ফিস ফিস করে কিরীটী পার্শ্বেই দণ্ডায়মান শিবেন সোমকে শুধাল, চাবিটা সঙ্গে আছে আপনার শিবেনবাবু?
কোন্ চাবি? শিবেন শুধায়।
অধ্যাপকের ঘরে যে তালা লাগিয়েছেন তার চাবি—
আছে।
আমাকে দিন।
শিবেন সোম পকেট থেকে চাবিটা বের করে কিরীটীর হাতে দিলেন।
সঙ্গে পিস্তল আছে আপনার?
আছে।
দিন আমাকে।
কোমরের বেল্ট-সংলগ্ন চামড়ার কেস থেকে পিস্তলটা খুলে অন্ধকারে কিরীটীর দিকে এগিয়ে দিলেন শিবেন সোম।
অতি সন্তর্পণে, প্রায় বলতে গেলে নিঃশব্দেই, কিরীটী হাতের চাবি দিয়ে অন্ধকারেই অধ্যাপকের ঘরের তালাটা খুলে ফেলল এবং ধীরে ধীরে দরজাটা খুলে বাঁ হাত বাড়িয়ে দরজার একেবারে গায়ে সুইচ-বোর্ডের আলোর সুইচটা টিপে দিল।
দপ করে ঘরের আলোটা জ্বলে উঠল এবং কিরীটীর কণ্ঠস্বর শোনা গেল—বজ্রকঠিন কণ্ঠস্বর, মিঃ সেন আপনার খেলা শেষ হয়েছে! উঁহু, আমি জানি আপনার পকেটে কিপকেটে হাত দেবার চেষ্টা করবেন না, আমার হাতের দিকে চেয়ে দেখুন—আমি প্রস্তুত হয়েই এসেছি।
সত্যি! ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে আমাদের সামনে বিনায়ক সেনই!
কিন্তু মুখে তার আর কোন কথাই নেই। একেবারে যেন বোবা।
নিষ্পলক দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন তখনো মিঃ সেন অর্থাৎ বিনায়ক সেন কিরীটীর মুখের দিকে।
আবার কিরীটী বলে, yes, thats like a good boy! এবং একটু থেমে আমাকে সম্বোধন করে বলে, সুব্রত, মিঃ সেনের পকেট থেকে বস্তুটি নিয়ে এসে তোমার জিম্মায় রাখো। মারাত্মক বস্তুকে সাবধানে রাখাই ভাল
সঙ্গে সঙ্গে আমি এগিয়ে গিয়ে বিনায়ক সেনের পকেট থেকে পিস্তলটা বের করে নিলাম।
দাও সুব্রত, শিবেনবাবুকে এবারে জিম্মা করে দাও ওটা।
পিস্তলটা অতঃপর আমি শিবেন সোমের হাতে তুলে দিলাম।
যাক, নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। মনের মধ্যে একটা ধুকপুকুনি নিয়ে কথাবার্তা কি হয়! কিন্তু সত্যি আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি মিঃ সেন, আপনি আমার ফোনের একটু আগের সতর্কবাণীটা সত্যি সত্যিই সিরিয়াসলি নিয়েছেন বলে!
বিনায়ক সেন কিন্তু পূর্ববৎ নির্বাক এবং দণ্ডায়মান।
কিরীটীর যেন সেদিকে কোন খেয়ালই নেই। সে বলেই চলে, বুঝতেই পারছেন মিঃ সেন, নেহাৎ অনন্যোপায় হয়েই শঠে শাঠ্যং নীতি মানে সামান্য ঐ চাতুরির আশ্রয়টুকু আমাকে নিতে হয়েছিল, অন্যথায় আপনার মত মহৎ ব্যক্তিকে এইভাবে রেড-হ্যাণ্ডেড ধরা স্বয়ং কিরীটী রায়েরও দুঃসাধ্য হত—কিন্তু আপনি দাঁড়িয়ে কেন—বসুন, প্লিজ বি সিটেড!
কিন্তু বিনায়ক সেন যেমন দাঁড়িয়ে ছিলেন তেমনিই দাঁড়িয়ে রইলেন। বসবার কোন ইচ্ছাই তার প্রকাশ পেল না।
.
২২.
কিরীটী মৃদু হাসল, বসবেন না? কিন্তু দাঁড়িয়ে থাকবেনই বা কতক্ষণ? আমার যে—
কিরীটীর কথাটা শেষ হল না, মধ্যবর্তী দ্বারপথে রঞ্জন বোস উঁকি দিল।
আরে রঞ্জনবাবু, আসুন আসুন—ঘরে আসুন!
রঞ্জন যেন একটু ইতস্তত করেই ঘরে প্রবেশ করল।
কি ব্যাপার কিরীটীবাবু? এত রাত্রে এসব কি?
কিরীটী রঞ্জনের প্রশ্নের কোন উত্তর না দিয়ে শিবেনের দিকে তাকিয়ে বললে, শিবেনবাবু, রঞ্জনবাবুর পকেটটাও একবার সার্চ করে নিন—নো রঞ্জনবাবু নো—দ্যাটস ব্যাড! আমি প্রস্তুত হয়েই আছি দেখছেন না হাতে আমার এটা কি! হ্যাঁ, দিয়ে দিন—
শিবেনবাবু রঞ্জনবাবুর পকেট থেকেও পিস্তলটা বের করে নিলেন।
ইয়েস, দ্যাটস্ গুড! দ্যাটস্ লাইক এ গুড বয়! নাউ বি সিটেড প্লিজ—কিরীটী হাসতে হাসতে বললে।
আকস্মিক ঘটনা-বিপর্যয়ে রঞ্জন বোসও যে বেশ একটু থতমত খেয়ে গেছে বুঝতে পারি।
রঞ্জনবাবু, কৌতূহল বড় বিশ্রী জিনিস! ধরা পড়লেন আপনি আপনার কৌতূহলের জন্যই—কিন্তু শিবেনবাবুর হাতে ধরা যখন পড়েছেন আর তো উপায় নেই—বসুন, না না—মিঃ সেনের অত কাছে নয়—একটু সরে দাঁড়ান—
রঞ্জন বিনায়ক সেনের কাছে এগিয়ে যাচ্ছিল, থেমে গেল।
মিঃ সেন, রঞ্জনবাবু—আপনারা দুজনেই উপস্থিত, এখন শকুন্তলা দেবী হলেই আমাদের কোরাম পূর্ণ হয়। শিবেনবাবু, পাশের ঘর থেকে শকুন্তলা দেবীকেও ডেকে আনুন।
শিবেন সোম সঙ্গে সঙ্গে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।
কিরীটী আমার মুখের দিকে চেয়ে মৃদু হেসে বলে, কি ভাবছ সুব্রত, এমন চমৎকার মিলনান্ত নাটক বহুদিন দেখোনি, না? বিধাতা-পুরুষের মত নাট্যকার সত্যিই দুর্লভ হে! কলম তাঁর নিখুঁত—এমন চমৎকার ছন্দ-যতি-মিল, এমন টেম্পো, এমন স্পীড়, এমন আঙ্গিক সত্যিই মানুষের কল্পনারও বুঝি বাইরে! বলতে বলতেই শিবেন সোমের সঙ্গে শকুন্তলা ঘরে ঢুকল।
এই যে মিস চৌধুরী, আসুন—কিরীটীই আহ্বান জানাল ওকে।
কেমন যেন বিহ্বল দৃষ্টিতে ঘরের মধ্যে ঐ মুহূর্তে উপস্থিত সকলের দিকে একবার দৃষ্টিটা বুলিয়ে নিয়ে সর্বশেষে দৃষ্টিপাত করল শকুন্তলা কিরীটীর মুখের উপরে নিঃশব্দে।
বসুন মিস্ চৌধুরী, আমিই আপনাকে ডেকে পাঠিয়েছিলাম—বসুন।
শকুন্তলা আবার ঘরের মধ্যে উপস্থিত সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে উপবেশন করল একটা চেয়ারে।
শকুন্তলার মুখের দিকে চেয়ে মনে হল যেন প্রচণ্ড ঝড় বয়ে গিয়েছে ওর উপর দিয়ে। সমস্ত মুখে একটা দুঃসহ ক্লান্তি ও বিষণ্ণতার সুস্পষ্ট প্রকাশ। চোখের কোলে কালি, মাথার চুল বিস্ত। পরে অবিশ্যি শিবেনবাবুর মুখেই শুনেছিলাম—তিনি যখন শকুন্তলার ঘরে গিয়ে প্রবেশ করেন, দেখেন সে আলো জ্বেলে ঘরের মধ্যে একটা চেয়ারে স্তব্ধ হয়ে বসেছিল।