কি?
দেওয়াল-ঘড়ির দিকে তাকাল কিরীটী, রাত পৌনে দুটো এখন, ঠিক পৌনে পাঁচটায় মানে আর তিন ঘণ্টা পরেই আমরা বের হয়ে পড়ব। আপনাকে কালকের জন্য যেমন যেমন বলেছিলাম ফোনে তেমন তেমন ব্যবস্থা সব করে রেখে দিয়েছেন তো?
হ্যাঁ, কিন্তু শকুন্তলা—তাকে কি ছেড়ে দেব?
পাগল হয়েছেন! এখন তাকে ছেড়ে দিলে তাকে বাঁচাতে পারবেন না—
বাঁচাতে পারব না?
না। কারণ সে-ই যে একমাত্র সাক্ষী সেদিন রাত্রের নৃশংস সেই হত্যার ব্যাপারের!
বলেন কি? সে তা হলে সব জানে?
জানে। তবে—
তবে? এইটুকুই কেবল জানে না—লোকটা কে—আসলে কে সে, কারণ ঘর অন্ধকার ছিল—
শকুন্তলা তা হলে জানে!
জানবেই তো, সে যে তখন রঞ্জনের ঘরে ছিল—
রঞ্জনের ঘরে!
হ্যাঁ। অথচ রঞ্জন সেটা ঘুণাক্ষরেও সেদিন যেমন জানতে পারেনি, তেমনি আজও জানে না।
তবে কি—সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে শিবেন তাকালেন কিরীটীর মুখের দিকে।
কিন্তু কিরীটী যেন পরমুহূর্তেই শিবেনের সমস্ত উৎসাহ করে একটা ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দিল। একটা হাই তুলতে তুলতে বললে, এখনো হাতে প্রায় ঘণ্টা-তিনেক সময় আছে বড্ড ঘুম পেয়েছে—আমি একটু ঘুমিয়ে নিই।
কথাটা বলে এবং কাউকে কথা বলার দ্বিতীয় অবকাশমাত্রও না দিয়ে সোজা ঐ ঘর থেকে বের হয়ে কিরীটী নিজের শয়নঘরের দিকে পা বাড়াল।
আমরা তিনটি প্রাণী যেন একটা দুর্বোধ্য প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে বিমূঢ় বিহ্বল হয়ে বসে রইলাম। বিশেষ করে শিবেন সোম।
প্রথমে কথা বললেন শিবেন সোমই, সুব্রতবাবু, কিছুই তো বুঝতে পারলাম না!
আমার মনের অন্ধকারটা ততক্ষণে কাটতে শুরু হয়েছে, অন্ধকারে বেশ আলো দেখতে পাচ্ছি।
আমি ওঁর মুখের দিকে তাকালাম, কিছু বলছিলেন মিঃ সোম?
বলছিলাম, তা হলে কি হল? কিছু বুঝতে পারছেন আপনি?
আমার কাছ থেকে আর কেন শুনবেন—হয়তো বলতে গিয়ে জট পাকিয়ে ফেলব, ও তো বলেই গেল ঘণ্টা-তিনেক বাদেই বোধ হয় সব জানতে পারবেন কিন্তু কৃষ্ণা, এবারে একটু চা হলে মন্দ হত না বোধ হয়!
কৃষ্ণা ঘর থেকে উঠে গেল নিঃশব্দে।
.
পৌনে পাঁচটা নয়, বেরুতে আমাদের প্রায় পাঁচটা হয়ে গেল।
কিরীটীর গাড়িতে চেপেই আমরা চলেছিলাম আমাদের গন্তব্যস্থলে। হীরা সিং গাড়ি চালাচ্ছিল।
শিবেন সোম আর নিজেকে চেপে রাখতে পারেন না, প্রশ্ন করেন, কিন্তু কোথায় আমরা যাচ্ছি কিরীটীবাবু? বেলগাছিয়ায় কি?
না। কিরীটী মৃদুকণ্ঠে বলে।
তবে কোথায়?
বিনায়ক সেনের ওখানে, শ্যামবাজারে।
সেখানে-সেখানে কেন?
গেলেই জানতে পারবেন।
.
যাই হোক, বিনায়ক সেনের গৃহে, রামধন মিত্র লেনে, যখন গিয়ে আমরা পৌঁছলাম সকাল সাড়ে পাঁচটা। সবে ভোর হয়েছে বলা চলে।
সুন্দর তিনতলা সাদা রঙের বাড়িটি। দারোয়ান সবে তখন গেট খুলেছে। গাড়ি নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে দারোয়ানকে দিয়েই ভিতরে সংবাদ পাঠানো হল।
একজন ভৃত্য এসে আমাদের বাইরের ঘরে নিয়ে গিয়ে বসতে দিল। শুনলাম বিনায়ক সেন তখনো ঘুম থেকে ওঠেননি। একটু বেলা করেই নাকি ওঠেন।
ভৃত্যকে বলা হল বাবুকে তুলে দেবার জন্য। কথাটা কিরীটীই বললে।
ভৃত্য প্রথমে বোধ হয় একটু আপত্তি জানাবার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু কিরীটীর মুখের দিকে চেয়ে শেষ পর্যন্ত কি জানি কেন সে আর না করতে পারল না। ভিতরে চলে গেল।
এবং মিনিট পনেরোর মধ্যেই একটা স্লিপিং গাউন গায়ে চাপিয়ে ঘাসের চটি পায়ে ঘরে এসে প্রবেশ করলেন বিনায়ক সেন।
ঘরে ঢুকেই যেন থমকে দাঁড়ালেন। কয়েকটা মুহূর্ত যেন বোবা। তারপর ক্ষীণকণ্ঠে বললেন কেবল, আপনারা!
হা মিঃ সেন, বসুন। বলা বাহুল্য কিরীটীই কথা বললে, এবং কেন যে এ সময় এসেছি তাও নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন–
একটা সোফায় মুখোমুখি বসতে বসতে বিনায়ক সেন বললেন, না। কিন্তু কি ব্যাপার বলুন তো?
কিন্তু বোঝা উচিত ছিল আপনার অন্তত মিঃ সেন!
বোঝা উচিত ছিল?
হ্যাঁ। শুনুন মিঃ সেন, আপনি বোধ হয় শুনেছেন—
কি?
শকুন্তলা অ্যারেস্টেড!
সে কি! চমকে ওঠেন বিনায়ক সেন।
হ্যাঁ, তাকে অ্যারেস্ট করা হয়েছে—অথচ সে নির্দোষ—
আমি–আমি কি করে তা জানব?
সে কি কথা, নিজের সন্তানকে আপনি জানেন না—
কি বললেন? অকস্মাৎ যেন চমকে উঠলাম কিরীটীর কথায়।
হ্যাঁ মিঃ সেন, সুনন্দা আমাদের সব বলেছে—
সুনন্দা!
হ্যাঁ সুনন্দা। যে আজো জীবিত আছে জানতে পেরে সেদিন সন্ধ্যায় তার সঙ্গে বিমলবাবুর গৃহে আপনি গোপনে দেখা করতে গিয়েছিলেন–
কি বলছেন আবোল-তাবোল সব আপনি কিরীটীবাবু?
সত্যকে আর গোপন করবার চেষ্টা বৃথা বিনায়কবাবু। সত্য সব প্রকাশ হয়ে পড়েছে। আপনার দুষ্কৃতি আর গোপন নেই। শান্ত মৃদু কণ্ঠে কিরীটী কথাগুলো বললে।
আমি—
কিন্তু আপনার নিজের আত্মজা শকুন্তলা জেনেও কি করে এত বড় অন্যায়টা করতে গিয়েছিলেন মিঃ সেন?
অন্যায়!
নিশ্চয়ই। আপনার মেয়ে শকুন্তলা দুষ্মন্তকে ভালবাসে জেনেও রাঘবের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে তারই হাতে শকুন্তলাকে তুলে দেবার চেষ্টা করতে আপনার এতটুকু দ্বিধা হল না?
না না—
হ্যাঁ। আর কেন যে আপনি ঐ ঘৃণ্য কাজ করতে দ্বিধা করেননি তাও আমি জানি। ফিল্ম বিজনেস-এ আপনার গত কয় বছর ধরেই শোচনীয় অবস্থা চলেছে, তাই রাঘব সরকার জোচ্চুরি করে সিনথেটিক হীরা আসল হীরা বলে চালাচ্ছে জেনেও, সে আপনাকে ফাইনানসিয়ালি সাহায্য করছিল বলে তার বদলে শকুন্তলাকে সেই শয়তানটার হাতে তুলে দেবার ষড়যন্ত্রে আপনি লিপ্ত হয়েছিলেন। কারণ আপনি জানতেন আপনার বাল্যবন্ধু অধ্যাপক বিমলবাবু গোপনে বিধবা কুলতাগিনী সুনন্দা অর্থাৎ সরমাকে বিবাহ করেছিল সেই কথাটা প্রকাশ হয়ে পড়লে বিমলবাবু সমাজে আর মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবেন না। তাই তার পক্ষে বাধা দেওয়াও সম্ভব নয়—