরম নিয়ে আক্রমণ করেন অধ্যাপককে। এবং অজ্ঞান করে পরে ডিজিট্যালিন সম্ভবত হাই ডোজে ইনজেক্ট করে অধ্যাপককে হত্যা করা হয়—তাই নয় কি?
রঞ্জনই আবার মৃদু কণ্ঠে বলে, হ্যাঁ।
দেখুন দুর্ভাগ্য আপনাদের রঞ্জনবাবু ও বিনায়কবাবু, আপনারা ভেবেছিলেন কেউ সে-কথা জানতে পারবে না কিন্তু তা তো হল না—আপনারাই রেখে গিয়েছিলেন হত্যার নিদর্শন পশ্চাতে—
নিদর্শন! শিবেন সোম প্রশ্ন করলেন।
হ্যাঁ, প্রথমতঃ ফোন-কল। দ্বিতীয়তঃ ফোনটাকে ঘরে নিয়ে গিয়ে। তৃতীয়তঃ ক্লোরোফরমের ভেজা টাওয়েলটা বাথরুমে ফেলে রেখে গিয়ে। চতুর্থ ক্লোরোফরমের গন্ধ ঢাকবার জন্য ট্যাপ খুলে বাথরুমে হাত ধুয়েও ট্যাপটা তাড়াতাড়িতে বন্ধ করতে ভুলে গিয়ে। এবং পঞ্চম সেই রাত্রেই ঐ ঘরটা পুলিস বন্ধ করে চলে যাবার পর আবার রঞ্জনবাবু আপনি বিনায়কবাবুর পরামর্শে তালা ভেঙে ঘরে ঢুকে অধ্যাপকের বসবার চেয়ারটা ভেঙে
কিন্তু আফটার অল, উনি চেয়ারটা ভাঙতে গেলেন কেন? শিবেন সোম প্রশ্ন করেন।
হীরার জন্য।
কি বললেন, হীরার জন্য?
হ্যাঁ, ল্যাবরেটারি থেকে এনে সিনথেটিক হীরাগুলো অধ্যাপক ঐ চেয়ারের পায়ার গুপ্ত কোটরেই লুকিয়ে রাখতেন। বিনায়কবাবুর পরামর্শেই তিনি ঐভাবে হীরাগুলো লুকিয়ে রেখেছিলেন, অবিশ্যি বিনায়কবাবু তখন মরীয়া হয়ে উঠেছেন, রাঘব সরকারকে যদি সহজে কায়দা না করতে পারেন তো ঐ হীরার সাহায্যেই কায়দা করবেন এই বোধ হয় ভেবেছিলেন, তাই নয় কি বিনায়কবাবু?
বলাই বাহুল্য, বিনায়ক সেন কোন জবাব দিলেন না।
বুঝতে পারছি অনুমান আমার মিথ্যে নয়। কিন্তু রঞ্জনবাবু, বিনায়কবাবু যেমন ভুল করেছেন তেমনি আপনিও একটা মারাত্মক ভুল করেছেন।