কিরীটী কিন্তু ততক্ষণে চেয়ারটার দিকে এগিয়ে গিয়েছে, আমিও এগিয়ে গেলাম।
চেয়ারের ভাঙা পায়াটা লক্ষ্য করতে করতে কিরীটী বললে, হুঁ, বুঝতে পেরেছি—
চেয়ারের ঐ পায়ার সঙ্গে একটা কোটর ছিল। কোটরের ডালাটা খুলতে পারে নি, বোধ হয় চাবি পায় নি, তাই শেষ পর্যন্ত কোন কিছু লোহার পাত জাতীয় শক্ত জিনিস ডালার ফাকের মধ্যে প্রবেশ করিয়ে ডালাটা খোলবার চেষ্টা করেছিল, তাতেও কৃতকার্য না হয়ে শেষ পর্যন্ত পায়াটা ভেঙে ফেলেছে!
পরীক্ষা করে দেখলাম, কিরীটীর কথাটা মিথ্যা নয়।
কিরীটী আবার বলে, খুব সম্ভবত ঐ কোটরের মধ্যে এমন কিছু ছিল আর সেটা এমন মারাত্মক কিছু অবশ্য-প্রয়োজনীয় ছিল খুনীর পক্ষে, যেজন্য গতরাত্রে আমরা চলে যাবার পর এই ঘরে তাকে প্রবেশ করতেই হয়েছিল।
কিরীটীর শেষের কথায় যেন চমকে উঠি এবং সঙ্গে সঙ্গে ওর মুখের দিকে তাকাই। তবে কি খুনী—কিন্তু সহসা চিন্তাসূত্রে আমার বাধা পড়ল কিরীটীর পরবর্তী কথাতেই, সে বললে, চলো শিবেন, এ শূন্য ঘরে বসে থেকে আর কি হবে?
কিন্তু ঘরটা তো দেখলে না ভাল করে?
কিরীটী মৃদু হাসতে হাসতে বললে, যা দেখবার সে তো স্পষ্টই চোখের সামনে রয়েছে। আর কি দেখব! তাছাড়া দেখবার নতুন করে আর আছেই বা কি!
কিন্তু–
না হে—মস্ত বড় একটা ফাঁক ভরাট হয়ে গিয়েছে—
ফাঁক!
হ্যাঁ, খানিকটা এগিয়ে আর এগুতে পারছিলাম না, দুটি ফাঁকের জন্যে এক জায়গায় এসে—তার মধ্যে একটি ফাঁক খুনী নিজেই ভরাট করে দিয়ে গিয়েছে বাকি আর একটি, আশা করি সেটার জন্যও আর বেশী ভাবতে হবে না আমাদের!
তাহলে কি তুমি–
হ্যাঁ শিবেন, ব্যাপারটা প্রথমে যত জটিল মনে হয়েছিল আসলে এখন দেখছি ততটা বোধ হয় নয়।
তুমি—
কি?
তুমি কি তবে হত্যাকারী কে—
তা আন্দাজ একটা করেছি বৈকি!
কে–কে?
অত তাড়াতাড়ি করলে কি আর হয় ডিয়ার ফ্রেণ্ড! কথায় বলে হত্যারহস্য! দুম করে কি হত্যাকারীর নামটা উচ্চারণ করা যায়! তাছাড়া
কি?
হত্যাকারী যদি ঘুণাক্ষরেও জানতে পারে তাকে আমরা সন্দেহ করছি সে সাবধান হয়ে যাবে। কিন্তু আমি চাই সে স্বাভাবিক নিশ্চয়তার সঙ্গেই আমাদের সকলের সামনে এসে দাঁড়াক। যাতে করে বিনা ক্লেশে প্রয়োজনের মুহূর্তটিতে আমরা অনায়াসেই শিবেনবাবুর আইনের লোহার হাতকড়াটা দিয়ে তার হাত দুটো শক্ত করে বেঁধে ফেলতে পারি, এবং সে আর না পালাবার সুযোগ কোন দিক দিয়েই পায়। যাক চলো, রাত হলো।
.
দিন-দুই পরে দ্বিপ্রহরে।
কিরীটীর ঘরের মধ্যেই আমরা—মানে আমি, কিরীটী ও কৃষ্ণা বসে কতকগুলো ফটো নিয়ে বিশ্লেষণ করছিলাম।
বলা বাহুল্য, ফটোগুলো ঐদিনই ময়না-তদন্তের পুরো রিপোর্টের সঙ্গে একটা সরকারী লেফাফায় ভরে শিবেন সোম কিরীটীর নির্দেশমত ঘণ্টাখানেক আগে মাত্র একজন কনস্টেবল মারফত পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।
ময়না-তদন্তের রিপোর্টে প্রকাশ, তীব্র ডিজিট্যালিনের বিষক্রিয়ায় অধ্যাপকের মৃত্যু ঘটেছে। এবং খুব সম্ভবতঃ ক্লোরোফরমের হুইপ দিয়ে তাকে অজ্ঞান করে ঐ ডিজিট্যালিন অধ্যাপকের দেহে প্রবেশ করানো হয়েছিল।
রিপোর্টটা পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই কিরীটী যেন কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। তারপর একটি মাত্র কথাই বলেছিল, হত্যাকারী বুদ্ধির খেলা দেখিয়েছে নিঃসন্দেহে।
আর একটা কথাও বলে নি ঐ কথাটা ছাড়া।
তারপরই ময়না-তদন্তের রিপোর্টটা ভাঁজ করে এক পাশে রেখে দিয়ে কতকটা যেন নিশ্চিন্ত হয়ে ফটোগুলো দেখতে শুরু করে।
পাঁচখানি ফটো পাঠিয়েছিলেন শিবেন সোম।
অধ্যাপক বিমলবাবুর, সরমার, শকুন্তলার, বিনায়ক সেনের এবং রঞ্জন বোসের। এবং পাঁচখানি ফটোর উপরে বারেকের জন্য চোখ বুলিয়ে নিয়ে পরপর শেষ পর্যন্ত শকুন্তলা ও সরমার ফটোটি দুহাতে তুলে নেয় কিরীটী। এবং তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ফটো দুটো বার বার পর্যবেক্ষণ করতে থাকে।
তারপরই কিরীটী আমাদের দুজনের দিকে ফটোগুলো এগিয়ে দিতে দিতে বললে, দেখ তো তোমরা, ফটোগুলোর মধ্যে কোন বিশেষত্ব আছে কিনা?
বলা বাহুল্য, আমরা কিন্তু ফটোগুলো বহুক্ষণ ধরে পরীক্ষা করেও কিরীটী ঠিক কী বলতে চায় ধরতে পারি না।
১৬-২০. কিছু পেলে না তোমরা খুঁজে
কি হল, কিছু পেলে না তোমরা খুঁজে?
কিরীটীর প্রশ্নে ওর মুখের দিকে দুজনেই আমরা তাকাই।
আশ্চর্য! চোখে পড়ল না কিছু এখনো তোমাদের কারো?
আমি তখনো সরমা ও শকুন্তলার ফটো দুটি পাশাপাশি রেখে দেখছিলাম, হঠাৎ কিরীটীর শেষের কথায় যেন চমকে উঠি। সত্যিই তো, অদ্ভুত একটা সৌসাদৃশ্য আছে তো ফটো দুটির মধ্যে! কপাল, নাক ও চোখের অদ্ভুত মিল!
চট করে অবিশ্যি প্রথমে কারো নজর না পড়বারই কথা। কিন্তু ভাল করে দেখলে চোখে পড়বেই।
বললাম, হ্যাঁ, যদিও বয়সের তফাৎ রয়েছে তবু দেয়ার আর সিমিলারিটিজ—দুটো মুখের মধ্যে সৌসাদৃশ্য রয়েছে!
হ্যাঁ রয়েছে, কিরীটী বললে, এবং সব চাইতে বড় সৌসাদৃশ্য হচ্ছে ডান দিককার চিবুকের কাছে কালো তিলটি দুজনেরই মুখে। তবে সরমার তিলটা ছোট্ট, কিন্তু শকুন্তলারটা বড়। হ্যাঁ, ঐ তিলটিই আমার মনে গতকাল খটকা বাধিয়েছিল—যে মুহূর্তে ওটা সরমার মুখে দেখি শকুন্তলার মুখে দেখবার পর!
বাবাঃ, কি শকুনের মত নজর তোমার গো! কৃষ্ণা বলে ওঠে ঈষৎ যেন ব্যঙ্গের সুরে।
কাজটাই যে শকুনের কাজ প্রিয়ে! কিরীটী মৃদু হাসির সঙ্গে বলে ওঠে, বলছিলাম না কৃষ্ণা তোমাকে সেদিন, মেয়েদের মত অভিনেত্রী হয় না—প্রমাণ পেলে তো হাতে হাতেই!