ঢং করে ঐ সময় দেওয়াল-ঘড়িতে সাড়ে বারোটা রাত্রি ঘোষণা করল।
না, সত্যি রাত অনেক হয়ে গেল—কিরীটী একটু যেন ব্যস্ত হয়েই ওঠে সরমার মুখের দিকে তাকিয়ে, চলুন, আমিই আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসি—
আপনাকে ব্যস্ত হতে হবে না কিরীটীবাবু। তাছাড়া কোথায় আপনি আমাকে পৌঁছে দেবেন? হ্যাঁ, আমি তো সেখানে আর ফিরে যাচ্ছি না—
ফিরে যাচ্ছেন না।
না, সেখানে আর নয়। আজকের মতই একদিন অসহায় আমার হাত ধরে সেখানে নিয়ে গিয়ে তার আশ্রয়ে আমাকে যে আশ্রয় দিয়েছিল, আজ সে-ই যখন নেই তখন আর কোন্ ভরসায় সেখানে থাকব বলতে পারেন! আর কোন্ দুঃসাহসেই বা থাকব! না কিরীটীবাবু, পৃথিবীতে বিশ্বাস বস্তুটা এমনই জিনিস যে একবার তার মূলে ভাঙন ধরলে আব কোন কিছুতেই তাকে টিকিয়ে রাখা যায় না। হুড়মুড় করে শেষ পর্যন্ত নিজের ঘাড়ের ওপরেই ভেঙে পড়ে। না কিরীটীবাবু, আর সেখানে কোনদিন ফিরব না বলে স্থির করেই এক বস্ত্রে বেরিয়ে এসেছি–
কিন্তু কোথায় যাবেন?
কোথায় যাব জানি না, কিন্তু সেদিন যে দুশ্চিন্তাটা নবজাত এক শিশুর মা হয়ে সরমার বুকের মধ্যে ছিল আজ তো সে দুশ্চিন্তাটা আর তার বুকের মধ্যে নেই। আজ আর ভয় কি যেদিকে দুচোখ যায় চলে যাব।
অকস্মাৎ যেন সরমার মধ্যে একটা আমূল পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে। হঠাৎ একটা পাথর যেন ফেটে চৌচির হয়ে গিয়েছে। এক নিমেষে সমস্ত কুণ্ঠা সমস্ত দ্বিধার অবসান ঘটেছে।
বিস্মিত দৃষ্টিতে দরজার মধ্যবর্তী ফাঁক দিয়ে দেখছিলাম সরমার মুখের দিকে তাকিয়ে।
কিন্তু সরমা দেবী, আপনি আমাকে কথা দিয়েছিলেন এ ব্যাপারে একটা হেস্তনেস্ত না হওয়া পর্যন্ত আপনি ও-বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাবেন না! কিরীটী এবারে বললে।
হ্যাঁ দিয়েছিলাম, মনে আছে। আর সেটাই তো এখানে এত রাত্রে আসবার আমার দ্বিতীয় কারণ কিরীটীবাবু!
শান্ত মৃদু কণ্ঠে কথাগুলো বললেন সরমা দেবী এবং যাবার জন্যই বোধ করি অতঃপর উঠে দাঁড়ালেন, আমি তা হলে এবারে যাই!
না সরমা দেবী, তা হয় না। আমাকে কথা দিয়ে আপনি কথা রেখেছেন বলে ধন্যবাদ জানাচ্ছি, কিন্তু আজ আর একজনকে না জানিয়েও তো কোথাও এভাবে চলে যাবার আপনার অধিকার নেই।
কিরীটীবাবু!
আপনার মেয়ে শকুন্তলা—তার প্রতি কি আর আপনার কোন কর্তব্যই অবশিষ্ট নেই? তাকে আপনি কার কাছে রেখে যাচ্ছেন?
আমি জানি কিরীটীবাবু, সে দুষ্মন্তকে ভালবাসে আর দুষ্মন্তও তাকে ভালবাসে—দুষ্মন্তই তাকে আশ্রয় দেবে। বরং আমি থাকলেই তার সেই নিশ্চিন্ত আশ্ৰয়টা ভেঙে যাবার সম্ভাবনা আছে–
তা আছে কিনা জানি না, তবে রাঘব সরকারের কথাটাই বা ভুলে যাচ্ছেন কেন?
রাঘব।
হ্যাঁ–
মৃদু অথচ অতিশয় করুণ হাসির একটা আভাস যেন সরমার ওষ্ঠপ্রান্তে জেগে ওঠে। এবং হাসিটা মিলিয়ে যাবার পরক্ষণেই সমস্ত মুখখানি যেন কঠিন হয়ে ওঠে।
সরমা দেবী!
নিশ্চিন্ত থাকুন, সে এখনো জানে না যে তার মৃত্যুবাণ আমারই হাতে রয়েছে!
মৃত্যুবাণ?
হ্যাঁ। আমি এবারে যাই—
কিন্তু সরমা দেবী, একটা কথা—আপনাকে হয়তো আমার প্রয়োজন হবে এবং অন্য কোন কারণে নয়—আপনার মেয়ে শকুন্তলাকে বাঁচানোর জন্যই, তখন কোথায় আমি আপনাকে পাব?
আমি রামচরণের সঙ্গেই থাকব।
রামচরণ!
হ্যাঁ, আমার ধর্ম-ছেলে। আমি তার ধর্ম-মা।
আপনি তা হলে এখন তার দেশের বাড়িতেই যাচ্ছেন?
, বসিরহাটে তার ছেলে, ছেলের বৌ আছে—সেখানেই আপাততঃ কিছুদিন থাকব আমি। তা হলে চলি—
চলুন, আপনাকে নীচে পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসি।
সরমা আগে ও পিছনে কিরীটী বের হয়ে গেল ঘর থেকে।
আমরাও পুনরায় ঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করলাম।
একটু আগে ঘরের মধ্যে যেন একটা নাটক অভিনীত হয়ে গিয়েছে এবং তার সুরটা ঘরের বাতাসে যেন এখনো ছড়িয়ে রয়েছে।
.
১৮.
সরমাকে বিদায় দিয়ে কিরীটী পুনরায় ঘরে ফিরে এল।
ক্ষণপূর্বে নাটকের দর্শক ও শ্রোতা আমরা তখন যেন বিমূঢ় নির্বাক হয়ে ঘরের মধ্যে বসে। আছি।
কিরীটী ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে, কিন্তু বসল না—পূর্বেরই সেই খোলা জানালাটার সামনে গিয়ে বাইরের অন্ধকারে দৃষ্টি মেলে দাঁড়িয়ে রইল। তারপরও কিছুক্ষণ একটা যেন জমাট স্তব্ধতার মধ্যেই আমাদের কেটে গেল।
মনে হচ্ছিল কারোর যেন কিছু আর বলবার নেই। সবারই কথা যেন শেষ হয়ে গিয়েছে। নাটক শেষ হয়ে গিয়েছে, যবনিকা নেমে এসেছে, শূন্য প্রেক্ষাগৃহে যেন কজন আমরা বসে আছি।
প্রথমে সেই স্তব্ধতা ভঙ্গ করে কৃষ্ণাই কথা বললে, সরমা চলে গেল?
কৃষ্ণার ডাকে কিরীটী ওর দিকে ফিরে তাকাল, হ্যাঁ, চলে গেল।
আচ্ছা একটা কথা আমি বুঝতে পারছি না এখনো—
কি?
শকুন্তলার বাপ তা হলে কে?
জন্ম যখন তার হয়েছে—সরমা যখন তার মা-বাপও তার একজন আছে বৈকি কৃষ্ণা।
কিন্তু কথাটা ওকে তুমি জিজ্ঞাসা করলে না কেন?
ছিঃ কৃষ্ণা! তাই কি পারি? মেয়েমানুষ হয়েও কি বুঝতে পারো না, মেয়েমানুষের জীবনে এ কত বড় লজ্জা! তাছাড়া হৃদয়হীনতার কি একটা সীমা নেই!
কিন্তু–
না। তাছাড়া তোমাদের চোখ আর মন থাকলে শকুন্তলার বাপের সংবাদটা পেতে তোমাদেরও দেরি হত না। যাক সে কথা। তার জন্ম-বৃত্তান্তটা যখন প্রকাশ হয়েছে, সে কথাটাও অপ্রকাশ থাকবে না। কিন্তু শিবেনবাবু—
সহসা শিবেনের দিকে ফিরে তাকিয়ে এবার কিরীটী বললে, দ্বিতীয় ফঁাকটাও আমার ভরাট হয়ে গিয়েছে। তাই বলছিলাম কাল প্রত্যুষে সরমার গৃহত্যাগের ব্যাপারটা জানাজানি হবার পূর্বেই আমাদের যা করবার করতে হবে