আবার আমি চমকে উঠি, কি বলতে চাস তুই কিরীটী?
কি আবার বলতে চাই, যা বলতে চাইছিলাম সে তো নিজেরাই বুঝতে পেরেছিস—
না, না–ও কথা নয়—
তবে আবার কি?
তুই কি বলতে চাস তাহলে—
হ্যাঁ–সরমা সাধারণ ঝি নয়—সরমা হচ্ছে ঐ শকুন্তলার জননী। আর তাইতেই তার স্থান হয়েছিল অধ্যাপকের গৃহে অমনি সুদৃঢ়।
তবে—তবে কি–
না। যতদূর আমার মনে হচ্ছে অধ্যাপকের রক্ত শকুন্তলার দেহে নেই—
হঠাৎ ঐ সময় দ্বারপ্রান্তে শিবেন সোমের কণ্ঠস্বর শোনা গেল, ভিতরে আসতে পারি?
আরে শিবেনবাবু, আসুন, আসুন—আপনার কথাই ভাবছিলাম।
শিবেন সোম ঘরে এসে প্রবেশ করলেন, রিপোর্ট দেখলেন?
হুঁ।
কিন্তু এ যে তাজ্জব ব্যাপার, ডিজিট্যালিন শেষ পর্যন্ত–
হ্যাঁ, বেচারী একে হাইপারটেনসনে ভুগছিলেন—তাই অধিক মাত্রা ডিজিট্যালিনের দ্রুতক্রিয়া মারাত্মক বিষক্রিয়ায় পরিণত হয়েছে। যদিও অত্যন্ত ক্রুড হয়ে—তবু বলব হত্যাকারী সুনিশ্চিত পন্থাটাই গ্রহণ করেছিল। কিন্তু সে তো পরের কথা ইতিমধ্যে সুব্রত যে আরো একটি মারাত্মক আবিষ্কার করে বসে আছে!
সে আবার কি? শিবেন সোম আমার দিকে তাকালেন।
আমি লজ্জিত হয়ে বলি, না-না—আমি নয়, কিরীটীই। ইট ওয়াজ হিজ ডিসকভারি! ওরই আবিষ্কার—
কিন্তু ব্যাপারটা কি সুব্রতবাবু?
জবাব দিল এরপর কিরীটীই। সে বললে, শকুন্তলা চৌধুরী অধ্যাপক বিমল চৌধুরীর ভাইঝি নন—
সে কি!
হ্যাঁ, সরমার ইতিহাস যদি সত্যিই হয়—অর্থাৎ সে যদি সত্যিই কৈবর্তকন্যাই হয়ে থাকে তো শকুন্তলা অধ্যাপকের কেউ নয়—কোনো রক্তের সম্পর্ক পরস্পরের মধ্যে ওদের নেই।
মানে—কি বলছেন?
ঐ ফটো দুটো দেখলেই বুঝতে পারবেন। দেখুন না ফটো দুটো একটু চোখ মেলে পরীক্ষা করে!
সরমা ও শকুন্তলার ফটো দুটো শিবেনের দিকে এগিয়ে দিল কিরীটী।
ফটো দুটো দেখতে দেখতে শিবেন সোম বলেন, আশ্চর্য! ব্যাপারটা তো আগে আমার নজরে পড়ে নি? কিন্তু–
বুঝতে পারছি শিবেনবাবু, সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে—এই তো?
না, তা নয়—
তবে? ভাবছেন তাহলে ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়াচ্ছে, এই তো?
হ্যাঁ, মানে—
ব্যাপারটার একটা মীমাংসার প্রয়োজন বৈকি। আর সেই জন্যেই আজ আবার আপনাকে কষ্ট করে রাত এগারোটার পর এখানে আসতে হবে—
রাত এগারোটার পর?
হ্যাঁ, রাত এগারোটার পর।
.
বলা বাহুল্য, ঐদিনই রাত্রে কিরীটীর দোতলার বসবার ঘরেই আমরা বসেছিলাম। আমি, কিরীটী, শিবেন সোম ও কৃষ্ণা।
দেওয়াল-ঘড়িতে রাত এগারোটা বেজে কুড়ি মিনিট হয়ে গিয়েছে। শিবেন সোম যে একটু অধৈর্য হয়ে উঠেছেন বুঝতে পারছিলাম। কিরীটীর কথামত বেচারী সেই রাত সাড়ে দশটা থেকে এখানে এসে বসে আছেন।
কিরীটী দ্বিপ্রহরে যতটুকু বলেছিল তার বেশী আর একটি কথাও বলে নি। একেবারে যেন চুপ।
ঘন ঘন শিবেন সোম একবার ঘড়ির অগ্রসরমান কাটার দিকে এবং পরক্ষণেই আবার কিরীটীর মুখের দিকে তাকাচ্ছিলেন।
কিরীটী কিন্তু নির্বিকার। পাইপটা ওষ্ঠপ্রান্তে চেপে ধরে একান্ত নির্বিকার চিত্তেই যেন ধূমপান করছে।
রাত যখন সাড়ে এগারোটা, একটা রিকশার ঠুং ঠুং শব্দ আমাদের সকলের কানে এসে প্রবেশ করল।
কিরীটী যে অন্যমনস্কতার ভান করলেও ভিতরে ভিতরে বিশেষ কারো আগমন প্রতীক্ষ্ণয় কতখানি উগ্রীব হয়েছিল বুঝতে পারলাম ঐ রিকশার ঠুং ঠুং শব্দটা কানে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যে মুহূর্তে কিরীটী উঠে সোজা গিয়ে পথের দিককার খোলা জানালা দিয়ে উঁকি দিল।
কৌতূহল যে আমারও হয়েছিল সেটা বলাই বাহুল্য। কারণ আমি প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই উঠে গিয়ে ওর পাশে দাঁড়ালাম।
নীচে জানালাপথে উঁকি দিতেই চোখে পড়ল, একটি রিকশা এসে কিরীটীর ঠিক দোরগোড়ায় থামল।
জায়গাটায় ঠিক আলো না থাকার দরুন এবং রাস্তার লাইট হাতকয়েক দূরে থাকার দরুন একটু যেন আলোছায়ায় অস্পষ্ট। তাই পরিষ্কার বা স্পষ্ট দেখা যায় না।
কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম, কেউ এল রিকশা করে মনে হচ্ছে তোরই বাড়িতে! কে রে?
যার জন্যে অপেক্ষা করছিলাম–
অপেক্ষা করছিলি!
হ্যাঁ। অবিশ্যি মনে একটু সন্দেহ যে ছিল না তা নয়—আসবে কি আসবে না শেষ পর্যন্ত, কিন্তু যাক, শেষ পর্যন্ত এসেছে!
কথা বলছিলাম আমরা নীচের রাস্তার দিকে তাকিয়েই। দেখলাম আপাদমস্তক চাদরে আবৃত এবং গুণ্ঠনবতী এক নারীমূর্তি রিকশা থেকে নামল।
একজন ভদ্রমহিলা দেখছি!
হ্যাঁ।
ঐ সময় নীচের সদর দরজাটা খুলে গেল এবং জংলীকে দেখা গেল।
বুঝলাম কিরীটী জংলীকে নির্দেশ দিয়ে রেখেছিল পূর্ব থেকেই।
কে এলেন? শিবেন সোম এতক্ষণে পিছন দিক থেকে প্রশ্ন করেন।
এলেই দেখতে পাবে–আসছেনই তো এই ঘরেই! কিন্তু একটা কাজ করতে হবে তোমাকে আর সুব্রতকে
কি?
তোমাদের সামনে অর্থাৎ তৃতীয় ব্যক্তি এখানে কেউ ওঁর সামনে থাকলে উনি মুখ খুলতে ইতস্তত করবেন, কাজেই তোমরা ঐ পাশের ঘরে যাও। দরজাটা ঈষৎ ফাঁক করে। রেখো–তাহলেই ওঁকে তোমরা দেখতেও পাবে, ওঁর কথাও শুনতে পাবে।
চলুন তাহলে শিবেনবাবু।
আমার কথায় শিবেনবাবু এবং কৃষ্ণা দুজনেই উঠে দাঁড়ায়। আমরা পাশের ঘরে গিয়ে অতঃপর প্রবেশ করি।
.
দরজার ফাঁক দিয়ে আমরা দেখতে লাগলাম।
অবগুণ্ঠনবতী সেই নারী সামনের কক্ষে এসে প্রবেশ করল।
আসুন, আসুন—কিরীটী আগন্তুক অবগুণ্ঠনবতী ভদ্রমহিলাকে তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে সাদর আহ্বান জানাল।