হ্যাঁ সরমা দেবী, আর কেউ না জানুক, বুঝতে না পারুক, আমি জানি, আমি বুঝতে পেরেছি। যাক সে কথা, আপনাকে শুধু আমার একটা অনুরোধ–
অনুরোধ!
হ্যাঁ, আমাকে না জানিয়ে এ বাড়ি থেকে আপনি যাবেন না।
কিন্তু–
বলুন, কথা দিলেন?
আমি—
জানি। বুঝতে পারছি বৈকি, এখানে থাকা আর একটা দিনও আপনার পক্ষে সত্যই দুঃসাধ্য ব্যাপার। প্রতি মুহূর্তে আপনাকে দুঃসহ অপমান মেনে নিতে হবে তাও জানি সব জেনেও কটা দিন এখানে আপনাকে আমি থাকতে বলছি বিশেষ কোন কারণ আছে বলেই।
কারণ! সরমা কিরীটীর দিকে মুখ তুলে তাকাল।
হ্যাঁ কারণ, নচেৎ জানবেন এখানে এই অপমানের মধ্যে কিছুতেই আপনাকে আমি ধরে রাখতাম না—অনুরোধও করতাম না।
সরমা চুপ করে থাকে। কোন জবাব দেয় না।
সরমা দেবী! কিরীটী আবার ডাকে কয়েকটা মুহূর্ত চুপ করে থেকে।
কি?
আপনি কি জানেন কাল রাত্রে পুলিস বিমলবাবুর ঘরে যে তালাটা দিয়ে গিয়েছিল, সেই তালাটা কেউ ভেঙেছে!
ভেঙেছে?
হ্যাঁ, ভেঙেছে। যা গে। আর একটা কথা—
কি?
শুনেছি বিমলবাবু নাকি ডাইরী রাখতেন, সে-সম্পর্কে আপনি কিছু জানেন?
না।
আচ্ছা আজ বিনায়কবাবু কেন এসেছিলেন, জানেন কিছু?
কে—কে এসেছিল?
বিমলবাবুর বাল্যবন্ধু বিনায়ক সেন! দেখা হয় নি আপনার তার সঙ্গে আজ কিছুক্ষণ আগে?
সরমা চুপ।
কিরীটী বলে চলে, জানি আপনার সঙ্গে তার দেখা হয়েছিল, কিন্তু কেন এসেছিলেন তিনি?
সরমা তথাপি নীরব।
আপনার সঙ্গেই দেখা করতে এসেছিলেন, তাই না?
পূর্ববৎ নিশ্চুপ সরমা। সে যেন নিষ্প্রাণ, একেবারে পাথর।
কি বলতে এসেছিলেন তিনি আপনাকে? বিমলবাবুর সম্পর্কে কোন কথাই কি?
হঠাৎ যেন ভেঙে পড়ল সরমা, আমি—আমি জানি না, আমি জানি না—কথাগুলো বলতে বলতে দুহাতে অকস্মাৎ মুখ ঢাকল সে।
কিরীটী ক্ষণকাল স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সরমার মুখের দিকে। তারপর অত্যন্ত মৃদুকণ্ঠে বললে, আচ্ছা আপনি যেতে পারেন সরমা দেবী।
.
১৫.
একটি নিষ্প্রাণ দম-দেওয়া পুতুলের মতই যেন অতঃপর চেয়ার থেকে উঠে ধীরে ধীরে ঘর থেকে বের হয়ে গেল সরমা।
সরমার ক্রম-অপস্রিয়মাণ দেহটার দিকেই তাকিয়েছিল কিরীটী এবং সরমার দেহটা যখন দরজার ওপাশে আমাদের দৃষ্টি থেকে মিলিয়ে গেল কিরীটী মৃদুকণ্ঠে একটিমাত্র কথা বললে, বেচারী!
কথাটা ঘরের মধ্যে তৃতীয় ব্যক্তি শিবেন সোমের কানে না গেলেও আমার কানে গিয়েছিল, আমি মুখ তুলে তাকালাম কিরীটীর দিকে। কিন্তু কোন প্রশ্ন করতে পারলাম না। ওকে, কারণ মনে হল ও যেন একটু অন্যমনস্ক। কিন্তু সে ঐ মুহূর্তে কিছু একটা ভাবছিল এবং সেটা যে সরমাকে কেন্দ্র করেই, সেটা বুঝতে আমার দেরি হয় না। এবং এও যেন আমি অনুভব করতে পারছিলাম নাটক দানা বেঁধে উঠেছে বিশেষ করে দুটি প্রাণীকে কেন্দ্র করে, অথচ
সহসা আমার চিন্তাজাল ছিন্ন হয়ে গেল শিবেন সোমের কথায়।
দোতলার ঘরটা একবার দেখলে হতো না মিঃ রায়?
হ্যাঁ, হ্যাঁ—দেখতে হবে বৈকি। আচ্ছা শিবেন, তোমার কি মনে হয়?
কিসের কি মনে হয়?
বলছিলাম ঐ সরমা দেবীর কথা—
সরমা দেবী!
হ্যাঁ। ওঁর কথা শুনলে, ওঁর মুখের দিকে তাকালে, ওঁর কণ্ঠস্বরে, ওঁর মুখের চেহারায় কি মনে হয় না যে ওঁর মনের মধ্যে কোথাও একটা গভীর লজ্জা, গভীর ব্যথা জমাট বেঁধে আছে–
গভীর লজ্জা, ব্যথা!
হ্যাঁ, যে লজ্জা যে ব্যথা কারো কাছে প্রকাশ করবার নয়। যাক গে, কি যেন বলছিলে একটু আগে তুমি? ওপরের ঘরটা দেখবার কথা! হ্যাঁ চলো, ঘরটা দেখে আসা যাক। রামচরণকে একবার ডাকো না, তাকেই সঙ্গে নিয়ে না-হয় ওপরে যাওয়া যাবে।
.
বলা বাহুল্য, রামচরণকে নিয়েই আমরা উপরের ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।
ঘরের তালাটা ভাঙা ছিল, সেটা ধরে সামান্য টানতেই খুলে গেল। খোলা দরজাপথে অতঃপর প্রথমে শিবেন সোম, তার পশ্চাতে আমি, কিরীটী ও রামচরণ ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলাম।
অন্ধকার ঘর। ঘরের মধ্যে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মনে হল, একটু আগেও ঘরের মধ্যে কেউ ছিল, যে আমাদের ঘরে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঠিক ঐ মুহূর্তেই ঘর থেকে চলে গেল।
নিজেদের অজ্ঞাতেই, বুঝি আমাদের ঐ কথাটা মনে হওয়াতেই থমকে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলাম আমরা। এবং সকলেই যেন নিশ্চুপ, মুহূর্তের জন্য বোবা হয়ে গিয়েছিলাম।
ঘরের আলোটাও যে জ্বালানো দরকার, সে কথাটাও যেন ভুলে গিয়েছিলাম। কিন্তু রামচরণ আমাদের বাঁচাল। সুইচ টিপে সে ঘরের আলোটা জ্বেলে দিল।
দপ করে ঘরের বিদ্যুৎ-বাতিটা জ্বলে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ঘরের সমস্ত অন্ধকার অপসারিত হল।
সেই ঘর—যে ঘরে কাল রাত্রে প্রবেশ করেই চেয়ারটার উপরে শায়িত অধ্যাপকের মৃতদেহটা আমাদের দৃষ্টিকে আকর্ষণ করেছিল।
আজও সর্বপ্রথমেই সেই চেয়ারটার উপরে, বুঝি একান্ত স্বাভাবিকভাবেই, আমাদের দৃষ্টি গিয়ে পড়ল। কিন্তু আশ্চর্য, চেয়ারটা ঠিক গতকাল যেখানে ছিল সেখানে তো নেই, চেয়ারটা একটু যেন কাত হয়ে রয়েছে–হ্যাঁ, তাই!
বেতের হাতলওয়ালা আরামকেদারা। এবং চেয়ারটা কাত হয়ে থাকার দরুনই যে ব্যাপারটা আমাদের ঐ সঙ্গে দৃষ্টিকে আকর্ষণ করে সেটা হচ্ছে চেয়ারের ডান পায়াটা ভাঙা। মনে হল, কেউ যেন কোন কিছু দিয়ে চাপ দিতে গিয়েই পায়াটা ভেঙে ফেলেছে।
কিন্তু পায়াটা হঠাৎ কেউ অমনভাবে ভাঙতেই বা গেল কেন? কি এমন প্রয়োজন হয়েছিল কারো চেয়ারের পায়াটা ভাঙবার?