কি বললি কিরীটী? প্রশ্ন করলাম আমিই।
হ্যাঁ, বিষ সুব্রত! কোন বিষের ক্রিয়াতেই ওঁর মৃত্যু ঘটেছে এবং সে বিষ তার অজ্ঞাতে খুনী প্রয়োগ করেছিল বলেই বোধ হয়—অর্থাৎ বিষপ্রয়োগের পূর্বে ওঁকে ক্লোরোফর্মের সাহায্যে খুব সম্ভব ঘুম পাড়ানো হয়েছিল—
ক্লোরোফর্ম! প্রশ্ন করলেন শিবেন সোম।
হ্যাঁ শিবেন, ভাল করে লক্ষ্য করে দেখো—ওঁর নাকের ডগায় কয়েকটি রক্তাভ বিন্দু আছে—
রক্তাভ বিন্দু!
হ্যাঁ, রুমালে বা কাপড়ে ক্লোরোফর্ম ঢেলে ওঁর নাকের ওপর হয়তো চেপে ধরা হয়েছিল, যার ফলে উনি জ্ঞান হারান। তারপর কোন তীব্র বিষ—
কিন্তু–
অবিশ্যি সঠিক কিভাবে কি ঘটেছে সেটা তদন্ত ও বিশ্লেষণ সাপেক্ষ, এই মুহূর্তেই সব কিছু তোমাকে আমি পরিষ্কার করে বলতে পারব না—সেটা সম্ভবপরও নয়। তবে ব্যাপারটা যে সাধারণ ও স্বাভাবিক মৃত্যু নয়, এমন কি আত্মহত্যাও নয়, সেইটুকুই বর্তমানে বলতে পারি।
মানে?
মানে বিমলবাবুকে হত্যা করা হয়েছে।
হত্যা!
আমার তাই ধারণা, কিন্তু একটা কিসের শব্দ পাচ্ছি যেন! কিরীটীর শ্রবণেন্দ্রিয় সজাগ হয়ে ওঠে।
বলা বাহুল্য সেই সঙ্গে আমাদের সকলেরই।
এতক্ষণ শব্দটা কানে প্রবেশ করে নি, কিন্তু কিরীটী কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গেই শব্দটা ঘরের মধ্যে উপস্থিত আমরা সকলেই যেন শুনতে পেলাম।
বাথরুমের দরজাটা ভেজানোই ছিল তবে সামান্য ফঁক হয়ে ছিল, কিরীটী বাথরুমের দিকে এগিয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে আমিও।
দরজাটা হাত দিয়ে ঠেলে খুলে দিতেই শব্দের উৎসটা পরিষ্কার হয়ে গেল। বাথরুমের মধ্যে বেসিনের ট্যাপটা খোলা রয়েছে এবং বাথরুমের আলোটা জ্বলছে।
সেই ট্যাপ দিয়ে জল পড়ার শব্দটা আমাদের কানে এসেছিল।
কিরীটী থমকে দাঁড়ায়। পাশেই দাঁড়িয়েছিলাম আমি।
কিরীটী মৃদুকণ্ঠে ডাকল, সুব্রত!
কি?
একটা তীব্র অথচ মিষ্টি গন্ধ পাচ্ছিস!
গন্ধটা আমার নাকে প্রবেশ করেছিল এবং আমার পশ্চাতে দণ্ডায়মান শিবেন সোমের নাসারন্ধ্রেও প্রবেশ করেছিল।
তিনিই জবাব দিলেন, হুঁ, পাচ্ছি—
কিসের গন্ধ বলে মনে হচ্ছে বল তো শিবেন?
ঠিক বুঝতে পারছি না—
আমিও না। কথাটা বলে নাক দিয়ে টেনে টেনে গন্ধটা বোঝবার চেষ্টা করে কিরীটী কয়েকবার এবং তারপরই হঠাৎ একসময় বলে ওঠে, হ্যাঁ পেরেছি–ক্লোরোফর্ম–
ঠিক-ঠিক।
ইতিমধ্যে বেসিনের কাছেই একটা টার্কিশ টাওয়েল পড়ে ছিল, কিরীটী এগিয়ে গিয়ে নীচু হয়ে সেটা মাটি থেকে তুলে নিল।
» ০৬-১০. তোয়ালেটা নাকের কাছে তুলে
তোয়ালেটা নাকের কাছে তুলে ধরতেই এতক্ষণ যে গন্ধটা অস্পষ্ট আমাদের সকলের নাসারন্ধ্রে প্রবেশ করছিল—তার একটা ঝাপ্টা যেন সকলেরই নাসারন্ধ্রে এসে লাগল।
কিরীটী দেখি ততক্ষণে আলোর সামনে তোয়ালেটা ধরে পরীক্ষা করছে এবং পরীক্ষা করতে করতেই মৃদুকণ্ঠে বললে, দেখছি একেবারে নতুন তোয়ালেটা, সামান্য একটু ভিজেও আছে—বোঝা যাচ্ছে কিছুক্ষণ পূর্বেই তোয়ালেটা ব্যবহৃত হয়েছিল।
শেষের কথাগুলো কতকটা যেন আপনমনেই বলে কিরীটী। এবং আর কেউ না বুঝলেও আমি বুঝতে পারি, কিরীটীর মনের মধ্যে একটা চিন্তাধারা চলেছে, যদিচ চিন্তার ধারাটা সুসংবদ্ধ নয়, এলোমেলো তখনো।
এলোমেলো অসংবদ্ধ চিন্তার ধারাটা তার বিশেষ একটি কেন্দ্রে পৌঁছবার চেষ্টা করছে কিন্তু হাতের কাছে এমন কোন নির্ভরযোগ্য সূত্র পাচ্ছে না যার সাহায্যে বা যার ওপর নির্ভর করে সে সেই কেন্দ্রে গিয়ে পৌঁছতে পারে।
আমিও যে মনে মনে ব্যাপারটা বোঝবার চেষ্টা করছিলাম না তা নয়, কিন্তু বিশেষ কোন নির্ভযোগ্য সূত্র আমিও যেন হাতের কাছে পাচ্ছিলাম না।
একটু বোধহয় অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম, এমন সময় কিরীটীর কণ্ঠস্বর কানে এল, চলুন ডাক্তার ঘোষ, ঘরে যাওয়া যাক!
সকলে আমরা পুনরায় ফিরে এলাম পূর্বের ঘরে।
ডাক্তার ঘোষ বললেন, আর একটা জরুরী কল আছে—তাকে ছেড়ে দিলে ভাল হয়।
শিবেন সোম কিরীটীর মুখের দিকে তাকালেন।
কিরীটী বললে, হা ডাক্তার ঘোষ, আপাততঃ আপনি যেতে পারেন, তবে আপনাকে পরে হয়ত শিবেনবাবুর প্রয়োজন হতে পারে।
বেশ তো, আমার দ্বারা যতটুকু সম্ভব আমি আপনাদের নিশ্চয়ই সাহায্য করব মিঃ রায়।
বলা বাহুল্য, ইতিমধ্যে একসময় শিবেন সোমই কিরীটী এবং আমার পরিচয় দিয়েছিলেন ডাক্তার ঘোষকে।
ডাক্তার ঘোষ নমস্কার জানিয়ে বিদায় নিলেন।
ডাক্তার ঘোষ ঘর থেকে বের হয়ে যাবার পরই কিরীটী শিবেন সোমের দিকে তাকিয়ে বললে, এঁদের এখানকার সকলের জবানবন্দি নিশ্চয়ই এখনো তোমার নেওয়া হয় নি সোম?
না।
তাহলে সেটাই এবারে শুরু কর।
.
প্রথমেই ঘরে ডাকা হল শকুন্তলা চৌধুরীকে।
পাশের ঘরে এসে ইতিমধ্যে আমরা সকলে বসেছিলাম। এ ঘরটা মৃত অধ্যাপকের শয়নসংলগ্ন ঘর। জানা গেল পূর্বে ঘরটা খালিই পড়েছিল, ইদানীং মাসখানেক হবে বিমলবাবুর ভাগ্নে রঞ্জন বোস এসে ঘরটা অধিকার করেছেন।
ঘরটার মধ্যে বিশেষ কোন আসবাবপত্র ছিল না। একধারে একটি খাটে শয্যা বিছানো, একটি দেরাজ, একটি দেওয়াল-আলনা ও একটি আলমারি। ঘরের এক কোণে একটি টেবিল ও চেয়ার ছিল। গোটাচারেক চেয়ার ঐ ঘরে আনিয়ে ঐ টেবিলটা টেনে নিয়ে শিবেন সোম বসলেন, কিছুদূরে আমরা বসলাম।
শকুন্তলা চৌধুরী ঘরে এসে ঢুকল এবং প্রথমেই সতৃষ্ণ দৃষ্টিতে কিরীটীর মুখের দিকে তাকালো।