উৎসব?
হ্যাঁ, কাকামণির জন্মতিথি উৎসব। প্রতি বৎসর ঐ দিনটিতে উৎসব হয়—তার সব পরিচিত আত্মীয় বন্ধুবান্ধবেরা আসেন আর আমাকেই সব ব্যবস্থা করতে হয়। পরশু আসতে পারি—
তবে তাই আসবেন।
অতঃপর শকুন্তলা নমস্কার জানিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
.
০২.
শকুন্তলা ঘর থেকে বের হয়ে যাবার পর কিরীটী যেন একটু ক্লান্ত ভাবেই সোফায় হেলান দিয়ে চোখ বুজল এবং কয়েকটা মুহূর্ত চুপ করে থেকে যেন একেবারে প্রায় নিঃশব্দ কণ্ঠে বললে, আশ্চর্য!
একটু যেন চমকেই ওর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম, কিছু বলছিস?
হ্যাঁ, ভাবছি—
কি?
ভাবছি মেয়েটি নিজেই এসেছিল আমার কাছে না কেউ পাঠিয়েছিল ওকে!
ও-কথা কেন বলছিস কিরীটী?
বলছি এই কারণে যে, আংটির অনুমানটা যদি আমার সত্যিই হয় তো—চমৎকার অভিনয় করে গেল মেয়েটি স্বীকার করতেই হবে।
অভিনয়!
হ্যাঁ, মেয়েরা অবিশ্যি আমার মতে সবাই, বলতে গেলে বেশীর ভাগই, জাত-অভিনেত্রী এবং জীবনের সর্বক্ষেত্রেই তাদের অভিনয়টাই সত্যি এবং বাকি যা তা মিথ্যা; কিন্তু তাদের মধ্যেও আবার কেউ কেউ অনন্যসাধারণ থাকে তো–
তার মানে তুই বলতে চাস, ঐ শকুন্তলা মেয়েটি সেই শেষোক্ত পর্যায়ে পড়ে?
কিছুই আমি বলতে চাই না কারণ একটু আগেই তো বললাম ব্যাপারটাই আমার অনুমান মাত্র; কিন্তু শ্রীমান জংলীর ব্যাপারটা কি? সে কি আজ আমাদের চা-উপবাসীই রেখে দেবে স্থির করেছে নাকি?
কিন্তু কিরীটীর কথা শেষ হল না, ট্রেতে ধূমায়িত কাপ নিয়ে জংলী এসে ঘরে ঢুকল।
কি রে চা এনেছিস?
আজ্ঞে না।
আজ্ঞে না মানে! তবে ঐ কাপে কি?
ওভালটিন। জংলী বললে।
সত্যিই সুব্রত, চায়ের কাপের দিকে আদৌ হাত না বাড়িয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললে কিরীটী এবারে, আমার স্বাস্থ্য ও তার রক্ষণাবেক্ষণ সম্পর্কে হঠাৎ যে মাঝে মাঝে কৃষ্ণা অতি-সচেতন হয়ে ওঠে—চায়ের বদলে সরবত বা ওভালটিনের অত্যাচার
অসহ্য! কথাটা শেষ করল কৃষ্ণা।
না, মানে কৃষ্ণা তুমি—
হস্তধৃত কাচের প্লেটটা এগিয়ে দিতে দিতে মৃদু হাস্য সহকারে কৃষ্ণা এবারে বলে, ওভালটিনের সঙ্গে টোমাটোর পাঁপড় খেয়ে দেখো, সত্যি ডেলিসাস!
অবনক্সাস! মৃদু গম্ভীর কণ্ঠে বলে কিরীটী।
কি বললে? প্রশ্ন করে কৃষ্ণা।
বললাম ওটা পাঁপড়ও নয় টোমাটোরও নয়। সামথিং ক্যাডাভারাস লাইক ইয়োর মডার্ণ সো-কল্ড আপ-টু-ডেট সোসাইটি! অর্থাৎ সুকুমার রায়ের গজকচ্ছপেরই একটা সংস্করণ মাত্র।
কথাগুলো কিরীটী গম্ভীর হয়ে বলল বটে তবে দুটোই অর্থাৎ ওভালটিন ও পাঁপড় টেনে নিয়ে নির্বিবাদে সদ্ব্যবহার করতে শুরু করে দিল।
তার পর ঐ ব্যাচিলার ভদ্রলোকটিকে কি সারমন দেওয়া হচ্ছিল শুনি নারী সম্পর্কে। কিরীটীর দিকে চোখ পাকিয়ে প্রশ্নটা করে কৃষ্ণা।
কই না, নারী সম্পর্কে তো নয়, আমি তো বলছিলাম অভিনেত্রী সঙ্রে কথা।
অভিনেত্রী সঙ্ঘ!
হুঁ, মানে যারা এই আর কি অভিনয়ই করে। কথাটা চোখ বুজেই একটা পাপড়ের টুকরো আরাম করে চিবুতে চিবুতে কিরীটী বললে।
শুধু নিশ্চয়ই নারী অভিনেত্রীদের কথা নয়—পুরুষ অভিনেতাদের কথাও বলছ! কৃষ্ণা শুধায়।
য়্যাঁ, কি বললে? চোখ মেলে তাকায় কিরীটী।
বলছিলাম চমৎকার অভিনয় করতে পারে এমন তো শুধু নারীই নয়, পুরুষও আছে।
দুজনের–স্বামী ও স্ত্রীর পরস্পরের কৌতুকপূর্ণ অথচ বুদ্ধিদীপ্ত কথার লেনদেন শুনতে আমি বেশ উপভোগই করছিলাম।
সহসা ঐ সময় কিরীটী বলে উঠল, সন্দেহ নেই, সন্দেহ নেই তাতে। কিন্তু প্রিয়ে, অভিনয়শিল্পে নারীর স্থান যে একটু বিশেষ স্তরেই, নিশ্চয়ই কথাটা অস্বীকার করবে না?
নিশ্চয়ই করব।
বেশ। তবে তিষ্ঠ ক্ষণকাল। এবারে সত্যিই তোমাকে শ্রীকৃষ্ণ যে মোহিনী রূপ ধারণ করে সমস্ত দেবাসুরের মাথাটা ঘুরিয়ে দিয়েছিল সেই মোহিনী রূপের অভিনয় মহিমা তোমাকে দেখাব। কিন্তু আমাকে একটিবার বেরুতে হবে—
কথাটা বলতে বলতে কিরীটী উঠে দাঁড়ায় এবং সোজা গিয়ে তার শয়নঘরের সংলগ্ন তার একান্ত নিজস্ব যে প্রাইভেট কামরাটি তার মধ্যে প্রবেশ করে ভিতর থেকে অর্গল তুলে দিল টের পেলাম।
.
সেই কামরা থেকে বের হয়ে এল যখন, সম্পূর্ণ ভোল একেবারে পাল্টে ফেলেছে কিরীটী।
মুসলমানী চোস্ত পাজামা ও গায়ে শেরওয়ানী। মাথায় কালো টুপী। হাতে একটা ছোট চামড়ার কেস। মুখে ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি। চোখে কালো চশমা।
কি ব্যাপার, হঠাৎ এ বেশ কেন? প্রশ্ন করলাম আমিই।
একটু সওদা করে আসি।
সওদা কিসের?
জহরতের। বলেই আমাকে তাড়া দিল, চল্ ওঠ—
কোথায়?
বললাম তো সওদা করে আসা যাক। ওই—আবার তাড়া দিল কিরীটী।
কিন্তু তবু উঠতে আমি ইতস্ততঃ করি।
কি রে, এর মধ্যেই গেঁটে বাত ধরল নাকি? ওঠ—
অগত্যা উঠে দাঁড়াই।
রাস্তায় এসে ওর পাশে চলতে চলতে আবার পূর্বোক্ত প্রশ্নটাই করলাম, কিন্তু এই অসময়ে সত্যি কোথায় চলেছিস বল্ তো কিরীটী!
অসময় আবার কোথায়, মাত্র পৌনে আটটা রাত। আর একান্ত দেখা যদি নাই করে তো ফিরে আসব। তার বেশী তো কিছু নয়। তবু অন্তত একটু বেড়ানোও তো হবে।
তা যেন হবে, কিন্তু কার সঙ্গে দেখা করতে চলেছিস এ সময় হঠাৎ?
হঠাৎ আবার কোথায়! এই ট্যাক্সি-ইধার! কথাটা শেষ করল কিরীটী রাস্তার ওধারে গিয়ে, আমাদের দিকেই যে খালি ট্যাক্সি যাচ্ছিল সেই ট্যাক্সিটা ডেকে।