কিরীটী তখন বললে, বসুন মিস্ চৌধুরী, শিবেনবাবু আপনাকে কিছু প্রশ্ন করতে চান। উনি যা জানতে চান—আশা করি আপনার বলতে আপত্তি হবে না!
না। বলুন উনি কি জানতে চান?
দাঁড়িয়ে রইলেন কেন, বসুন?
শকুন্তলা নিঃশব্দে কিরীটী কর্তৃক নির্দিষ্ট চেয়ারটায় উপবেশন করল।
শিবেন সোম বললেন, মিস্ চৌধুরী, যদিও ব্যাপারটা আমি মোটামুটি শুনেছি—আপনার মুখ থেকে আর একবার শুনতে চাই।
.
মিস্ শকুন্তলা চৌধুরীর সংক্ষিপ্ত বিবৃতি হচ্ছে।
বিমল চৌধুরী প্রথম যৌবনে বিবাহ করেছিলেন এম-এ পাস করবার পর, কিন্তু বৎসরখানেকের মধ্যেই তার স্ত্রী-বিয়োগ হয় এবং আর দ্বিতীয়বার তিনি বিবাহ করেন নি।
এম-এ পাস করবার পরই তিনি কোন একটি বেসরকারী কলেজে কলকাতায় অধ্যাপনার কাজ নেন। এবং অদ্যাবধি সেই অধ্যাপনার কাজেই নিযুক্ত ছিলেন। বর্তমানে তার বয়স হয়েছিল বাহান্ন বছর।
অধ্যাপনা করে মাইনে যে একটা খুব বেশী পেতেন তা নয়, তাহলেও তার মাসিক উপার্জনটা বেশ যাকে বলে ভালই ছিল, এবং সেই বাড়তি টাকাটা তিনি উপার্জন করতেন তার লেখা কলেজের পাঠ্যপুস্তকগুলো ও অন্যান্য বিষয়ে গবেষণামূলক পুস্তকগুলো থেকে, কাজেই আর্থিক সচ্ছলতা তার বরাবরই ছিল, বেসরকারী কলেজের একজন অধ্যাপক হলেও।
প্রত্যেক মানুষেরই নানা ধরনের কর্মব্যস্ততা ও নেশা বা হবি থাকে।
বিমল চৌধুরীরও ছিল অমনি একটি হবি বা নেশা—নানা ধরনের ব্যবসা করা। জীবনে বহুরকম ব্যবসাই তিনি করেছেন এবং বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই তাকে ঐসব ব্যাপারে লোকসান দিতে হয়েছে—একটার পর একটা অকৃতকার্যতায়, কিন্তু তবু তিনি নিরাশ বা নিরুৎসাহ হন নি।
সংসারে তার আপনার জন বলতে ঐ একটিমাত্র ভাইঝি শকুন্তলাই।
শকুন্তলার, বিমলবাবুর মুখেই শোনা, বাবা প্রসাদ চৌধুরী বিমল চৌধুরীর একমাত্র সহোদর ছিলেন। শকুন্তলার যখন তিন বছর বয়স সেই সময় তার মার মৃত্যু হয়। প্রসাদ চৌধুরীও আর দ্বিতীয়বার দ্বারপরিগ্রহ করেন নি। যদিচ শোনা যায়, সি. পি.-তে কেন্দ্রীয় সরকারের ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টে মোটা মাইনের চাকরি করতেন প্রসাদ চৌধুরী—তথাপি মৃত্যুকালে একটি টাকাও নাকি মেয়ের জন্য রেখে যেতে পারেন নি, বরং কলকাতার কোন নামকরা মদের দোকানে কিছু ধারই রেখে গিয়েছিলেন।
চাকরিতে ঢোকার পর থেকেই মদ্যপান-দোষ প্রসাদ চৌধুরীর মধ্যে দেখা দেয় এবং স্ত্রীর মৃত্যুর পর থেকে সেটা ক্রমশই বৃদ্ধি পেতে থাকে। এবং মৃত্যুও হয়েছিল তার অতিরিক্ত মদ্যপান করে মত্ত অবস্থায় গাড়ি চালাতে চালাতে, ভয়াবহ একটা দুর্ঘটনার ফলে স্ত্রীর মৃত্যুর কয়েক মাসের মধ্যেই।
কর্মজীবনে দুই ভাই বিমল ও প্রসাদ চৌধুরী পরস্পর থেকে দূরে অবস্থান করলেও পরস্পরের মধ্যে সম্পর্কটা ছিন্ন হয়ে যায় নি। উভয়েই উভয়ের দেখাসাক্ষাৎ বড় একটা না হলেও খোঁজখবর নিতেন, পরস্পরের মধ্যে পত্রের আদান-প্রদানও ছিল।
সহোদরের আকস্মিক মৃত্যুসংবাদটা তারযোগে পেয়েই সঙ্গে সঙ্গে সি. পি.-তে চলে গিয়েছিলেন এবং সেখানে গিয়ে বিমল চৌধুরী সঙ্গে করে সাড়ে তিন বছরের বাচ্চা ভাইঝি শকুন্তলাকে নিজের কাছে কলকাতায় নিয়ে এলেন। এবং সেই থেকেই শকুন্তলা তার কাকা বিমল চৌধুরীর কাছে আছে।
কিরীটী ঐ সময় বাধা দিল, অবিশ্যি আপনার মনে থাকবার কথা নয়, তবু শুনেও থাকেন কখনো যদি—আপনি যখন এখানে আসেন মিস্ চৌধুরী সে সময় কি ঐ সরমা ঝি এখানে ছিল?
সঙ্গে সঙ্গে শকুন্তলা কিরীটীর মুখের দিকে তাকালো এবং শান্ত মৃদু কণ্ঠে বললে, ছিল কিন্তু সরমা তো ঝি নয় কিরীটীবাবু!
শকুন্তলার কথায় একটু যেন বিস্ময়ের সঙ্গে কিরীটী ওর মুখের দিকে তাকালো।
ঝি নয়! মৃদু কণ্ঠে শুধাল।
না।
তবে যে শুনলাম সে এ বাড়ির পুরাতন ঝি?
না, যা শুনেছেন ভুল শুনেছেন—সে ঝি নয়।
তবে কে সে?
এ বাড়ির সঙ্গে তার কোন আত্মীয়তা বা কোন সম্পর্কই নেই সত্যি মিঃ রায়, তবু সে ঝি নয়। তারপর যেন একটু থেমে বলতে লাগল শকুন্তলা, সরমা এক কৈবর্ত পরিবারের মেয়ে, বারো বছর বয়সের সময় সে বিধবা হয় এবং কাকা তাকে নিজগৃহে আশ্রয় দেন। তার পূর্বইতিহাস এর বেশী কিছু আমার জানা নেই—জানবার চেষ্টাও আজ পর্যন্ত করি নি। এখানে এসে ওকে আমি দেখেছিলাম, মায়ের মতই সে আমাকে মানুষ করেছে—ও ঝি নয়।
ও। আমি ভেবেছিলাম–
শুধু আপনি কেন, বাইরে থেকে কেউ এলে বা কথা শুনলে ঐ রকমই একটা কিছু ভাববে—কিন্তু সে ঝি নয়। এবং কাকা তাকে সেভাবে কোন দিনই দেখতেন না, এ বাড়িতে তার একটি বিশেষ স্থান বরাবরই দেখেছি
ঠিক আছে। আপনি যা বলছিলেন বলুন।
শকুন্তলা চৌধুরী আবার বলতে শুরু করল।
গত পাঁচ বছর ধরে শকুন্তলারই ইচ্ছায় তার কাকা বিমল চৌধুরীর জন্মতিথি উৎসব পালন করা হচ্ছে। আজ সেই জন্মতিথি উৎসবই ছিল।
প্রত্যেকবারই ঐ দিনটিতে বিমল চৌধুরীর কিছু পরিচিত বন্ধুবান্ধব ও সতীর্থকে নিমন্ত্রণ করা হয়। এবারেও জন-পঞ্চাশেককে করা হয়েছিল। উৎসবের সঙ্গে জলযোগের আয়োজন ছিল।
বেলা চারটে থেকেই নিমন্ত্রিতরা সব আসতে শুরু করে ও এক এক করে আবার সন্ধ্যার পর থেকেই চলে যেতে শুরু করে। রাত্রি তখন বোধ করি সওয়া সাতটা হবে। একে একে নিমন্ত্রিতরা সবাই তখন প্রায় চলে গিয়েছে।
সামনের দোতলার ছাদেই সামিয়ানা খাটিয়ে প্যাণ্ডেল বেঁধে উৎসবের আয়োজন করা হয়েছিল।