.
এই ঘরের মধ্যেই মাত্র কয়েকদিন আগে এক সন্ধ্যারাত্রে অধ্যাপক বিমলবাবু নিহত হয়েছেন নিষ্ঠুরভাবে, কিরীটী বলতে লাগল, এবং যিনি বা যাঁরা তাঁকে হত্যা করেছেন তিনি বা তারা যে কত বড় একটা ভুলের বশবর্তী হয়ে তাঁকে সেদিন হত্যা করেছিলেন সর্বাগ্রে আমি সেই কথাটাই বলব।
ভুল! শিবেনবাবু প্রশ্ন করেন।
হ্যাঁ ভুল, বলতে পারেন ট্র্যাজেডি অফ এররসও ব্যাপারটাকে।
কিরীটীর শেষের কথায় যেন স্পষ্ট মনে হল বিনায়ক সেন ঈষৎ চমকে কিরীটীর মুখের দিকে তাকালেন।
কিরীটীর কিন্তু ব্যাপারটা দৃষ্টি এড়ায়নি। সে মৃদু হেসে বলে, হ্যাঁ মিঃ সেন, যেগুলোর জন্যে আপনি এত কাণ্ড করেছেন—সেগুলো আসল বা রিয়াল জুয়েল নয়। সিথেটিক প্রডাক্টস্—কেমিক্যালে প্রস্তুত জুয়েস্! এবং আপনি জানেন না, বর্তমানে পুলিসের কর্তৃপক্ষের সেটা আর অগোচর নেই। ব্যাপারটা ধরে ফেলেছে এবং আজই সন্ধ্যায় তারা ইকনমিক জুয়েলার্স রেড করে মালসমেত রাঘব সরকারকে অ্যারেস্ট করেছে। খুব সম্ভবতঃ এতক্ষণে হি ইজ আণ্ডার পুলিস-কাস্টডি! আর তা যদি নাও হয়ে থাকে এখনো, অন্ততঃ কালকের সংবাদপত্রে দেখবেন নিউজটা প্রকাশ হয়েছে—
শিবেন সোমই প্রথমে কথা বললেন, রাঘব সরকারকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে মিঃ রায়? কিন্তু আমি তো—
না, আপনি জানেন না। আপনি কেন—একমাত্র এনফোর্সমেন্ট ব্রাঞ্চ-এর ডি. সি. মিঃ সিনহা ও আমি ছাড়া এখনো কেউই ব্যাপারটা জানে না। আমারই ইচ্ছাক্রমে ব্যাপারটা গোপন রাখা হয়েছে। এবং গোপন রাখা হয়েছিল রঞ্জনবাবু ও বিনয়বাবুর জন্যই। যাকগে সে কথা, আমি এবারে আমার আসল কাহিনীতেই আসি।
কিরীটী বলতে লাগল ও হত্যার পশ্চাতে কোন একটি বিশেষ কার্যকরণ বা উদ্দেশ্য না থাকলে কখনই হত্যা সংঘটিত হয় না। অধ্যাপক বিমলবাবুর হত্যার পশ্চাতে তেমনি একটি বিশেষ কারণ ছিল এবং বলতে আমার দ্বিধা নেই যার মূলে—অর্থাৎ এও বলা যেতে পারে ঐ হত্যার বীজ একদিন অধ্যাপক নিজেই বা নিজ হাতেই রোপণ করেছিলেন। অবিশ্যি সেটা তাঁর জ্ঞাতে নয়—অজ্ঞাতেই।
কি রকম? প্রশ্ন করেন শিবেনবাবু কিরীটীকে।
কিরীটী বলে, কোথায় কি ভাবে সঠিক বলতে পারি না তবে এটা ঠিক যে রাঘব সরকার ও অধ্যাপক বিমল চৌধুরীর মধ্যে একটা ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছিল। কারণ পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক বিমল চৌধুরীকে দিয়ে রাঘব সরকার ঐ সব সিনথেটিক জহরৎ তৈরী করাতেন তার নিজস্ব ল্যাবরেটারিতে। প্রথমটায় হয়তো অধ্যাপক ব্যাপারটা উপলব্ধি করতে পারেননি, কিন্তু যখন পারলেন তখন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে নিজের অজ্ঞাতেই নিজের জালে তখন তিনি জড়িয়ে পড়েছেন। সে জালের বাঁধন ছিঁড়ে তখন তার আর বের হয়ে আসার কোন রাস্তাই নেই। জগতের কাছে তার সম্মান ও পরিচয়টাই তাঁর মুখ বন্ধ করে রেখেছিল, আর তারই পূর্ণ সুযোগ নিল শয়তান রাঘব সরকার। রাঘব সরকারের কনফেসন থেকেই অবিশ্যি এ কথাগুলো আমি বলছি। যাই হোক, সে তো নাটকের প্রথম দৃশ্য—
একটু থেমে কিরীটী আবার বলতে লাগল, এবারে নাটকের দ্বিতীয় দৃশ্যে আসা যাক। বড়লোকের স্পয়ে চাইল্ড আমাদের রঞ্জনবাবু ইতিমধ্যে সর্বস্ব হারিয়ে মালয় থেকে এসে হাজির হলেন এখানে তার মামার আশ্রয়ে। রঞ্জনবাবুর ইচ্ছা ছিল তার মামার ঘাড় ভেঙে আবার ব্যবসার নাম করে কিছুদিন মজা লুটবেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য তার, অধ্যাপকের নিজের ঐ ভাগ্নেটিকে চিনতে দেরি হয় নি ফলে তিনি রঞ্জনের প্রস্তাবে সম্মত হতে পারেন না এবং অবশ্যম্ভাবী যা তাই ঘটে এক্ষেত্রেও। অতঃপর মামা-ভাগ্নের মধ্যে মন-কষাকষি শুরু হল। ইতিমধ্যে আর একটা ব্যাপার এ বাড়িতে ঘটেছিল। শয়তান রাঘব সরকারের নজর পড়েছিল শকুন্তলা দেবীর ওপরে। অধ্যাপক নিশ্চয় রাঘব সরকারের প্রস্তাবে চমকে উঠেছিলেন। এবং যদিচ রাঘব সরকারের প্রতি অধ্যাপক কোনদিনই বিশেষ প্রসন্ন ছিলেন না, যেটা শকুন্তলা দেবীর জবানবন্দী থেকেই আমরা জানতে পারি, অধ্যাপকের পক্ষে তথাপি সরাসরি রাঘব সরকারের প্রস্তাবটা নাকচ করা সম্ভবপর হয় নি হয়ত—অবিশ্যি এটা আমার অনুমান, অন্যথায় রাঘব সরকার অধ্যাপককে বিপদে ফেলতে পারে তার সঙ্গে তার গোপন যোগাযোগের কথাটা অর্থাৎ ঐ সিনথেটিক হীরের ব্যবসার কথাটা প্রকাশ করে দিয়ে। বেচারী অধ্যাপকের সাপের ছুঁচো গেলার মত অবস্থা হয়েছিল—মানে রাঘব সরকারের প্রস্তাবটা যেমন ফেলতে পারছিলেন না মন থেকে, তেমনি তার অশেষ স্নেহের পাত্রী শকুন্তলা দেবীকেও সব জেনেশুনে ঐ শয়তান রাঘবের হাতে তুলে দিতে পারছিলেন না। এদিকে শকুন্তলা দেবীর অবস্থাটাও সঙ্কটজনক হয়ে ওঠে। তার পক্ষেও যেমন অধ্যাপকের দিকটা অবহেলা করা সম্ভবপর ছিল না, তেমনি দুষ্মন্তকেও অস্বীকার করাটা সম্ভবপর ছিল না—তাই না শকুন্তলা দেবী?
হ্যাঁ, শকুন্তলা মৃদুকণ্ঠে এতক্ষণে কথা বললে, রাঘব সরকার কাকাকে আটিমেটাম দিয়েছিল এই মাসের পনেরো তারিখের মধ্যেই অর্থাৎ কাকার জন্মতিথি উৎসবের দশ দিনের মধ্যেই বিবাহের ব্যাপারটা চুকিয়ে না দিলে কাকার পক্ষে ভাল হবে না–
আর তাই আপনি ভয় পেয়ে আমার কাছে ছুটে গিয়েছিলেন, তাই নয় কি?
হ্যাঁ। আমার আর–
অন্য উপায় ছিল না। তা বুঝতে পারছি, কারণ সিথেটিক হীরার ব্যাপারটাও আপনি কোনক্রমে জেনেছিলেন—ঠিক কিনা শকুন্তলা দেবী?