মিঃ সেন চলে গেলেন।
.
০৮.
অধ্যাপক সুধীর চক্রবর্তী এসে ঘরে ঢুকলেন।
রোগা লম্বা চেহারা। মাথার চুল ছোট ছোট করে ছাঁটা। খাঁড়ার মত উঁচু নাক। চোখে মোটা কালো সেলুলয়েডের ফ্রেমে পুরু লেন্সের চশমা। কালো কুচকুচে গায়ের বর্ণ। পরিধানে খদ্দরের ধুতি-পাঞ্জাবি।
অধ্যাপক সুধীর চক্রবর্তী ঘরের মধ্যে পা দিয়েই যেন একেবারে যাকে বলে ফেটে পড়লেন। কটা রাত হয়েছে আপনার কিছু খেয়াল আছে দারোগাবাবু? বেশ চড়া সুরেই কথাগুলো বললেন অধ্যাপক চক্রবর্তী।
শিবেন সোম বললেন, তা একটু হয়ে গিয়েছে—
একটু হয়ে গিয়েছে! ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখুন তো, সোয়া এগারোটা রাত এখন–তাছাড়া আমাদের সকলকে এভাবে আটকে রাখার মানেটাই বা কি? আপনার কি ধারণা আমরা কেউ এর সঙ্গে জড়িত আছি?
কিন্তু বুঝতেই তো পারছেন মিঃ চক্রবর্তী, আকস্মিকভাবে দুর্ঘটনাটা ঘটেছে বলেই। আপনাদের এভাবে কষ্ট দিতে হল আমাদের–
দুর্ঘটনা! দুর্ঘটনা কিসের? লোকটা হাইপারটেনশনে ভুগছিল—সাডেন স্ট্রোকে হার্টফেল করেছে—এর মধ্যে দুর্ঘটনার কি আপনারা দেখলেন?
হ্যাঁ মিঃ চক্রবর্তী, কথা বললে এবারে কিরীটী, হার্টফেল করেই উনি মারা গিয়েছেন সত্য, কিন্তু স্বাভাবিক হার্টফেল নয়—ইটস্ এ মার্ডার অ্যাণ্ড ডেলিবারেট মার্ডার!
কি—কি বললেন?
নিষ্ঠুরভাবে কেউ আপনার বন্ধু বিমলবাবুকে হত্যা করেছে।
হত্যা? বিস্ময়ে যেন অধ্যাপক চক্রবর্তীর কণ্ঠরোধ হয়ে আসে, হত্যা-ইউ মীন—
হ্যাঁ–খুন!
না না—হাউ অ্যাবসার্ড—
অ্যাবসার্ড নয়—নিষ্ঠুর সত্যি সত্যিই হত্যা করা হয়েছে বিমলবাবুকে। কিরীটী আবার বলল শান্ত দৃঢ়কণ্ঠে।
হঠাৎ যেন একটা নির্মম আঘাতে মনে হল অধ্যাপক চক্রবর্তী একেবারে বোবা হয়ে গেলেন। কয়েক মুহূর্ত কেমন যেন ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকেন কিরীটীর মুখের দিকে।
তারপরই চেয়ারটার উপর থ করে যেন বসে পড়লেন।
সত্যি বিমল নিহত হয়েছে! কিন্তু কে কে করল এ কাজ? কতকটা যেন আত্মগতভাবেই নিম্নকণ্ঠে কথাগুলো উচ্চারণ করলেন চক্রবর্তী।
মিঃ চক্রবর্তী।
বোবা দৃষ্টিতে চক্রবর্তী কিরীটীর দিকে মুখ তুলে তাকালেন।
বুঝতে পারছি ব্যাপারটা সত্যিই আপনার কাছে অবিশ্বাস্য লাগছে, আমাদেরও তাই মনে হয়েছিল প্রথমে, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে—
কি–কি মনে হচ্ছে আপনাদের?
আপনাদের সকলের সাহায্য পেলে হয়ত এই অবিশ্বাস্য ব্যাপারটা কি করে ঘটল আমরা তার একটা কিনারা করতে পারব।
আমাদের সাহায্যে?
হ্যাঁ।
কিন্তু কি—কি সাহায্য আমি আপনাদের করতে পারি?
আপনার বন্ধুর আত্মীয়স্বজন বা পরিচিত বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে কেউ এ কাজ করতে পারে বলে আপনার মনে হয়? বলছিলাম এমন কোন ঘটনা আপনি কিছু কি জানেন আপনার বন্ধুর-সতীর্থের জীবনের, যার মূলে এই নৃশংস হত্যার বীজ লুকিয়ে থাকতে পারে!
না না—বিমলের কেউ শত্রু থাকতে পারে বলে অন্ততঃ আমার জানা নেই।
শত্রুই যে এ কাজ করতে পারে মনে করছেন কেন? কোন বিশেষ মিত্রস্থানীয় লোকও স্বার্থের জন্য তো এ কাজ করতে পারে।
স্বার্থ?
হ্যাঁ।
কি স্বার্থ?
তা অবিশ্যি বলতে পারছি না, তবে এটা তো ঠিকই হত্যাকারী বিনা উদ্দেশ্যে ঐ গর্হিত কাজটা করে নি! দেয়ার মাস্ট বী সাম কজ! আচ্ছা একটা কথা কি আপনি জানেন মিঃ চক্রবর্তী, ইদানীং কিছুদিন ধরে আপনার সতীর্থের মনটা বিক্ষিপ্ত ছিল?
হ্যাঁ, সেটা আমি লক্ষ্য করেছিলাম—
লক্ষ্য করেছিলেন?
করেছি বৈকি—
কারণ কিছু জানতে পারেন নি?
না। মানুষটা বরাবর এমন চাপা-প্রকৃতির ছিল, কাউকে কিছু বলতো না—কাউকে নিজের চিন্তার ভাগটা দেওয়াকেও সে দুর্বলতা মনে করত।
তাহলে আপনি কিছু জানেন না, তিনিও আপনাকে কিছু বলেন নি!
.
অধ্যাপক সুধীর চক্রবর্তীর পরে ঘরে ডাক পড়ল রিটায়ার্ড জজ-বিমল চৌধুরীর প্রতিবেশী মহেন্দ্র সান্যালের।
কিন্তু মহেন্দ্র সান্যালও ব্যাপারটার উপরে এতটুকু আলোকসম্পাত করতে পারলেন না।
তিনি বললেন, অধ্যাপকের সঙ্গে প্রতিবেশী হিসাবে যতটুকু ঘনিষ্ঠতা থাকা সম্ভব তার চাইতে কিছুই বেশী ছিল না। তিনিও কখনো তাঁর বাড়ির বা নিজের খবর যেমন জিজ্ঞাসা করেন নি, তেমনি অধ্যাপকও গায়ে-পড়া হয়ে কোনদিন কিছু বলেন নি। অতএব তিনি পুলিসকে কোনরূপ সাহায্য ঐ ব্যাপারে করতে পারছেন না বলে দুঃখিত।
অগত্যা মহেন্দ্র সান্যালকে বিদায় দিতেই হল।
মহেন্দ্র সান্যাল ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।
নিমন্ত্রিত হিসাবে সেদিন বাইরের লোক যারা ছিল তাদের সকলকেই অতঃপর বিদায় দেওয়ার জন্য শিবেন সোম বললেন। তারপর বললেন, ওদের বাকী দুজন—ঐ রাঘব সরকার আর দুষ্মন্ত রায়কেই বা আটকে রেখে আর কি হবে কিরীটী, ওদেরও ছেড়ে দিই, কি বল?
না না–রাঘব সরকার আর দুষ্মন্ত রায়কে যে আমার অনেক কিছু জিজ্ঞাসা করবার আছে! কিরীটী বলে।
জিজ্ঞাসা করছ করো, তবে বিশেষ কিছু ওদের কাছ থেকেও জানা যাবে বলে তো আমার মনে হয় না কিরীটী। শিবেন সোম বললেন।
কিরীটী মৃদু কণ্ঠে বলে, কিছু কি বলা যায়! তাছাড়া তোমাকে তখন বললাম না, মিস্ চৌধুরী চাইছিলেন দুষ্মন্ত রায়কে বিয়ে করতে আর বিমলবাবু চাইছিলেন রাঘব সরকারের সঙ্গে ভাইঝির বিয়ে দিতে!
হ্যাঁ, তা বলেছিলে বটে, কিন্তু—
ডাকো, ডাকো—আগে তোমার ঐ রাঘব সরকারকেই ডাকো!
রাঘব সরকার এসে ঘরে ঢুকলেন।