বেশ তাই হবে।
কিরীটী এতক্ষণ চুপ করে ছিল, আবার কথা বলল, রঞ্জনবাবু, আপনাকে আমাদের কয়েকটা কথা জিজ্ঞাস্য ছিল।
রঞ্জন বোস কিরীটীর দিকে চোখ তুলে তাকাল। মনে হল হৃদুটো কুঁচকে কপালের উপরে যেন বিরক্তির চিহ্ন একটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে রঞ্জন বোসের।
বলুন?
গতকাল রাত্রে সোয়া সাতটা থেকে পৌনে নটা পর্যন্ত আপনি কোথায় ছিলেন, কি করছিলেন?
কোথায় ছিলাম আর কি করছিলাম! না মশাই, আমি অত্যন্ত দুঃখিত—ঠিক মনে করতে পারছি না।
মনে করতে পারছেন না?
না।
ওঃ, আচ্ছা আপনার মামাবাবুকে কেউ ফোনে ডেকেছিল আর আপনি তাকে ডেকে দিয়েছিলেন সে কথাটা আশা করি মনে আছে আপনার?
তা আছে।
কে তাকে ফোনে ডেকেছিল মনে আছে আপনার?
না। তাছাড়া জানব কি করে বলুন, আমি তো আর নাম জিজ্ঞাসা করি নি।
নাম জিজ্ঞাসা করেন নি?
না।
ছেলে না মেয়ে?
পুরুষেরই কণ্ঠস্বর যেন শুনেছিলাম।
কি বলেছিলেন তিনি?
বিশেষ কিছুই না, কেবল বলেছিলেন, মামার সঙ্গে তাঁর বিশেষ কি জরুরী কথা আছে— একবার দয়া করে তাকে ডেকে দিতে।
ফোনটা তখন কোথায় ছিল?
মামার ঘরেই।
ঠিক মনে আছে তা আপনার?
তা মনে আছে বৈকি।
আপনি আপনার মামার পিছনে পিছনে এসেছিলেন, তাই না?
এসেছিলাম।
আপনার মামার সঙ্গে সঙ্গে তার ঘরে ঢুকেছিলেন কি?
মামার ঘরে? কই না তো!
তবে আপনি কোথায় গেলেন?
আমি তো আবার ছাদেই ফিরে যাই।
না, আপনি ছাদে ফিরে যান নি!
ফিরে যাই নি? তার মানে?
ফিরে যান নি তাই বললাম। কিন্তু কেন যে ফিরে যান নি সে তো আমি বলতে পারব না, আপনিই পারবেন!
তবে কোথায় গিয়েছিলাম আমি সেটা আপনি নিশ্চয় জানেন বলেই মনে হচ্ছে!
জানি না বলেই তো জিজ্ঞাসা করছি।
রঞ্জন বোস অতঃপর চুপ করে থাকে।
মনে করে দেখুন, আপনার ঘরেই ফিরে যান নি তো?
না।
যান নি?
না।
তা হলে মিঃ বোস, ঐ সময়টা আপনি কি করেছেন, কোথায় ছিলেন, কিছুই মনে নেই বলতে চান?
তাই।
মনে নেই যখন—আচ্ছা আপনি আসতে পারেন। হ্যাঁ ভাল কথা, সরমা দেবীকে একটিবার এই ঘরে পাঠিয়ে দেবেন কি?
কি বললেন! ভ্র-দুটো কুঁচকে ওঠে রঞ্জন বোসের।
বলছিলাম সরমা দেবীকে—
দেবী নয়, আপনারা হয়তো জানেন না, সে সামান্য একজন চাকরানী ছাড়া কিছুই নয়।
তাই নাকি? তা কথাটা আপনি জানলেন কি করে? আপনি তো কিছুদিন মাত্র এখানে এসেছেন রঞ্জনবাবু, ওঁর আসল ও সত্যকারের পরিচয়টা এত শীঘ্র কি করে জেনে ফেললেন বলুন তো!
পরিচয়! পরিচয় আবার কি? এভরিবডি নো শি ইজ নাথিং বাট এ মেড-সারভেন্ট ইন দিস হাউস! সামান্য একজন চাকরানী মাত্র এ বাড়ির
কিরীটী আবার হাসল এবং হাসতে হাসতে বললে, আপনি মনে হচ্ছে যে কারণেই হোক সরমা দেবীর ওপরে তেমন সন্তুষ্ট নন রঞ্জনবাবু! কিন্তু একটা কথা কি জানেন, একজনের ওপরে কোন কারণে আপনি সন্তুষ্ট নন বলেই তাকে অশ্রদ্ধা করবেন, তার সম্পর্কে কটুভাবে কথা বলবেন সেটাও তো ভদ্রতা নয়!
থামুন মশাই, আপনারা দেখছি সব এক দলের! একটা অতি সাধারণ—
কিরীটী, কিন্তু কথাটা রঞ্জনকে শেষ করতে দিল না। তার আগেই শান্ত অথচ দৃঢ়কণ্ঠে এক প্রকার যেন বাধা দিয়েই বললে, থাক রঞ্জনবাবু, আপনাকে কষ্ট করে তার পরিচয় দিতে হবে, আপনি দয়া করে একবার বরং মিস চৌধুরীকে বলে দেবেন, সরমা দেবীকে যেন একটিবার এ ঘরে তিনি পাঠিয়ে দেন। যান—
এক প্রকার যেন ঠেলেই কিরীটী রঞ্জন বোসকে ঘর থেকে বের করে দিল।
কিরীটীর প্রতি একটা ক্রুদ্ধ দৃষ্টি হেনে রঞ্জন ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
মিনিট পনের বাদে সরমা ঘরে এসে ঢুকল।
সেই শান্ত আত্মসমাহিত চেহারা।
বসুন সরমা দেবী। যতদিন না ব্যাপারটার কিনারা হয় মধ্যে মধ্যে হয়তো আপনাকে বিরক্ত করতে আমরা বাধ্য হব। একটা কথা বলছিলাম, রামচরণ বলছিল রঞ্জনবাবু নাকি আপনাকে ঠিক সহ্য করতে পারছে না! কথাটা কি সত্য?
শান্ত স্থির দৃষ্টি তুলে তাকাল সরমা কিরীটীর মুখের দিকে নিঃশব্দে।
বুঝেছি, আপনাকে আর বলতে হবে না, কিন্তু কেন বলুন তো, আপনার প্রতি তার এত বিতৃষ্ণার কারণটা কি কিছু বুঝতে পেরেছেন? আগে তো তিনি আপনাকে কখনো দেখেন নি, আপনার সঙ্গে তার কোন পরিচয়ও ছিল না—
বলতে পারি না!
বিমলবাবু নিশ্চয়ই ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছিলেন?
ব্যাপারটা আমি বুঝতে পারলেও এতদিন এতটা উগ্র হয়ে দেখা দেয় নি। কিন্তু—
বুঝেছি তার মৃত্যুর পর থেকেই—
হ্যাঁ, এ বাড়িতে আমার যে আর জায়গা হবে না তাও—
তাও বলেছেন উনি?
হ্যাঁ, আজই দুপুরে বলেছেন সে কথা।
শকুন্তলা দেবী জানেন সে কথাটা?
না, তাকে আমি বলি নি কিছু।
কিন্তু কেন বলেন নি? এ বাড়িতে সব অধিকার তো একমাত্র রঞ্জনবাবুরই নয়, মিস চৌধুরীরও তো সমান অধিকার আছে।
সে তারা বুঝবে। আমি তো এ বাড়িতে সত্যিই সামান্য দাসী বই কিছুই নয়।
কিন্তু সরমা দেবী, আমি যদি বলি, সামান্য দাসী মাত্রই আপনি নন
কি—কি বললেন?
হঠাৎ যেন কথাটা বলতে বলতে চমকে তাকাল কিরীটীর মুখের দিকে চোখ তুলে সরমা, মেঘে ঢাকা আকাশের গায়ে বিদ্যুৎচমকের মতই যেন তার অটুট শান্ত গাম্ভীর্য মুহূর্তের জন্য খসে পড়ল বলে মনে হল।
হ্যাঁ, আপনি এ বাড়িতে সামান্য দাসী নন! কিরীটী আবার কথাটা উচ্চারণ করে।
না, না—আমি দাসীদাসী বৈকি—দাসীই তো!
সরমার কণ্ঠ থেকে শেষের বেদনাসিক্ত কথাগুলো যেন একটা আকস্মিক কান্নার মতই উচ্চারিত হল। এবং স্পষ্ট লক্ষ্য করলাম সরমার দুচোখের কোল ছলছল করছে।