বিমল চৌধুরী সেখানেই একটা চেয়ারে বসে দীর্ঘদিনের সতীর্থ অধ্যাপক সুধীর চক্রবর্তীর সঙ্গে গল্প করছিলেন, এমন সময় রঞ্জন বোস এসে বলে তার মামাকে কে ফোনে ডাকছে।
বিমল চৌধুরী ভিতরে চলে যান সেই সংবাদ পেয়ে
বাধা দিল ঐ সময় আবার কিরীটী, এক্সকিউজ মি মিস্ চৌধুরী, একটা কথা–
বলুন।
বলছিলাম ঐ রঞ্জনবাবুর কথা। কে যেন বলছিলেন উনি মাসখানেক হলো মাত্র এখানে এসেছেন।
হ্যাঁ, মাসখানেকই হবে।
আচ্ছা রঞ্জনবাবু কি বিমলবাবুর আপন বোনের ছেলে?
হ্যাঁ। ওঁদের একমাত্র বোন সরলা দেবীর ছেলে।
মাসখানেক তাহলে রঞ্জনবাবু এখানে আছেন! কিরীটী আবার প্রশ্ন করে।
হ্যাঁ।
তার আগে উনি কোথায় ছিলেন?
মালয়ে। সেখানে পিসেমশাইয়ের কিসের যেন ব্যবসা ছিল।
ছিল কেন বলছেন, এখন কি নেই?
না, বছর তিনেক আগে তার মৃত্যু হয়। মৃত্যুর পর রঞ্জনদাই ব্যবসাটা দেখছিল কিন্তু চালাতে পারল না, শেষ পর্যন্ত সেই ব্যবসা অন্যের হাতে চলে যাওয়ায় বাধ্য হয়েই গত মাসে তাকে এখানে চলে আসতে হয়।
আর আপনার পিসিমা?
পিসিমা বছর দশক আগেই মারা গিয়েছেন।
আর ওঁর কোন ভাই-বোন নেই?
না।
এখানে উনি কি করছিলেন?
কিছুই না।
তবে কি বসেছিলেন নাকি?
না, ঠিক তাও নয়—প্রেস ও বইয়ের দোকান করবে বলে কাকার সঙ্গে কিছুদিন ধরে কথাবার্তা চলছিল।
কোন কিছু স্থির হয় নি?
না। কাকা রাজী হচ্ছিলেন না কিছুতেই।
কেন?
বলতে পারি না। তবে—
তবে?
আমার মনে হয়, কাকা যেন রঞ্জনদাকে ঠিক পছন্দ করছিলেন না। দিন দশেক আগে—
কি?
দুজনের মধ্যে খানিকটা কথা-কাটাকাটি হয়ে গিয়েছিল সরমাদির মুখে শুনি।
কি বিষয় নিয়ে হয়েছিল কথা-কাটাকাটি কিছু জানেন?
না।
আপনার কাকা কেন রঞ্জনবাবুকে পছন্দ করতেন না, সে সম্পর্কে কিছু আপনার ধারণা আছে?
না।
রঞ্জনবাবুর স্বভাবচরিত্র কেমন?
ভালই। তাছাড়া রঞ্জনদা অত্যন্ত ভদ্র ও বিনয়ী—
বয়স কত হবে তার?
আমার চাইতে বছর চারেকের বড়।
লেখপড়া?
ম্যাট্রিক পাস।
.
০৭.
শকুন্তলা আবার তার কাহিনী শুরু করল।
বিমল চৌধুরী ফোন ধরবার জন্য আধঘণ্টা চলে যাবার পর রিটায়ার্ড জজ মহেন্দ্র সান্যাল মশাই প্রথম বললেন, চৌধুরী এখনো ফিরছে না কেন? তিনি এবারে বিদায় নেবেন।
ভৃত্যকে ডেকে বিনয়েন্দ্র সেন বিমলবাবুর এক বাল্যবন্ধু, বিমলবাবুকে ডেকে দেবার জন্য বলেন ঐ সময়।
ভৃত্য ডাকতে যাবার কিছুক্ষণ পরেই ভিতর থেকে একটা গোলমালের শব্দ শোনা যায়।
ওঁরা সকলে সেই গোলমাল শুনে এগুতে যাবেন, ভৃত্য ছুটতে ছুটতে এমন সময় এসে হাজির হলো এবং হাউমাউ করে বলে, তার বাবু মারা গিয়েছে–
বিনয়েন্দ্র সেন যেন থমকে যান, সে কি রে!
হ্যাঁ, বাবু! ভৃত্য কাঁদতে কাঁদতে বলে, বাবু নেই—
সকলে একসঙ্গে প্রশ্ন করে, কোথায় কোথায় তোর বাবু?
চলুন দেখবেন, তাঁর শোবার ঘরে চেয়ারের ওপর মরে পড়ে রয়েছেন।
তাড়াতাড়ি সকলে গিয়ে বিমলবাবুর শোবার ঘরে হাজির হয়, এবং ঘরে ঢুকে এখন যে অবস্থায় মৃতদেহ চেয়ারে পড়ে আছে—ঠিক সেই অবস্থায় দেখতে পায়, আর তার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে সরমা।
সরমার দেহে যেন এতটুকু প্রাণের স্পন্দন নেই। একেবারে পাথরের মূর্তি। মাথার ঘোমটা খসে পড়েছে, দুচোখের কোল বেয়ে নিঃশব্দে দুটি অশ্রুর ধারা গড়িয়ে পড়ছে।
ওঁরা সকলেই স্তম্ভিত বিস্ময়ে যেন কিছুক্ষণ ঐ দৃশ্যের দিকে নিস্পলক দৃষ্টিতে চেয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। কারো মুখে কোন কথা ফোটে না, কারো ওষ্ঠে কোন প্রশ্ন আসে না, সবাই যেন বোবা, সবাই যেন স্তব্ধ।
কিছুক্ষণ পরে হঠাৎ যেন সরমার মধ্যে সম্বিৎ ফিরে আসে। সে মাথার কাপড়টা তুলে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় একটি কথাও না বলে।
মানুষটা যে মারা গিয়েছে কারোরই বুঝতে দেরি হয় না। তবু রিটায়ার্ড জজ মহেন্দ্র সান্যাল বিমলবাবুকে পরীক্ষা করে দেখেন।
দেহটা যদিও তখনো গরম রয়েছে—শ্বাস-প্রশ্বাসের কোন চিহ্নই নেই।
সকলে তবু মহেন্দ্র সান্যালের মুখের দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো।
ক্ষীণকণ্ঠে মহেন্দ্রবাবু বললেন, ডেড!
তারপর? শিবেন সোম শকুন্তলার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন।
তারপর সরমাদিকেই প্রশ্ন করে জানা যায়, বিমলবাবুকে কি একটা কথা বলতে নাকি সরমা ঐ সময় তার শোবার ঘরে এসে তাকে ঐ মৃত অবস্থায় দেখে হঠাৎ পাথর হয়ে গিয়েছিল।
এবারে কিরীটীই প্রশ্ন করল, তাহলে সরমা দেবীই প্রথম ব্যাপারটা জানতে পারেন?
হ্যাঁ।
আপনি ঐ সময় কোথায় ছিলেন মিস্ চৌধুরী?
সন্ধ্যা থেকেই মাথার মধ্যে বড় যন্ত্রণা হচ্ছিল, আমি সাতটা নাগাদ গিয়ে আমার ঘরে আলো নিভিয়ে অন্ধকারে শুয়েছিলাম, গোলমাল শুনে ছুটে যাই।
কোন্ ঘরে আপনি থাকেন?
রঞ্জনদার পাশের ঘরটাই আমার ঘর।
আপনি তারপরই বোধ হয় আমাকে টেলিফোন করেন?
হ্যাঁ।
কেন বলুন তো, হঠাৎ আমাকে ফোন করতে গেলেন কেন মিস্ চৌধুরী? প্রশ্নটা করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় কিরীটী শকুন্তলার মুখের দিকে।
কারণ আমার—আমার এ ব্যাপারটা দেখেই মনে হয়েছিল—
কি? কি মনে হয়েছিল মিস্ চৌধুরী?
স্বাভাবিক মৃত্যু নয়। সামথিং হ্যাপেণ্ড!
কেন?
তা আমি ঠিক বলতে পারব না মিঃ রায়, তবে—তবে আমার যেন তাই মনে হয়েছিল, আর তাই আপনাকে আমি ফোন করি।
ফোনটা কোথায় এ-বাড়ির?
ঘরের সামনে বারান্দাতেই আছে।
মিস্ চৌধুরী।
বলুন?
ফোনে আপনার কাকাকে কেউ ডাকছে এ খবরটা তাকে কে দিয়েছিল বলতে পারেন?