কি?
হত্যার আসল কারণটা কি ছিল? অথ বিবাহঘটিত না অর্থম অনর্থম? শেষ মাইলস্টোনএ পৌঁছবার পূর্বে ঐ তিনটি পয়েন্ট নিজের কাছে নিজে ক্লিয়ার করে নিতে হবে।
শিবেন সোম একেবারে চুপ।
২১-২৫. শুধু শিবেন সোমই কেন
শুধু শিবেন সোমই কেন, আমিও যেন বোবা হয়ে যাই। কি বলব বা অতঃপর কি বলা উচিত বুঝে উঠতে পারি না।
হঠাৎ স্তব্ধতা ভঙ্গ করে কিরীটী আবার কথা বললে, কিন্তু একটু আগে না আপনি কি জটিল এক সমস্যার কথা বলছিলেন শিবেনবাবু!
জটিল সমস্যা? হ্যাঁ—সকাল থেকে এদিকে রঞ্জনবাবু—
কি? কি হল তার আবার?
সে উধাও!
বলেন কি? সঙ্গে সঙ্গে কথাটা বলতে বলতে যেন কিরীটী সোফার উপরে সোজা হয়ে বসে।
হ্যাঁ, সকালবেলা থেকেই তার কোন পাত্তা পাওয়া যাচ্ছে না।
কেন—কেন আপনি এতক্ষণ এ-কথাটা আমাকে বলেননি? সঙ্গে সঙ্গে সোফা থেকে উঠে কিরীটী সোজা ঘরের কোণে রক্ষিত ত্রিপয়ের উপরে ফোনের সামনে গিয়ে দাঁড়াল এবং রিসিভারটা তুলে ডায়েল শুরু করে, হ্যালো, ডি. সি. মিঃ সিন্হাকে দিন–
অতঃপর শুনতে লাগলাম ফোনে ডি. সি.-কে রঞ্জনের নিখুঁত চেহারার বর্ণনা দিয়ে সর্বত্র রেলওয়ে স্টেশনে স্টেশনে তাকে খোঁজ করবার জন্য অবিলম্বে জরুরী মেসেজ পাঠাবার ব্যবস্থা এবং ফোন শেষ করে ফিরে এসে বললে, রাত এখন পৌনে দশটা—চলুন, আর দেরি নয় শিবেনবাবু—এখুনি আমাদের একবার বেলগাছিয়ায় অধ্যাপক-ভবনে যেতে হবে!
দশ মিনিটের মধ্যে আমরা শিবেনবাবুর গাড়িতে করেই বেলগাছিয়ার উদ্দেশে বের হয়ে পড়লাম। চলন্ত গাড়িতে বসে কিরীটী আবার বললে, বড্ড দেরি হয়ে গেল শিবেনবাবু। রঞ্জন বোস অনেকটা টাইম পেয়ে গেল—
কিন্তু আমিও চুপ করে বসে ছিলাম না কিরীটীবাবু, আমি দুপুরেই তার সন্ধানে চারিদিকে লোক পাঠিয়েছি—
আপনি পাঠিয়েছিলেন?
পাঠিয়েছি বৈকি!
উঃ, বড় একটা ভুল হয়ে গেল! হঠাৎ বলে কিরীটী।
ভুল?
হ্যাঁ, একটা জরুরী—অত্যন্ত জরুরী ফোন করার প্রয়োজন ছিল একজনকে, তাড়াতাড়িতে ভুল হয়ে গেল।
সামনেই তো সেন্ট্রাল টেলিগ্রাফ অফিস পড়বে, ঐখান থেকেই তো ফোন করতে পারেন!
ঠিক বলেছেন, ওখানে একটু দাঁড়াবেন।
পথেই একটু পরে সেন্ট্রাল টেলিগ্রাফ অফিসে গাড়ি থেকে নেমে কিরীটী ফোন করে মিনিট পনেরো বাদে আবার ফিরে এল গাড়িতে। শিবেনবাবু শুধান, ফোন করলেন?
হ্যাঁ।
কাকে ফোন করলেন?
হত্যাকারীকে।
সে কি!
হ্যাঁ আমার অনুমান, যাকে আমি ফোন করলাম তিনিই আমাদের বিমল-হত্যারহস্যের মেঘনাদ!
কিন্তু–
আহা ব্যস্ত হচ্ছেন কেন। চক্ষুকর্ণের বিবাদ তো অনতিবিলম্বেই ভঞ্জন হবে—কিন্তু বড় চায়ের পিপাসা পাচ্ছে, কোথাও এক কাপ চা পাওয়া যায় না?
বেন্টিঙ্ক স্ট্রীটের মোড়ে একটা চীনা রেস্টুরেন্ট আছে—সেখানে পেতে পারেন।
তা হলে চলুন সেই দিকেই। তৃষ্ণা নিয়ে কোন মহৎ কাজ করতে যাওয়া ভাল নয়। মনটা তাতে করে উৎক্ষিপ্ত থাকবে।
পথে চা-পান করে আমরা যখন বেলগাছিয়ার অধ্যাপক-ভবনে এসে পৌঁছলাম রাত তখন ঠিক এগারোটা বেজে দশ। যদিও গ্রীষ্মকালের রাত্রি এবং বেলগাছিয়া বৃহত্তর কলকাতারই বিশেষ একটি অংশ, তবু ঐদিকটা ইতিমধ্যে যেন শান্ত হয়ে এসেছে।
পানের দোকান ও ডাক্তারখানাগুলো ছাড়া রাস্তার সব দোকানই প্রায় দু-পাশের বন্ধ হয়ে গিয়েছে। মানুষজনের চলাচলও কমে এসেছে।
লাস্ট ট্রাম চলে গিয়েছে, তবে ডিপোমুখী ট্রামগুলো তখনো এক এক করে ফিরে আসছে এবং সে-সব ট্রামে যাত্রী একপ্রকার নেই বললেও অত্যুক্তি হয় না।
.
কিরীটীর নির্দেশে অধ্যাপক-ভবনের কিছু দূরেই গাড়িটা দাঁড় করানো হয়েছিল। আমরা পায়ে হেঁটে কজন অধ্যাপক-ভবনের দিকে অগ্রসর হলাম। আকাশে সেরাত্রে একফালি চাদ ছিল, তারই মৃদু আলোয় প্রকৃতি যেন স্বপ্নময় মনে হয়।
হঠাৎ নজরে পড়ল অধ্যাপকের বাড়ির দোতলায় আলো জ্বলছে। নীচের তলাটা কিন্তু অন্ধকার।
গেট দিয়ে গিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলাম।
বারান্দা বরাবর গিয়েছি, অন্ধকারে প্রশ্ন ভেসে এল, কে?
জবাব দিল কিরীটী, রামচরণ, আমরা!
রায়বাবু? আসুন–রামচরণ এগিয়ে এল।
তুমি তা হলে এখানেই আছ রামচরণ?
আজ্ঞে, সেরাত্রে তো আপনি তাই বলেছিলেন। সকালেই ফিরে এসেছি আপনার আজ্ঞামত–
ঠিক করেছ। তোমার মার খবর কি রামচরণ?
আজ্ঞে তিনি আমার ভাইপোর ওখানেই আছেন।
এঁরা খোঁজেনি তোমার মাকে?
খুঁজেছিলেন। বোধ হয় পুলিসেও ছোটবাবু খবর দিয়েছেন।
রঞ্জনবাবু ফিরেছেন?
এই কিছুক্ষণ হল ফিরে এসেছেন—
ফিরেছেন?
আজ্ঞে।
কোথায়?
বোধ হয় নিজের ঘরে।
কিরীটী অতঃপর মুহূর্তকাল যেন কি ভাবল, তারপর বললে, তোমার দিদিমণি?
আপনি জানেন না, পুলিস তো তাকে ছেড়ে দিয়েছে—তিনিও বাড়িতেই আছেন।
রঞ্জনবাবু শুনেছেন সে-কথা?
বলতে পারি না।
আচ্ছা ঠিক আছে। আমরা একবার ওপরে যাব। তুমি এখানেই থাকো রামচরণ, যেমন তোমাকে আমি নজর রাখতে বলেছিলাম তেমনি নজর রাখো।
যে আজ্ঞে। রামচরণ বিনীত কণ্ঠে সম্মতি জানায়।
আমরা এগুতেই রামচরণ পিছন থেকে শুধায়, আলোটা সিঁড়ির জ্বেলে দেব রায়বাবু?
না না—আলোর দরকার নেই, আমরা অন্ধকারেই যেতে পারব।
রাস্তা থেকে যে আলোটা আমাদের চোখে পড়েছিল, সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে বুঝতে পারলাম সেটা শকুন্তলার ঘরের আলো।
কিরীটী সেই দিকেই অর্থাৎ শকুন্তলার ঘরের দিকেই অগ্রসর হচ্ছিল কিন্তু হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল, সঙ্গে সঙ্গে আমরাও দাঁড়াতে বাধ্য হলাম।