লোকটার পরনে একটা আধময়লা ধুতি, গায়ে ফতুয়া। কাচায়-পাকায় মেশানো মাথার চুল ছোট ছোট করে ছাঁটা। ভারী পুরুষ্টু একজোড়া কাঁচা-পাকা গোঁফ ওষ্ঠের ওপরে।
লোকটি সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে আমাদের সিঁড়ির নীচে দেখেই সিঁড়ির মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে যায়, কে–কে আপনারা?
প্রশ্ন করলেন শিবেন সোম, তুমি কে? কি নাম তোমার?
এতক্ষণে বোধ হয় শিবেন সোমের পরিহিত পুলিসের ইউনিফর্মের উপরে ভাল করে নজর পড়ে লোকটার। সঙ্গে সঙ্গে সে আরো দু-ধাপ নেমে এসে সম্রমের সুরে বলে, আজ্ঞে আমার নাম রামচরণ বটে। এ বাড়িতে কাজ করি। চাকর।
রামচরণ!
আজ্ঞে—আরো দু-ধাপ নেমে এসেছে রামচরণ ততক্ষণে।
রঞ্জনবাবু, শকুন্তলা দেবী—ওঁরা বাড়িতে আছেন?
যে যাঁর নিজের ঘরেই আছেন।
শকুন্তলা দেবীকে খবর দাও, থানা থেকে শিবেনবাবু এসেছেন।
আজ্ঞে আপনি বাইরের ঘরে বোস করেন, আমি তেনাদের খবর দিচ্ছি এখুনি। চলেন—
রামচরণই নীচের বসবার ঘর খুলে আলো জ্বেলে আমাদের বসতে দিল। ছিমছাম করে। সাজানো ঘরটি, যদিচ আসবাবপত্র সামান্যই।
খবর দেবার জন্যই বোধ হয় রামচরণ ঘর থেকে বের হয়ে যাচ্ছিল, বাধা দিল কিরীটী, রামচরণ!
আস্তে–
কাল কই তোমাকে এ বাড়িতে তো দেখি নি! কোথায় ছিলে কাল? বাড়িতে ছিলে না নাকি?
আজ্ঞে ছিলাম।
ছিলে?
আজ্ঞে নীচেই ছিলাম। এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না বাবু, এমনটা কেমন করে হল? কালই আমি দেশে চলে যাচ্ছি বাবু—কথাটা বলতে বলতে দেখলাম, দু চোখের কোল বেয়ে রামচরণের ট ট করে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল।
কালই চলে যাচ্ছ?
হ্যাঁ বাবু।
আর একদণ্ডও এখানে টিকতে পারছি না।
কতদিন আছ এখানে?
দিদিমণি এ বাড়িতে আসার বছর দুই পরে–ছোট্টটি এসে দেখেছি দিদিমণিকে। সে কি আজকের কথা বাবু! জীবনটাই তো এ বাড়িতে আমার কেটে গেল। সব শেষ হয়ে গেল যখন তখন আর কেন—বলতে বলতে কাপড়ের খুঁটে প্রবহমান অশ্রুধারা মুছতে লাগল রামচরণ।
রামচরণ!
কিরীটীর ডাকে জলে-ভেজা চোখ তুলে তাকাল রামচরণ ওর মুখের দিকে।
কাল যখন বাবুরা সব এসেছিলেন তখন তুমি কোথায় ছিলে?
উপরেই তো খাটা-খাটনি করছিলাম বাবু। উপরেই ছিলাম।
তুমি বোধ হয় শুনেছ তোমার বাবুকে কেউ খুন করেছে!
শুনেছি বৈকি। তাই তো কাল থেকে ভাবছি, কে এমন কাজটা করলে?
আচ্ছা রামচরণ, কাল যখন রঞ্জনবাবু এসে তোমার কত্তাবাবুকে ফোনের খবর দেন তখন তুমি কোথায় ছিলে?
ছাদেই ছিলাম। টেবিল পরিষ্কার করছিলাম।
তার পর যখন সকলে জানল তোমার কত্তাবাবু মারা গিয়েছেন, তখন তুমি কোথায় ছিলে?
দোতলায় ঘরের সামনে বারান্দায় মা বলেছিলেন খাবারগুলো গুছিয়ে রাখতে, তাই গুছোচ্ছিলাম।
মা! মা কে?
আজ্ঞে সরমা মাকে দেখেন নি?
ও, তুমি বুঝি তাকে মা বলে ডাক?
আজ্ঞে।
তিনি তোমাকে খুব স্নেহ করেন, তাই না?
মার মত দয়া আর স্নেহ এ পৃথিবীতে আমি তো আর দেখি নি বাবু। অমন মানুষ হয়। বিধাতা যে আমার অমন মায়ের কপালে এত বড় দুঃখ কেন লিখে দিলেন তাই তো মাঝে মাঝে ভাবি–
দুঃখ!
দুঃখ নয়? শুনেছি এগারো বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল, কিন্তু একটি বছর ঘুরতে না ঘুরতেই সব শেষ হয়ে গেল। তবু ভাগ্যি ভাল আমার কত্তাবাবুর এখানে ঠাঁই পেয়েছিলেন কিন্তু দেখুন না কপাল, সেটুকুও বিধাতার সইল না, এবারে যে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবেন কে জানে!
কেন? এখানে?
এখানে! হুঁ, এখন রঞ্জনবাবু হলেন এ বাড়ির কত্তা, তিনি তাড়িয়ে দিলেন বলে। তা
ড়িয়ে দেবেন?
না তাড়িয়ে দিলেও যা কথার ঝাজ রঞ্জনবাবুর—তাছাড়া এখানে পা দেওয়া অবধি প্রথম দিন থেকেই যে কি বিষনজরে দেখেছেন রঞ্জনবাবু মাকে আমার—তাই তো মাকে বলছিলাম, চলো মা, আমার দেশে আমার কুঁড়েতেই না হয় চলল। ছেলের দু-মুঠো জুটলে তোমারও জুটবে। না হয় উপোস করেই থাকবে। আমি তো জানি এ অপমান সারাক্ষণ তোমার সইবে না।
চেয়ে ছিলাম রামচরণের মুখের দিকে, শুনছিলাম ওর কথাগুলো। কথাগুলো তো কোন পেঁয়ো চাষার চাষাড়ে কথা নয়। কেবলমাত্র তো সরল দরদই নয়, আরো কিছু যে আছে প্রতিটি কথার মধ্যে!
আচ্ছা রামচরণ?
বলেন আজ্ঞে—
বাবুকে—তোমার কত্তাবাবুকে তার ঘরে ঢুকতে তুমি কাল দেখেছিলে?
না। তবে—
তবে?
ফোন ধরবার জন্য কত্তাবাবু কখন ঘরে ঢুকেছিলেন তা জানি না—তবে তার কিছুক্ষণ পর বারান্দায় ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আমি কাজ করছি, শুনছিলাম বাবু যেন কার সঙ্গে ঘরের মধ্যে কথা বলছেন। পরে ভেবেছি ফোনেই হয়তো কত্তাবাবু কথা বলছেন—
ঘরের মধ্যে ফোন করছেন মানে? তোমার কত্তাবাবুর ঘরে তো ফোন নেই! ফোন তো বারান্দায়! কিরীটী যেন বিস্ময়ের সঙ্গেই প্রশ্ন করে।
হ্যাঁ বাবু, বারান্দাতেই ফোন থাকে, তবে কত্তাবাবুর ঘরেও প্লাগ পয়েন্ট আছে।
কাল যখন ফোন আসে তখন কোথায় ফোনটা ছিল?
কত্তাবাবুর ঘরেই কাল দুপুর থেকে ফোনটা ছিল।
বলো কি! তবে—
কি বাবু?
কাল রাত্রে আমরা যখন ঘরে গিয়ে ঢুকলাম তখন তো ফোনটা কই তোমার কত্তাবাবুর ঘরে ছিল না।
ছিল না?
না। তবে ফোনটা আবার কে বাইরে নিয়ে এল? নিশ্চয়ই কেউ এনেছে—তুমি কিছু জানো রামচরণ কে এনেছিল ফোনটা আবার বারান্দায়?
আজ্ঞে জানি না তো!
হুঁ, আচ্ছা ঠিক আছে তুমি এবারে দিদিমণিকে তোমার একটা খবর দাও রামচরণ। বলো গে যে আমরা এসেছি।
কিরীটী এতক্ষণ সোফায় বসেছিল এবং কথা বলতে বলতে অন্যমনস্কতার মধ্যে কখন এক সময় যেন তার সিগারটা নিভে গিয়েছিল, সিগারটায় পুনঃঅগ্নিসংযোগ করে সিগারটা মুখে দিয়ে কিরীটী ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে লাগল।