প্রশ্নটা করে কিরীটী শকুন্তলার মুখের দিকে তাকাল।
হ্যাঁ, আমি—
আপনি জানতেন।
হ্যাঁ।
শুধু আপনি কেন, আরো দুজন ইদানীং ব্যাপারটা কিছুদিন ধরে জানতে পেরেছিলেন মিস চৌধুরী।
আরো দুজন?
শকুন্তলা প্রশ্নটা করে কিরীটীর মুখের দিকে তাকাল।
হ্যাঁ আরো দুজন—মিঃ সেন আর ঐ রঞ্জনবাবু। আর তাইতেই তো গোলমালটা বিশ্রীভাবে সহসা পাকিয়ে উঠল।
কিরীটী বলতে বলতে আবার একটু থামল।
ঘরের মধ্যে সব কটি প্রাণীই যেন অখণ্ড মনোযোগের সঙ্গে কিরীটী-বর্ণিত কাহিনী শুনছিল।
.
২৩.
কিরীটী বলতে লাগল, সেই কথাতেই এবার আসছি—অর্থাৎ বর্তমান নাটকের তৃতীয় দৃশ্যে। ব্যাপারটা অবিশ্যি রঞ্জনবাবুই প্রথমে জানতে পারেন, কারণ তিনি এ বাড়িতে আসা অবধি অধ্যাপকের পাশের ঘরটিতেই স্থান নিয়েছিলেন। রাঘব সরকার মধ্যে মধ্যে রাত্রের দিকে অধ্যাপকের সঙ্গে দেখা করতে আসত এবং অধ্যাপকের ঘরের মধ্যে বসেই তাদের মধ্যে। আলোচনা হতো। কোন একদিন সেই রকম কোন আলোচনাই রাঘব ও অধ্যাপকের মধ্যে তার কানে হয়ত যায় এবং ব্যাপারটা তিনি জানতে পারেন। যাই হোক ইতিমধ্যে আমার ধারণা একটি ঘটনা ঘটে—বিনায়ক সেনের নিতান্ত সঙ্গীন অবস্থা চলছিল, চারিদিকে ধার-দেনা, অনন্যোপায়ে তিনি হয়তো রাঘব সরকারের কাছে গিয়ে কিছু অর্থের জন্য বলেন, যার ফলে। মাত্র মাস-দুই আগে সংবাদপত্রে একটা বিজ্ঞাপন আমার নজরে পড়েছিল—স্বাগতা পিকচার্সের নবতম চিত্ৰাৰ্ঘ জুয়েলার শ্রীরাঘব সরকারের প্রযোজনায় অভিজ্ঞান শকুন্তলম্! হ্যাঁ, ঐ অভিজ্ঞান শকুন্তলমের বিজ্ঞপ্তিটিই আমার চোখ খুলে দেয়। যার ফলে আমি বুঝতে পারি রাঘব সরকার বিনায়ক সেনের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। কিন্তু রাঘব সরকারের মত ঝানু। লোক এত সহজে অনিশ্চিত ফিল্ম বিজনেসের কবলিত হবে সম্ভব তো নয়। কথাটা মনে মনে। পর্যালোচনা করতে গিয়েই একটা সম্ভাবনা আমার মনের মধ্যে উঁকি দেয়, নিশ্চয় ঐ যোগাযোগের স্বীকৃতির মধ্যে কোন কার্যকারণ আছে। পরে ভেবে মনে হয়েছে, সেটা ঐ শকুন্তলা দেবী। রাঘব সরকার নিশ্চয়ই মিঃ সেনের প্রস্তাবে রাজী হয়েছিলেন, বিনায়কবাবু অধ্যাপকের বাল্যবন্ধু এবং বিশেষ প্রীতি আছে দুজনের মধ্যে, অতএব বিনায়ক সেন চেষ্টা করলে এই বিবাহ ঘটাতে পারেন, এই আশাতেই বিবাহ ঘটাবার চুক্তিতে কি মিঃ সেন, তাই নয়? প্রশ্নটা করে কিরীটী তাকাল বিনায়ক সেনের দিকে।
বিনায়ক সেন কোন জবাব দিলেন না, মাথা নীচু করেই রইলেন নিঃশব্দে।
বুঝতে পেরেছি আমার অনুমান মিথ্যে নয় মিঃ সেন। আপনার ও রাঘব সরকারের পরস্পরের মধ্যে ঐ চুক্তিই হয়েছিল। যাক, কিন্তু দুর্ভাগ্য বিনায়কবাবু জানতেন না যে সিনথেটিক হীরার ব্যাপারে ইতিমধ্যেই তাঁর বাল্যবন্ধু অধ্যাপক বিমলবাবুকে রাঘব সরকারের কুক্ষিগত হতে হয়েছিল। সেটা বোধ হয় জানতে পারেন সর্বপ্রথম রঞ্জনবাবুর মুখেই। রঞ্জনবাবুর সম্পর্কে আরো কিছু আমার বক্তব্য আছে। রঞ্জনবাবু বিনায়কবাবু ফিল্ম-এর বিজনেস করেন জেনে তার কাছে গিয়েছিলেন হয়তো কোন সময় কাজের জন্য, কিন্তু বিনায়কবাবু হয়তো তাঁকে পাত্তা দেন নি এবং ঐ সময় হীরার ব্যাপারটা তার গোচরীভূত হওয়ায় আবার হয়তো তিনি বিনায়কের কাছে যান এবং বিনায়ক এবারে আর রঞ্জনবাবুকে প্রত্যাখ্যান জানাতে পারেন নি, তাঁর সঙ্গে হাতে হাত মিলান। কি মিঃ সেন, আমার অনুমান কি মিথ্যা?
পূর্ববৎ বিনায়ক সেন চুপ করে রইলেন।
কিরীটী আবার বলতে লাগল, মিথ্যা নয় আমি জানি। যাই হোক এবারে বিনায়কও রাঘব। সরকারের পক্ষ থেকে বেচারী অধ্যাপককে চাপ দিতে শুরু করলেন। অথচ তিনি তখনও জানতেন না শকুন্তলার সত্য পরিচয়টা। অবিশ্যি জানলেও যে উনি পিছপাও হতেন আমার মনে হয় না। ব্যাপারটা তা হলে শেষ পর্যন্ত কিভাবে জটিল হয়ে উঠল আপনারা ভেবে দেখুন এবং সব জটিলতার মূলে ঐ শকুন্তলা দেবীর প্রতি শয়তান রাঘবের শ্যেনদৃষ্টি-হা শকুন্তলা দেবী, আপনিই এই নাটকের মূল। যে নাটক গত কিছুদিন ধরে এই বাড়িতে আপনাকে কেন্দ্র করে সংঘটিত হয়েছে এবং যার চরম ক্লাইমেক্সে অধ্যাপকের শোচনীয় মৃত্যু হল
আমি! অস্ফুট কণ্ঠে বলল শকুন্তলা।
হ্যাঁ, আপনি। কিন্তু সে কাহিনীরও পশ্চাতে রয়েছে আপনাকেই কেন্দ্র করে আর এক কাহিনী–
আর এক কাহিনী!
হ্যাঁ। কিন্তু সে কাহিনীর বিবৃতির আজ আর আপনার কাছে কোন প্রয়োজন নেই।
কিরীটীবাবু-কি যেন বলবার চেষ্টা করে শকুন্তলা।
কিন্তু শকুন্তলাকে থামিয়ে দিয়েই কিরীটী বলে, ব্যস্ত হবেন না শকুন্তলা দেবী, হয়ত সে কাহিনী একদিন আপনা হতেই আপনার কাছে প্রকাশ হয়ে যাবে। কিন্তু যাক সে কথা, মিঃ সেন ও রঞ্জনবাবুর কথা আমি বলছিলাম সেই কথাই শেষ করি। একটু আগে যে কাহিনীর ইঙ্গিত মাত্র আমি দিলাম, সম্ভবতঃ সেটা রঞ্জনবাবু জেনেছিলেন কোন এক সময় অধ্যাপকের পাশের ঘরেই থাকার দরুন-অধ্যাপক ও বিনায়কবাবুর মধ্যে আলোচনা প্রসঙ্গে অথবা অধ্যাপক ও সরমা দেবীর মধ্যে আলোচনা প্রসঙ্গে। এবং যার ফলে নাটকের গতি আবার। মোড় নিল। অর্থাৎ রঞ্জনবাবু বিনায়কবাবুকে সাহায্যই নয়—ঐ সুযোগে নিজের ভবিষ্যৎটাকে নতুন করে গড়ে তোলবারও আবার স্বপ্ন দেখতে লাগলেন আর সেই সঙ্গে নাটকের শেষ দৃশ্যও ঘনিয়ে আসতে লাগল। অধ্যাপক, বিনায়কবাবু, রাঘব সরকার ও রঞ্জন বোসকে নিয়ে নাটক ঘনীভূত হয়ে উঠল। চারজন লোকের পরস্পরের বিচিত্র স্বার্থে লাগল সংঘর্ষ—যে স্বার্থের কথা আমি এইমাত্র আপনাদের বললাম। যদি ভেবে দেখেন আপনারা তো দেখতে পাবেন ওঁদের মধ্যে একজনের অর্থাৎ অধ্যাপক বিমল চৌধুরীর সামাজিক প্রতিষ্ঠা ও সম্মান এবং রাঘব সরকারের শকুন্তলা লাভ ব্যতীত অন্য দুইজনের স্বার্থ ছিল অর্থ। এবং ঠিক সেই সময় ঘটল আর একটি বিচিত্র ব্যাপার নাটকের ঐ সঙ্গীন মুহূর্তেই ঐ বিচিত্র ব্যাপারটি ঘটল— বলতে বলতে কিরীটী থামল যেন হঠাৎ।