Site icon BnBoi.Com

রক্তের দাগ – নীহাররঞ্জন গুপ্ত

রক্তের দাগ - নীহাররঞ্জন গুপ্ত

০১. ফিরতে ফিরতে রোজই রাত হয়ে যায়

কখনো সাড়ে এগারোটা—কখনো রাত বারোটা বেজে যায়। আজও রাত হয়ে গিয়েছিল। বোধ হয় রাত বারোটা বেজে গিয়েছিল।

হাতঘড়ির দিকে না তাকিয়েও বুঝতে পারছিল সুদীপ। বাড়ির প্রায় কাছাকাছি যখন এসেছে সেই শব্দটা কানে এলো সুদীপের। একটা জুতো পায়ে হাঁটার শব্দ। শব্দটা কানে যেতেই থমকে দাঁড়াল সুদীপ আজও।

আশ্চর্য! সঙ্গে সঙ্গে পিছনের শব্দটাও থেমে গেল। আর কারো হেঁটে আসার শব্দ শোনা যাচ্ছে না।

সুদীপ জানে আবার সে হাঁটতে আরম্ভ করলেই পেছনে সেই শব্দটা শোনা যাবে। প্রথম প্রথম অতটা ভাবায়নি সুদীপকে; ভেবেছে কেউ তার পিছনে পিছনে হেঁটে আসছে।

দুদিন ধরে ওই একই শব্দ শুনে শুনে তৃতীয় দিন থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখবার চেষ্টা করেছিল কে তার পিছনে পিছনে হেঁটে আসছে অত রাত্রে। কিন্তু কাউকে সে দেখতে পায়নি। যতদূর দৃষ্টি চলে একেবারে ফাকা রাস্তাটা।

ছোট শহর। কলকাতা থেকে বেশী দূর নয়। গোটা তিনেক স্টেশন মাত্র। বাঁধানো রাস্তাটা সোজা স্টেশন থেকে কিছুদূরে এসে ডাইনে একটা বাঁক খেয়ে সোজা চলে এসেছে তার বাড়ির দিকে। স্টেশন থেকে দেড় মাইলের বেশী হবে না।

আগে রাস্তার দুপাশে কোন আলোর তেমন ভালো ব্যবস্থা ছিল না। দশ-পনেরো হাত দূরে দূরে মিউনিসিপ্যালিটির লাইটপোস্ট। তাও বেশীর ভাগ দিন বালব ফিউজ হয়ে যাওয়ায় আলোই জ্বলত না।

ইদানীং সমরেন্দ্রবাবু স্থানীয় এম. এল. এ. হওয়ায় মধ্যে মধ্যে কয়েকটা লাইটপোস্ট বসাবার পর বেশ আলো থাকে রাস্তাটায়।

পথে যেতে যেতে দুপাশে কিছু ঘর-বাড়ি ও দোকানপাট আছে কিন্তু অত রাত্রে কোন বাড়ির আলো জ্বলে না—দোকানপাটও বন্ধ হয়ে যায়। রাস্তাটাও একেবারে নির্জন হয়ে যায়। বোধ হয় একমাত্র সুদীপই শেষ ট্রেনের যাত্রী। লোকাল ট্রেন ওই সময় থাকে না–রাত এগারোটায় শেষ লোকাল ট্রেনটা চলে যায়।

পরের জংশন স্টেশনে মেল গাড়িটা থামে—সেই গাড়িতেই ফিরে সুদীপ পিছু হেঁটে আসে জংশন থেকে, নচেৎ অত রাত্রে ফিরবার আর কোনো উপায় নেই। জংশনটা মাইলখানেক দূরে—তাদের স্টেশনের আর জংশনের মাঝামাঝি জায়গাটা।

আজ দিন-দশেক হলো ওই শব্দটা শুনছে সুদীপ।

স্পষ্ট মনে আছে সুদীপের–খুনের মামলায় আদালতে সাক্ষী দেবার পর যেদিন সে ফিরে আসছে, সেইদিনই প্রথম ওই জুতো পায়ের শব্দটা সে শুনতে পেয়েছিল।

তারপর থেকে প্রতি রাত্রেই সে শুনছে ওই জুতো পায়ে চলার শব্দটা।

সুদীপ বোধ হয় অভ্যাসমতই হঠাৎ থেমে আজও পিছনপানে ফিরে তাকাল একবার। না, কেউ নেই–যতদূর দৃষ্টি চলে, রাস্তাটা একেবারে ফাকা—জনপ্রাণী নেই।

তবু আজ দাঁড়িয়ে থাকে সুদীপ রাস্তার দিকে তাকিয়ে। আজ আবার রাস্তার কয়েকটা আলো জ্বলছে না।

কেমন একটা আধো আলো আধো ছায়া থমথম করছে। হঠাৎ সেই আধো আলো আধো ছায়ার মধ্যে দুটো যেন নীল আগুনের মারবেল ভেসে উঠলো।

নীল আগুনের মারবেল দুটো এগিয়ে আসছে তার দিকে।

এমনিতে ভীতু নয় সুদীপ। কিন্তু ওই মুহূর্তে হঠাৎ যেন তার সমস্ত শরীর কাঠ হয়ে যায়, শক্ত হয়ে যায়। হঠাৎ আবার নীল আগুনের মারবেল দুটো অদৃশ্য হয়ে গেল। দপ করে যেন নীল আগুনের মারবেল দুটো নিভে গেল।

শীতের রাত। তবু সুদীপের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠেছে, কোথাও কিছু নেই—যতদূর দৃষ্টি চলে একটা আলো-ছায়ার থমথমানি।

নিশ্চয়ই ভুল দেখছে সুদীপ। চোখের ভুল। সুদীপ আবার চলতে শুরু করে।

সঙ্গে সঙ্গে আবার সেই শব্দ। হেঁটে হেঁটে কেউ যেন আসছে তার পিছনে পিছনে, ঠিক তার পিছনে।

আসুক।

সুদীপ আর থামবে না। পিছন ফিরে তাকাবে না। সুদীপ চলার গতি বাড়িয়ে দিল। বাড়ির সামনাসামনি পৌঁছে দেখে জানলা-পথে ঘরে আলোর ইশারা। ঘরে আলো জ্বলছে রমা জেগে আছে তার জন্য আজও।

প্রথম প্রথম রমা বলত, ইদানীং এত রাত করে ফের কেন? একটু তাড়াতাড়ি ফিরতে পার না আগের মত?

কাজ শেষ হবে—তবে তো আসবো। এখন অনেক বেশী কাজ। সুদীপ বলতো।

কি এমন কাজ তোমার যে রাত দুপুর গড়িয়ে যায়। একা তুমি ছাড়া বোধ হয় কেউ এত রাতে আর এদিকে ফেরে না।

সুদীপ কোন জবাব দেয় না। চুপ করে রমার কথাগুলো শুনে যায়। জামা-কাপড় খুলে বাথরুমে গিয়ে ঢোকে। কনকনে ঠাণ্ডা তোলা ড্রামের জলে ঐ রাত্রে স্নান করে।

কতদিন বলেছে রমা—অভিযোগ তুলেছে সুদীপের অত রাত করে বাড়ি ফেরা নিয়ে। কিন্তু এখন আর বলে না। বোধ হয় অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে রমা ব্যাপারটায়। কিংবা হয়ত বুঝতে পেরেছে রমা রাত করে বাড়ি ফেরার ব্যাপারে সুদীপকে বলে কোন লাভ নেই। সুদীপ তার কথায় কান দেবে না। অথবা রমাই হয়ত সুদীপকে একই কথা বলে বলে হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছে।

 

হন হন করে হেঁটে এসে সুদীপ দরজার সামনে দাঁড়াল। এবং আজ বেল বাজাবার আগেই দরজাটা খুলে গেল। সামনে দাঁড়িয়ে রমা।

রমা কোন কথা বলল না। দরজা খুলে দিয়ে ভিতরে চলে গেল।

সুদীপ কিন্তু তখুনি ভিতরে প্রবেশ করল না। দরজার উপর দাঁড়িয়ে পশ্চাতে যতদূর দৃষ্টি চলে তাকিয়ে দেখতে লাগল। কিন্তু কিছু তার চোখে পড়ল না।

শীতের মধ্যরাত্রের রাস্তাটা খাঁ খাঁ করছে। কোন জনপ্রাণীর চিহ্নমাত্রও চোখের দৃষ্টিতে পড়ে না। তবুও কয়েকটা মুহূর্ত সুদীপ সামনের রাস্তাটার দিকে তাকিয়ে রইলো।

হঠাৎ রমার কণ্ঠস্বরে চমকে ফিরে তাকাল।

রমা যেন কখন এসে আবার তার পাশে দাঁড়িয়েছে। বললে, কি দেখছো?

না। কই, কিছু না তো!

তবে অমন করে দেখছিলে কি?

চল। ভিতরে চল। সুদীপ বললে।

মনে মনে একটা হিসাব করছিল সুদীপ। কথাটা আজই তার মনে হয়েছে সর্বপ্রথম। ঠিক দশদিন ধরে রাত্রে বাড়ি ফিরবার সময় সে ওর পশ্চাতে পদশব্দটা শুনছে।

ঠিক দশদিন। পনেরোই নভেম্বর আজ। তিন, চার ও পাঁচই নভেম্বর পর পর তিনতিনটে দিন সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আদালতে তাকে সাক্ষ্য দিতে হয়েছিল তপন ঘোষের হত্যার ব্যাপারে।

আদালতের রায় বের হয়েছে কিনা জানে না সুদীপ। কোন খোঁজ রাখে নি। তবে এটা সে বুঝেছিল তার সাক্ষ্যের পর বিজিতের ফাঁসি হবে না। সোমনাথ ভাদুড়ী সেই রকমই বলেছেন। এবং সে সাক্ষ্য না দিলে হয়ত বিজিতের ফাঁসিই হতো। কারণ মৃতের গুলিবিদ্ধ রক্তাক্ত দেহটার সামনে সেও পড়েছিল জ্ঞান হারিয়ে। হাতের মুঠোর মধ্যে তার যে পিস্তলটা ছিল সেই পিস্তলের চেম্বারে পাঁচটি গুলি ছিল। একটি ছিল ফাকা। এবং ব্যালেস্টিক পরীক্ষায় তা প্রমাণিত হয়েছে। সেই পিস্তল থেকে গুলি ছোঁড়া হয়েছিল। এবং যে গুলিটা মৃতদেহকে ভেদ করে গিয়ে পাশের দেওয়ালে বিঁধেছিল সেটা ওই পিস্তল থেকেই যে ফায়ার করা হয়েছিল তাও প্রমাণিত হয়েছিল।

মৃণালের পাশের ঘরের লোকটি অবিনাশ সেন ও মেয়েটি মিনতিতারা সাক্ষ্য দিয়েছিল আদালতে। সন্ধ্যার কিছু পরে মৃণাল নামে মেয়েটির ঘরে তারা বিজিত মিত্রকে ঢুকতে দেখেছে। বিজিত মিত্র নাকি প্রায়ই মৃণালের ঘরে আসত। ঘণ্টা দু-তিন থাকত। আবোরা প্রমাণিত হয়েছিল–বিজিত মিত্র তপন ঘোষের সঙ্গে চোরাকারবার করত। এবং মধ্যে মধ্যে মৃণালের ঘরে ওরা দুজন কখনো একা, কখনো একত্রে যাতায়াত করত।

মৃণালের কিন্তু কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি।

সুদীপ সাক্ষ্য দিয়েছিল আদালতে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে : যে রাত্রে দুর্ঘটনা ঘটে, সে-রাত্রে ওই পল্লীর সামনে দিয়ে সে ও বিজিত মিত্র একত্রে ফিরছিল—হঠাৎ দুজন লোক তাদের আক্রমণ করে—বিজিতের মাথায় একটা ভারী বস্তু দিয়ে আঘাত করে। বিজিত সঙ্গে সঙ্গে অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে যায়—সুদীপ ছুটে পালায় প্রাণভয়ে। কিছুদূর গিয়ে একটা গলির মুখে দাঁড়িয়ে সে দেখে সেই লোক দুটো বিজিতের জ্ঞানহীন দেহটা একটা গাড়িতে তুলে নিয়ে চলে গেল। রাত তখন পৌনে দুটো।

কাজেই রাত সাড়ে বারোটা নাগাদ যদি মৃণালের ঘর থেকে পিস্তলের আওয়াজ শোনা গিয়ে থাকে এবং ময়না তদন্তে যদি প্রমাণিত হয়ে থাকে রাত বারোটা থেকে সাড়ে বারোটার মধ্যে কোন এক সময় গুলির আঘাতে তপন ঘোষের মৃত্যু হয়েছে, সেক্ষেত্রে তপন ঘোষের হত্যাকারী বিজিত মিত্র হতেই পারে না। সারকামস্টানশিয়াল এভিডেন্স যেমন তার বিরুদ্ধে নেই—তেমনি আছে রিজনেবল ডাউট।

সুদীপ মকদ্দমার রায় বের হয়েছে কিনা জানে না কিন্তু বিজিত মিত্র যে দোষী সাব্যস্ত হবে না সোমনাথ ভাদুড়ীর কথায় সেটা সে বুঝেছিল। তাছাড়া মৃণাল নামক মেয়েটির সন্ধান আজও পাওয়া যায়নি—একমাত্র হয়ত যে ছিল প্রত্যক্ষ সাক্ষী।

 

স্নান ও আহারাদির পর সুদীপ জানালার সামনে ইজিচেয়ারটায় গা এলিয়ে একটা পাতলা শাল গায়ে দিয়ে বসে বসে সিগ্রেট টানছিল।

আজ রাত আরো বেশী হয়েছে, বোধ করি রাত দুটো।

রমা রান্নাঘরের কাজ সেরে এসে পাশে দাঁড়াল, কি হলো? শুতে যাবে না?

বোসো রমা, তোমার সঙ্গে কথা আছে। সুদীপ বললো।

আমার বড্ড ঘুম পাচ্ছে।

ঘুম পাচ্ছে।

হ্যাঁ।

দাঁড়াও—আসছি। সুদীপ পাশের ঘরে গেল। আলমারি খুলে একটা স্মাগল করা স্কচ হুইস্কির ছোট চ্যাপটা বোতল থেকে দুটো গ্লাসে হুইস্কি ঢালল, একটু জল মেশাল কুঁজো থেকে—পরে ফিরে এলো গ্লাস দুটো হাতে পাশের ঘরে।

নিজে একটা গ্লাস নিয়ে, অন্য গ্লাসটা রমার দিকে এগিয়ে দিল সুদীপ। নাও এটা খেয়ে নাও।

কি এটা?

খেয়ে ফেল।

না! বল কি?

বিষ নয়। খাও।

রমা আর আপত্তি জানায় না। এক চুমুকে গ্লাসটা শেষ করে ফেলে, গলার ভিতরটা জ্বলে ওঠে।

মাগো, কি এটা—

হুইস্কি।

তুমি আমাকে মদ খাওয়ালে?

মধ্যে মধ্যে খাওয়া ভাল।

ভাল?

হ্যাঁ। শরীরের উপকার হয়। ডাক্তাররা বলেন, অ্যালকোহল ইজ দ্য বেস্ট ফুড।

রমার মাথাটা তখন যেন ঝিম ঝিম করছে।

আমার বোধ হয় নেশা হচ্ছে–রমা বলল।

সুদীপ বলল, কিছু হবে না। অতটুকু হুইস্কিতে নেশা হয় না কারো। কিছুক্ষণ বাদেই সব ঠিক হয়ে যাবে দেখো। বোসো ঐ চেয়ারটায়।

রমা বসলো সামনের চেয়ারটার উপরে।

রমার বুকটা গরম গরম লাগছে। কান দুটোও।

জান রমা, আজ কদিন ধরে দেখছি বাড়ি ফেরার পথে কে যেন আমাকে ফলো করে।

ফলো করে তোমায়?

হ্যাঁ।

কে ফলো করে?

তা জানি না।

দেখতে পাওনি লোকটাকে?

না।

তবে বুঝলে কি করে ফলো করছে কেউ তোমাকে?

করে। আমি জানি।

কিন্তু কেই বা তোমায় ফলো করবে–আর কেনই বা করতে যাবে!

হয়ত—

কি?

কেউ কিছু বলতে চায় আমায়।

কে আবার কি বলতে চাইবে তোমাকে? আর যদি বলতে চায় তো সামনাসামনি এসে বললেই তো পারে। ফলো করবার কি দরকার?

আমার কি মনে হয় জানো রমা—

কি?

তপন ঘোষ আমাকে কিছু বলতে চায়।

তপন ঘোষ! কে সে?

আমার সঙ্গে লোকটার পরিচয় ছিল। মানে তাকে আমি চিনতাম।

তা তার সঙ্গে একদিন দেখা করে কথাটা জিজ্ঞাসা করলেই পারো।

তার যে কোন উপায়ই আর নেই।

উপায় নেই! কেন? রমা বিস্ময়ের সঙ্গেই যেন তাকায় সুদীপের মুখের দিকে।

না। তপন ঘোষ মাস তিনেক হলো মারা গিয়েছে—পিস্তলের গুলিতে।

কি বলছো তুমি আবোল-তাবোল?

এই দেখো রমা, আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছে। আমি ঠিকই বলছি। এ তপন ঘোষ ছাড়া আর কেউ নয়।

রমা কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। তারপর বলল, রাত অনেক হয়েছে। এবারে শোবে চল।

আর এক পেগ হুইস্কি খাবে রমা? সুদীপ বলল।

না।

একটা কথা ভাবছি রমা।

কি?

কলকাতায় একটা ফ্ল্যাট কিনবো।

ফ্ল্যাট কিনবে কলকাতায়! কি বলছো? রমার কণ্ঠে বিস্ময় স্পষ্ট হয়ে ওঠে, অত টাকা তুমি পাবে কোথায়?

ফ্ল্যাট আমি দেখেছি—এখন হাজার দশেক মত দিতে হবে, তারপর বাকী চল্লিশ হাজার টাকা মাসে মাসে ত্রিশটা ইনস্টলমেন্টে—সে হয়ে যাবে।

কিন্তু ওই দশ হাজার টাকা কোথা থেকে আসবে? রমা আবার প্রশ্ন করে।

ব্যাঙ্কে কিছু আছে। কিছু ফিক্সড ডিপোজিট তোমার নামে আছে—আর বাকীটা ধার করবো বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে।

না না—এই তো বেশ আছি আমরা। ফ্ল্যাট নিয়ে কি হবে?

ফ্ল্যাটটা দেখলে তোমার খুব পছন্দ হবে দেখো। বালিগঞ্জে—একেবারে স্টেশনের কাছাকাছি। সাততলার উপরে। হু হু করে বাতাস বইতে থাকে সর্বক্ষণ। রাত্রে ট্রেনের শব্দ শুনতে পাবে। ট্রেন আসছে-যাচ্ছে–

না। ওসব ধার-কর্জের মধ্যে যেও না।

সত্যি রমা তোমার কোন অ্যামবিশন নেই। আমি কিন্তু ফ্ল্যাটটা কিনবো ঠিক করেছি।

দেখো ধার-কর্জর মধ্যে যেও না।

চল-শুইগে। সুদীপ গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে পড়ল।

০২. সুদীপের ঘুম আসে না

বিছানায় শুয়ে সুদীপের ঘুম কিন্তু আসে না। অন্ধকারে বালিশে মাথা রেখে সামনের খোলা জানালাটার দিকে চেয়ে থাকে।

সব টাকাটাই অবিশ্যি সে নগদ এখুনি দিয়ে দিতে পারে। কিন্তু তাহলে টাকাটার সোর্স নিয়ে গোলমাল বাধবে। ব্যাঙ্কে মাত্র হাজার তিনেক আছে আর ফিক্সড ডিপোজিটে আছে হাজার পাঁচেক হিসাবে মিলাতে পারবে না; বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে আর কত সে ধার পেতে পারে, বড়জোর হাজার দু-তিন। অথচ তার অফিসের ড্রয়ারের মধ্যে করকরে চল্লিশ হাজার টাকার নোট রয়েছে। ওই চল্লিশ আর ফিক্সড ডিপোজিটের পাঁচ ব্যাঙ্কের তিন—মাত্র হাজার দুই টাকা বেশী-সে তো অফিস থেকেই লোন পেতে পারে।

কিন্তু হিসাব মেলাতে পারবে না। চল্লিশ হাজার টাকা ধার দেবে কে তাকে? মাত্র তো তিনশো টাকা মাসমাহিনা তার।

না। রমা ঠিকই বলেছে। ফ্ল্যাট কেনার এখন দরকার নেই। ওই সময় আবার মনে পড়লো বিজিত মিত্রর কথা।

কাল একবার অফিসের পর বিজিতের অ্যাডভোকেট সোমনাথ ভাদুড়ীর সঙ্গে দেখা করবে। লোকটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেই যেন বুকের মধ্যে কেমন দুপদুপ করতে থাকে।

সুদীপ শুনেছে ক্রিমিন্যাল সাইডের একজন বাঘা অ্যাডভোকেট সোমনাথ ভাদুড়ী।

চশমার পুরু কাঁচের মধ্যে দিয়ে লোকটা যখন তাকায় মনে হয় যেন অপর পক্ষের পেট থেকে কথা টেনে বের করবেন। রোমশ জোড়া ভ্র। বয়েস প্রায় এখন সত্তরের কাছাকাছি। মাথার সব চুল সাদা হয়ে গিয়েছে।

বেঁটে-খাটো মানুষটা। কথা বলার সময় ডান হাতে ধরা পেনসিলটা দু আঙুলের সাহায্যে মধ্যে মধ্যে নাচান। ভরাট ভারী গলা।

কথা বললে মনে হয় যেন একটা জালার ভিতর থেকে কথাগুলো গম গম করে বের হয়ে আসছে।

সুদীপের সাক্ষ্য দেবার কথাটা বলতে শুনে মানুষটা এমনভাবে তার দিকে তাকিয়ে ছিলো যেন সুদীপ কত বড় অপরাধ করে ফেলেছে।

আপনি সাক্ষ্য দেবেন?

আজ্ঞে। মানে-হঠাৎ যেন তোতলাতে শুরু করেছিল সুদীপ সেদিন।

কি নাম আপনার বললেন যেন! রোমশ ভ্র-যুগলের নীচে চশমার পুরু লেন্সের ওধার থেকে তাকালেন সোমনাথ ভাদুড়ী।

সুদীপ রায়।

নিহত তপন ঘোষকে আপনি চিনতেন? প্রশ্ন এলো যেন তীক্ষ্ণ ছুরির ফলার মত বিদ্ধ করলো সুদীপকে।

না। তবে আসামী বিজিত মিত্রকে চিনি।

চেনেন? কতদিনের পরিচয় আপনাদের?

তা বলতে পারেন অনেক দিনের। বিজিত তপন ঘোষকে মারেনি। মানে হত্যা করেনি।

হত্যা করেনি?

না। আমার সব কথা শুনলেই বুঝতে পারবেন স্যার—ব্যাপারটা সব সাজানো বলেই আমার মনে হয়।

বলতে চান কনককটেড?

হ্যাঁ, মানে—

কি রকম।

সুদীপ তখন আদালতে যা পরে বলেছিল সেই কথাগুলো সোমনাথ ভাদুড়ীকে বলল। মন দিয়ে সুদীপের সব কথা শুনলেন সোমনাথ ভাদুড়ী।

হুঁ। তা এসব কথা আগে পুলিসকে জানাননি কেন?

ভয়ে।

কি বললেন? ভয়ে?

হ্যাঁ–বুঝতেই তো পারছেন খুনের মামলা। এই সব মামলায় কে সেধে জড়িয়ে পড়তে চায় বলুন, স্যার।

তবে আজকেই বা বলতে চান কেন?

একজন নির্দোষীর ফাঁসি হবে–

রোমশ ভ্রর তলায় পুরু লেন্সের ওধার থেকে কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন অতঃপর সোমনাথ ভাদুড়ী সুদীপের মুখের দিকে।

সুদীপের ওই মুহূর্তে মনে হয়েছিল সেই দৃষ্টির মধ্যে যেন সন্দেহ-অবিশ্বাস তার আপাদ-মস্তককে জরীপ করে চলেছে।

পাবলিক প্রসিকিউটার অম্বিকা সান্যাল-তার জেরার মুখে দাঁড়াতে পারবেন তো? তিনি আপনাকে পোস্টমর্টেম করবেন। বাঘা বাঘা সাক্ষীও তার জেরার মুখে নার্ভ হারায়।

যা সত্যি তা বলবোভয় পাবো কেন, আপনিই বলুন না স্যার।

ঠিক আছে, আদালতে একটা এফিডেবিট করতে হবে। যা করবার আমিই করবো। আপনার ঠিকানাটা রেখে যান। সময়মত সমন পাবেন।

সমন!

হ্যাঁ, সাক্ষীর সমন যাবে আদালত থেকে আপনার ঠিকানাটা বলুন।

সুদীপ তার অফিসের ঠিকানাই দিয়ে এসেছিল।

চলে আসবার আগে সোেমনাথ আবার শুধিয়েছিলেন, শেষ পর্যন্ত পিছিয়ে যাবেন না তো?

না, না।

সাক্ষীর কাঠগড়ায় দণ্ডায়মান সুদীপ রায়কে সরকারপক্ষের কৌসুলী অম্বিকা সান্যাল রীতিমত প্রশ্নে প্রশ্নে পর্যদস্ত করেছিলেন।

অম্বিকা সান্যাল প্রথমেই প্রশ্ন করেছিলেন, আপনি তো আদালতে জবানবন্দী দিয়েছেন, বিজিত মিত্র আসামীর মাথায় পশ্চাৎ দিক ঘেঁষে আঘাত করার সঙ্গে সঙ্গে তিনি মাটিতে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যান আর আপনি ছুটে পালান?

হ্যাঁ।

ছুটে কত দূরে পালিয়েছিলেন?

সামনেই একটা গলির মধ্যে।

সেটা ঘটনাস্থল থেকে কত দূরে?

হাত আট-দশ হবে সেই গলি থেকেই আত্মগোপন করে দেখি ব্যাপারটা পরে ওরা বিজিতকে একটা গাড়িতে তুলে নিয়ে চলে যায়।

অত রাত্রে আপনারা কোথা থেকে ফিরছিলেন? আপনি আগে বলেছেন রাত তখন দুটো হবে।

অফিসের ইয়ার-এনডিংয়ের সময় অনেক রাত পর্যন্ত তখন কাজ করতে হতো আমাদের কাজ সারতে সারতে প্রায় দেড়টা হয়ে যায়—ট্রাম-বাস-ট্যাক্সি তখন কিছুই ছিল না; তাই হেঁটে ফিরছিলাম দুজনে।

আপনি জানেন কি তপন ঘোষের সঙ্গে বিজিত মিত্র চোরাকারবারে লিপ্ত ছিল?

না।

আদালতে তা প্রমাণিত হয়েছে। আপনারা এক অফিসে একই ডিপার্টমেন্টে এতদিন কাজ করছেন, এত পরিচয় ছিল তার সঙ্গে আপনার, অথচ ওই কথাটা জানতেন না? জানতেন—সবই জানতেন—প্রকাশ করেননি কখনো।

ওই সময় সোমনাথ ভাদুড়ী বলে উঠেছিলেন, অবজেকশন, ইয়োর অনার।

জজ সাহেব কিন্তু অবজেকশন নাকচ করে বলেছিলেন, প্রসিড মিঃ সান্যাল।

তারপরই প্রশ্ন করেছিলেন অম্বিকা সান্যাল, যে পথ দিয়ে অত রাত্রে ফিরছিলেন সেদিন আপনারা দুই বন্ধু—নিশ্চয়ই জানতেন তার কাছাকাছি একটা কুখ্যাত পল্লী এবং সেখানে মৃণাল নামে বারবনিতা থাকতো। সেখানে বিজিতবাবুর রীতিমত যাওয়া-আসা ছিল।

না, আমি জানতাম না।

জানতেন না?

না।

ওই পথ দিয়ে আপনি আগে আর কখনো যাতায়াত করেছেন?

ঠিক মনে করতে পারছি না! বোধ হয় আগে কখনও যাইনি।

ওই রাত্রেই প্রথম তাহলে?

বলতে পারেন তাই। বিজিতবাবু বলেছিল ওই পথটা শর্টকাট হবে শেয়ালদহে যেতে, তাই ওই পথে যাচ্ছিলাম।

অত রাত্রে তাহলে ঠিক ঠিক ভাবে রাস্তার নামটা বললেন কি করে যদি ওই পথে কখনো আগে না গিয়ে থাকেন?,

বিজিত বলেছিল।

তা অত রাত্রে শেয়ালদহের দিকে যাচ্ছিলেন কেন?

মধ্যে মধ্যে ফিরতে বেশী রাত হলে ট্রেন থাকত না। ট্রেনের লাইন ধরে আমি হেঁটে চলে যেতুম বাড়ি। তাই–

কিন্তু বিজিতবাবু বাগবাজারে থাকতেন। তিনি ওই পথে যাচ্ছিলেন কেন?

আমাকে শেয়ালদা স্টেশন পর্যন্ত পৌঁছে দিতে।

আসলে সোমনাথ ভাদুড়ী বেশ করে তালিম দিয়েছিলেন সুদীপকে কয়েক দিন-নচেৎ সুদীপ নিঃসন্দেহে গোলমাল করে বসত জেরার মুখে।

 

বিজিতের সঠিক সংবাদ পেতে হলে তাকে একবার ওই সোমনাথ ভাদুড়ীর কাছেই যেতে হবে। একবার জানা দরকার কোর্টের রায় বের হয়েছে কিনা—আর না বের হলে কবে বেরুবে বা বেরুতে পারে জানা প্রয়োজন।

মৃণালের কথাও মনে পড়ে ঐ সঙ্গে সুদীপের। মৃণালের ঘরে যে বিজিতের যাতায়াত ছিল সেটা সুদীপ জানত। একদিন সেও গিয়েছিল মৃণালের ঘরেই বিজিতের সঙ্গেই। মৃণালকে সেও চিনত। অবিশ্যি কথাটা সে বরাবর চেপে গিয়েছে জটিলতা এড়াবার জন্যই। বস্তুত আদালতে গিয়ে বিজিতের হয়ে সাক্ষ্য দেবার কথা কখনো তার মনেও হয়নি। মামলায় জড়িয়ে পড়বার ভয়ে আদালতের ধার-কাছ দিয়েও প্রথমটা সে যায়নি।

নাঃ, ঘুম বোধ হয় আজ আর আসবে না।

সুদীপ শয্যার উপর উঠে বসল।

কপালের পাশে শিরা দুটো দপ দপ করছে।

পাশের ছোট টুলটার উপর থেকে সিগ্রেটের প্যাকেটটা ও লাইটারটা তুলে নিল সুদীপ। প্যাকেট থেকে একটা সিগ্রেট বের করে লাইটারের সাহায্যে অগ্নিসংযোগ করল।

সিগ্রেট টানতে টানতে সুদীপের মনের মধ্যে নানা কথা আনাগোনা করতে থাকে। আদালতে হলফ করে বলে এসেছে যে তপন ঘোেষকে সে চিনত না।

কথাটার সত্য-মিথ্যা আজ আর অবিশ্যি প্রমাণিত হবার কোন আশা নেই।

তপন ঘোষ আজ মৃত। পোস্টমর্টেমের পর তার মৃতদেহটা কেওড়াতলায় পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে।

রাত হয়ে গিয়েছিল মৃতদেহটা শ্মশানে নিয়ে যেতে। তপনের পাড়াপ্রতিবেশীরাই মৃতদেহটা শ্মশানে দাহ করতে নিয়ে গিয়েছিল।

সন্ধ্যা থেকে সেদিন আকাশ কালো করে বৃষ্টি নেমেছিল, প্রবল বৃষ্টি। কেউ জানে না, সুদীপ সর্বাঙ্গে একটা চাদর জড়িয়ে শ্মশানে গিয়েছিল—বাইরে একটা গাছের নীচে অন্ধকারে দাঁড়িয়েছিল। কেউ তাকে দেখতে পায়নি।

হঠাৎ কে একজন তার পাশে এসে দাঁড়াল। একটি স্ত্রীলোক, মাথায় দীর্ঘ গুণ্ঠন। প্রথমটায় সে জানতে পারেনি তার উপস্থিতি। জানতে পেরে কথা বলবার চেষ্টা করতেই স্ত্রীলোকটি সরে গিয়েছিল।

চকিতে যেন অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।

পরে ব্যাপারটা নিয়ে সুদীপ কোনরকম মাথা ঘামায়নি।

সুদীপ সিগ্রেট টানতে টানতে সেই রাত্রের কথাটাই ভাবতে থাকে।

 

পরের দিন অফিস-ফেরতা সুদীপ সোমনাথ ভাদুড়ীর ওখানে গেল। সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। বিরাট টেবিলটার উপর একরাশ কাগজপত্র ও মোটা মোটা আইনের বই ছড়ানো। ঠিক তার উল্টোদিকে একটা চেয়ারে বসে ছিল আর একজন দীর্ঘকায় ব্যক্তি। চশমার আড়াল থেকে বুদ্ধিদীপ্ত অনুসন্ধানী চোখের দৃষ্টি যেন অন্তর বিদ্ধ করে।

মাথার চুলে বেশ পাক ধরেছে। মুখে একটা জ্বলন্ত সিগার। পরনে পায়জামা ও পাঞ্জাবি, গায়ে একটা শাল জড়ানো। দুজনে মধ্যে মধ্যে কথা বলছিল।

ভৃত্য এসে ঘরে ঢুকলো, বাবু—

কি?

একজন ভদ্রলোক দেখা করতে চান।

কোথা থেকে আসছেন–কি নাম?

নাম বললেন সুদীপ রায়।

নামটা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই সোমনাথ ভাদুড়ীর চোখের দৃষ্টি যেন তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে। বললেন, যা, পাঠিয়ে দে।

এদিক-ওদিক তাকাতে তাকাতে সুদীপ এসে ঘরে ঢুকল।

আসুন-বসুন। সোমনাথ ভাদুড়ী বললেন।

স্যার, একটা সংবাদ নিতে এসেছিলাম।

কি সংবাদ?

বিজিতের মামলার রায় কি—

আজই বের হয়েছে রায়। বেকসুর খালাস পেয়েছেন আপনার বন্ধু।

পেয়েছে?

হ্যাঁ।

সুদীপবাবু!

বলুন।

বিজিতবাবু যে অপরাধী আমি জানতাম—হঠাৎ বললেন সোমনাথ ভাদুড়ী।

আজ্ঞে? থতমত খেয়ে যায় সুদীপ।

আপনি তাকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন মিথ্যা সাক্ষী দিয়ে।

না, না। আমি—

আপনার স্টোরিটা আগাগোড়াই কনককটেড। আপনি নিশ্চয়ই ভাবছেন সব বুঝেও আপনাকে দিয়ে মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়ালাম কেন, তাই না?

ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে তখন সুদীপ সোমনাথ ভাদুড়ীর মুখের দিকে। বোবা, অসহায় দৃষ্টি।

আপনি বলেছেন তপন ঘোষকে আপনি চিনতেন না। বাট আই অ্যাম শিয়োর, আপনি তাকে চিনতেন; ভাল করেই চিনতেন।

সুদীপ বোবা।

আপনাকে আমি তবু সব জেনেশুনেও কেন আদালতে সাক্ষী দেওয়াতে নিয়ে গিয়েছিলাম জানেন? নট ফর ইউ। একটি নিরাপরাধিনী মেয়ে আমাকে বাবা বলে আমার পায়ের উপর কেঁদে পড়ে তার স্বামীর প্রাণ বাঁচাতে বলেছিল বলে-শুধু সেই মেয়েটির জন্যই। যান—আর কখনো আমার ঘরের দরজা মাড়াবেন না—যান–

সুদীপ উঠে দাঁড়িয়েছে ততক্ষণে।

বুকটার মধ্যে তখন তার যেন হিম হয়ে গিয়েছে। গলাটা শুকিয়ে কাঠ।

যান।

সুদীপ ঘর থেকে বের হয়ে গেল। আর সেইদিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ সোমনাথ, ভাদুড়ী। তারপর এক সময় ফিরে তাকালেন সোমনাথ ভাদুড়ী তার সামনে উপবিষ্ট ভদ্রলোকটির দিকে এবং বললেন, আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন রায় মশাই, এই সেই লোক যার মিথ্যা সাক্ষ্যের জোরে শেষ পর্যন্ত মেয়েটির স্বামীকে আমি কঁসির দড়ি থেকে বাঁচাতে পেরেছি—নচেৎ আইন তাকে এমনভাবে কোণঠাসা করেছিল যে আমিও প্রায় হাল ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলাম। কিন্তু সত্যিই যদি জানতে পারতাম–

কে সে রাত্রে তপন ঘোষকে হত্যা করেছিল সেটাই তো? কিরীটী বলল।

হ্যাঁ রায় মশাই।

আপনার কি মনে হয় বলুন আগে শুনি। আপনি নিশ্চয়ই একটা কিছু ভেবেছেন— কিরীটী বলল।

আমার মনে হয়—

বলুন।

সে-রাত্রে তপন ঘোষকে কে হত্যা করেছিল সম্ভবত সেটা ওই সুদীপ জানে।

কেন কথাটা মনে হলো আপনার মিঃ ভাদুড়ী? কিরীটী বলল।

দেখুন রায় মশাই, সোমনাথ ভাদুড়ী বললেন, জীবনের অনেকগুলো বছর এই ক্রিমিন্যালদের নিয়ে ঘাঁটাঘাটি করছি। ক্রিমিন্যালদের চরিত্রের নানাদিক দেখার আমার সৌভাগ্য হয়েছে—অনেক ক্রিমিন্যালকে আদালতে জেরা করে আইনের মারপ্যাচে জেলখানা ও ফাঁসির দড়ি থেকেও বাঁচিয়ে দিয়েছি। মিথ্যা বলব না, তাতে করে এক ধরনের ভ্যানিটিরও আস্বাদ হয়ত পেয়েছি অনেক সময়। কিন্তু–

কি? সহাস্যে কিরীটী তাকাল সোমনাথ ভাদুড়ীর দিকে প্রশ্নটা করে।

মানুষের বিবেক বলে যে বস্তুটি মনের মধ্যে আছে, তার কাছে আমাকে জবাবদিহি দিতে হয়েছে। কিন্তু এই কেসটা যেন অন্য ধরনের। বিজিত মিত্র যে নিরপরাধ, মনে মনে। কথাটা আমি হয়ত বিশ্বাস করেছিলাম—কিন্তু কেসের প্রমাণাদি তাকে এমনি কোণঠাসা করে দিয়েছিল যে আমি যেন আমার সামনে কোন পথই খুঁজে পাচ্ছিলাম না। আইনের সাহায্যে কোন্ পথ ধরে লোকটাকে মুক্ত করে আনতে পারি, ওই সঙ্গে বিজিত মিত্রের স্ত্রীর চোখের জল আর কাকুতি আমাকে যেন অস্থির করে তুলেছিল। এমন সময় ওই স্কাউনড্রেলটা এলোবাধ্য হয়েই কতকটা ওকে আমি গ্রহণ করলাম বিজিত মিত্রকে বাঁচাবার জন্যই। কিন্তু মনের কাছে কিছুতেই যেন সহজ হতে পারলাম না।

ভাদুড়ী মশাই, কিরীটী বললে, সব সময়ই আমাদের মন কি সত্য কথা বলে! এমনও তো হতে পারে আপনি যা ভাবছেন তা সত্য নয়। সত্য হয়ত বিজিত মিত্র হত্যাকারী নয়।

কিন্তু কিরীটী বলতে লাগল, ওই সুদীপ রায় লোকটি সত্যিই তার বন্ধুকে বাঁচাবার জন্য আন্তরিকভাবে সচেষ্ট ফাঁসির দড়ি থেকে?

ভেবেছি, আমি অনেক ভেবেছি কথাটা রায় মশাই-কিন্তু তবু আপনি যা বলছেন সেটা মেনে নিতে যেন পারিনি।

কিরীটী মৃদু হেসে বললে, ঠিক আছে। যদিও অনেকটা দেরি হয়ে গিয়েছে, আমাদের একটিবার চেষ্টা করে দেখতে কোন ক্ষতি নেই। মামলার সমস্ত রিপোর্টই তো শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আপনার কাছে আছে।

হ্যাঁ  আছে—সম্পূর্ণ মামলার নথিটা আমি একটা ফাইল করে রেখেছি আপনার এখানে আসবার পূর্বে। এই সেই নথি—বলে একটা বিরাট ফাইল এগিয়ে দিলেন সোমনাথ ভাদুড়ী কিরীটীর দিকে।

কিরীটী হাত বাড়িয়ে ফাইলটা টেনে নিল।

ভাদুড়ী আবার বললেন, আমি জানি ওই ফাইলটা খুঁটিয়ে পড়লেই হয়ত আসল সত্যটা আপনার দৃষ্টির সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠবে।

কিরীটী বললে, রাত হলো, তাহলে উঠি ভাদুড়ী মশাই।

উঠবেন?

হ্যাঁ।

কিরীটী উঠে দাঁড়াল।—একপক্ষে ভালই হলো। ঘটনাচক্রে লোকটিও আজ আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। তবে এটুকু অস্পষ্ট নেই আমার কাছে যে, বিজিত মিত্র ছাড়া পেল কিনা কেবল সে কথাটুকু আপনার মুখ থেকে শোেনবার জন্যই আজ লোকটি এখানে আসেনি।

সত্যি বলছেন?

হ্যাঁ  মামলার রায় যে এখনো বের হয়নি সেটা অনুমান করতে পেরেছিল, আর রায় বেরুলে সেটাও সে খবরের কাগজে প্রকাশিত সংবাদ থেকেই একদিন-না-একদিন জানতে পারত। লোকটা কেন এসেছিল জানেন ভাদুড়ী মশাই?।

কেন?

আপনি নিজে তার সাক্ষ্যদানের ব্যাপারটা কি ভাবে নিয়েছেন সেটাই জানবার জন্য।

সত্যি বলছেন?

মনে তো হয় তাই। আচ্ছা চলি—

কিরীটী গাড়িতে উঠে বসল। সর্দারজী গাড়ি ছেড়ে দিল।

সোমনাথ ভাদুড়ী কিন্তু আরো কিছুক্ষণ দোরগোড়ায় দাঁড়িয়েই রইলেন।

০৩. গৃহে ফিরতেই কৃষ্ণা শুধাল

গৃহে ফিরতেই কৃষ্ণা শুধাল, হঠাৎ সোমনাথ ভাদুড়ী তোমাকে ফোন করে ডেকেছিলেন কেন?

কিরীটী মৃদু হেসে বললে, চল, আগে খেয়ে নেওয়া যাক।

আহারাদির পর দুজনে এসে বসবার ঘরে দুটো সোফায় মুখখামুখি বসল।

জংলী এসে দুকাপ কফি রেখে গেল। কফির পাত্র শেষ করে কিরীটী একটা সিগারে অগ্নিসংযোগ করল।

বাইরে শীতের রাত্রি-ঝিমঝিম করছে যেন।

কিরীটী একসময় বললে, ভাদুড়ী মশায় একটা খুনের মামলার ব্যাপারে আমাকে ডেকেছিলেন। তবে আদালতে একপ্রস্থ ব্যাপারটার চরম নিষ্পত্তি হয়ে গিয়েছে—মানে আজ আদালত তার রায় দিয়েছে। হত্যাকারী বলে যে ব্যক্তি ধৃত হয়েছিল—দীর্ঘদিন ধরে যার বিচার হয়েছে—আদালত তাকে সম্পূর্ণ নির্দোষ বলে মুক্তি দিয়েছে।

তবে?

সেই তবেই ভাদুড়ী মশায়ের প্রশ্ন, কৃষ্ণা।

বুঝলাম না ঠিক। কৃষ্ণা বলল।

মামলায় আসামীর বিরুদ্ধে এমন সাক্ষ্য-প্রমাণাদি ছিল যে সোমনাথ ভাদুড়ীর মত উঁদে লইয়ারও হালে পানি পাচ্ছিলেন না। এমন সময় এক সাক্ষীর আবির্ভাব–

কি রকম?

সে এসে সোমনাথ ভাদুড়ীকে বলল, আসামী নির্দোষ—সে সাক্ষী দেবে। সোমনাথ ভাদুড়ী কিন্তু খুশি হলেন না—যদিও আসামীর স্ত্রী চোখের জলের মিনতিতে তিনি তখন। রীতিমত বিচলিত–আপ্রাণ চেষ্টা করছেন আইনের কোন ফাঁক বের করতে, যাতে করে আসামীকে মুক্ত করে আনতে পারেন।

তারপর–

আসামী ওই লোকটির সাক্ষ্যর জোরেই শেষ পর্যন্ত মুক্তি পেল কিন্তু ভাদুড়ী মশাইয়ের মনের মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব থেকে গিয়েছে।

কিসের দ্বন্দ্ব? সাক্ষী যা বলছে তা পুরোপুরি সত্য নয়। দেখ, যা বুঝলাম, তা হচ্ছে—

কি?

ওই সাক্ষীকেই সোমনাথ ভাদুড়ী সন্দেহ করছেন।

সত্যি?

হ্যাঁ।

ওই ফাইলটা বোধ হয় সেই মামলার? কৃষ্ণা শুধালো।

হ্যাঁ।

রাত্রের ঘুমও তাহলে গেল আজ—

না, না—তুমি শুয়ে পড়গে কৃষ্ণা—আমি ফাইলগুলো একটু উল্টেই আসছি।

ঠিক আছে। বেশী দেরি করো না কিন্তু!

কিরীটী সহধর্মিণীর দিকে তাকিয়ে একটু হাসল।

ফাইলের টাইপ করা পৃষ্ঠাগুলো ওল্টাতে ওল্টাতে অন্যমনস্কভাবে একটা পাতায় এসে তার দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো।

আদালতের প্রশ্ন : আপনার নাম?

উত্তর : শ্ৰীমতী দেবিকা মিত্র।

আসামীর কাঠগড়ায় যে দাঁড়িয়ে আছে তাকে আপনি চেনেন?

চিনি। আমার স্বামী।

কতদিন আপনাদের বিবাহ হয়েছে?

সাত বছর।

ছেলেপুলে?

না। কোন সন্তান হয়নি আদৌ।

সন্তান চান না আপনারা?

চাই বৈকি।

তা কোন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেননি?

নিয়েছিলাম। ডাঃ গোরাদ নন্দী, স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ।

তিনি কি বলেছিলেন পরীক্ষা করে?

বলেছিলেন—

বলুন।

আমাদের নাকি কখনো কোন সন্তানাদি হবার আশা নেই।

কেন?

তা তিনি বলেননি।

 

কিরীটী দ্রুত কয়েকটা পৃষ্ঠা উল্টে গেল। নিশ্চয়ই আদালত ডেকেছিল ডাঃ নন্দীকে তার সাক্ষ্য দেবার জন্য। তার অনুমান মিথ্যা নয়।

পাওয়া গেল—-ডাঃ নন্দী তার পুরাতন রেকর্ড দেখে বলেছেন, ওদের সন্তান হবার কোন সম্ভাবনাই ছিল না। কারণ-বিবাহের আগেই বিজিত মিত্র কুৎসিত এক রোগে আক্রান্ত হয়েছিল কিন্তু তখন চিকিৎসা করেননি ভদ্রলোক—ফলে সেই রোগ স্ত্রীর দেহে সংক্রামিত হয়, পরে অবিশ্যি বেশ কিছুদিন পরে চিকিৎসা করান দুজনই। কিন্তু ঐ রোগ যা ক্ষতি করবার করে দিয়েছিল—স্বামীর প্রজনন-শক্তি সম্পূর্ণভাবে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল।

আদালতের প্রশ্ন, আপনি কথাটা বলেননি ওদের?

স্বামীকে বলেছিলাম।

চিকিৎসা কোনরকম করেননি?

করেছিলাম কিন্তু কোন ফল হয়নি।

লোকটির চরিত্র কিরীটীর চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কিরীটী একটা সিগারে নতুন করে অগ্নিসংযোগ করে।

দেওয়াল-ঘড়িটা ঢং করে একটা শব্দ তুলে থেমে গেল সময়ের সমুদ্রে।

বাইরে শীতের ঝিমঝিম রাত।

কিরীটী আবার অন্যমনস্কভাবে ফাইলের পাতা ওল্টাতে থাকে আর মনের মধ্যে তার অলক্ষ্যে একটা অদেখা মানুষের ছবি যেন একটু অন্ধকারে স্পষ্ট আকার নিতে থাকে, আজ রাত্রেই সোমনাথ ভাদুড়ীর মুখ থেকে শোনা কাহিনী থেকে।

মানুষটার চেহারা–সোমনাথ ভাদুড়ী বলেছিলেন, অত্যন্ত সাদামাটা-মোস্ট আনইমপ্রেসিভ যাকে বলে। গাল দুটো ভাঙা কিছুটা যেন গর্তে ঢোকানো। পাতলা ভ্র। গোল বর্তুলাকার দুটি চক্ষু। কিন্তু চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ। গালের হনু দুটো বদ্বীপের মত যেন ঠেলে উঠেছে।

মাথায় পাতলা চুল। শরীরটার উপর মনে হয় অনেক অত্যাচার হয়েছে।

কিন্তু আপনাকে তো আগেই বলেছি রায়মশাই, ওই হত্যা-মামলা আমার হাতে নেবার কোন সম্ভাবনাই ছিল না, নিতামও না, কিন্তু মেয়েটি এসে হঠাৎ একদিন আমার চেম্বারে দুপা জড়িয়ে ধরে কেঁদে পড়ল।

কে? কি ব্যাপার? আরে, উঠুন—উঠুন।

আমার স্বামীকে আপনি বাঁচান, বাবা।

উঠুন—বলুন কি হয়েছে আপনার স্বামীর?

না। আগে বলুন দয়া করবেন।

কি হয়েছে আপনার স্বামীর?

খুনের মামলার আসামী সে আজ।

খুনের মামলা!

হাঁ বাবা, আমার স্বামীর চরিত্রের মধ্যে যত দোষই থাক—সে ওই তপন ঘোষকে খুন করেনি।

উঠে বসুন। ব্যাপারটা আমাকে খুলে বলুন।

আগে আমাকে কথা দিন।

ঠিক আছে, তুমি উঠে বসো।

মেয়েটি উঠে বসে মাথার ঘোমটা খুলে দিল। বয়স ত্রিশ-বত্রিশ হবে—কিন্তু মধ্যযৌবন অতিক্রান্ত হতে চললেও যেমন এখনও দেহের বাঁধুনি, তেমনি রূপ, রূপের যেন। অবধি নেই। দুচোখে অবিরত অশ্রু ঝরে চলেছে।

মেয়েটি বলল, বাবা, এ সংসারে আমার আর কেউ নেই—ওই স্বামী ছাড়া। গরীবের মেয়ে। দয়া করে উনি আমাকে বিয়ে না করলে হয়ত শেষ পর্যন্ত রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভিক্ষে করতে হতো—কিংবা—

কি নাম তোমার স্বামীর?

বিজিত মিত্র–

সোমনাথ ভাদুড়ীর মনে পড়লো মাত্র কয়েকদিন পূর্বেই আদালতে এক অ্যাডভোকেটের মুখে শুনেছিলেন ওই কেসটা সম্পর্কে।

বিচার চলেছে তার আদালতে।

মেয়েটি তখন আবার বলল, বাবা, আপনার ফিস দেবার ক্ষমতা আমার নেই। তবু এসেছি আপনার কাছে—এই গরীবকে দয়া করুন।

সোমনাথ ভাদুড়ী বলেছিলেন, তুমি দুদিন বাদে এসো।

বাবা! ব

ললাম তত দিন দুই বাদে এসো।

মেয়েটির হাতে দুগাছি সোনার বালা ছিল। সে দুটি হাত থেকে খুলতে দেখে সোমনাথ ভাদুড়ী বাধা দিলেন, কি করছো–

মেয়েটি বলল, বাবা, এই বালা জোড়া রাখুন; এ দুটো বেচে–

না—ও তুমি হাতে পরে নাও, কোন টাকা-পয়সা লাগবে না তোমার। কি নাম তোমার?

দেবিকা।

মেয়েটি সোমনাথ ভাদুড়ীর পায়ের ধুলো নিয়ে চলে গেল।

সোমনাথ ভাদুড়ী পরে বলেন, পরের দিন আদালতের যে ঘরে মামলাটা চলছিল সেই ঘরে গিয়ে ঢুকলাম। আসামীর কাঠগড়ায় লোকটা দাঁড়িয়েছিল, ভেরি ফারস্ট শাইটেই আমার মনে হয়েছিল রায়মশাই, লোকটা দুশ্চরিত্র এবং যে কোন ক্রাইমই ওর দ্বারা সম্ভব। ভাঙা গাল, হনু দুটো ঠেলে উঠেছে? বাঁদিককার গালে একটা জজুল আছে—সেই জড়লে গোটা দুই বড় বড় লোম।

কিরীটী মনে মনে ভাবে, ভাদুড়ী মশাইয়ের অনুমান হয়ত মিথ্যা নয়, তপন ঘোষকে যখন হত্যা করা হয় সেরাত্রে ওই বিজিত হয়ত সেখানে উপস্থিত ছিল।

মৃণাল মেয়েটি একটি বারবনিতা। দুশ্চরিত্রা মেয়ে।

অনেকেই রাত্রে তার ঘরে যেত। তাদের দলে হয়ত বিজিত, সুদীপ ও তপন ঘোষ ছিল। তারাও হয়ত ওই মৃণাল নামে বারবনিতার ঘরে যাতায়াত করত।

সুদীপ যে তার জবানবন্দিতে বলেছে তপন ঘোষকে সে চিনত না, কথাটা হয়ত মিথ্যা মামলার সঙ্গে জড়িয়ে পড়বার ভয়েই হয়ত সুদীপ সত্য কথাটা প্রকাশ করেনি।

তাছাড়া সত্যিই যদি সুদীপ সম্পূর্ণ নির্দোষ থাকত—বন্ধু ও সহকর্মীকে বাঁচানোর জন্য সে অনেক আগেই বিজিতের নির্দোষিতা প্রমাণের চেষ্টা করত।

সম্ভবত ওই খুনের ব্যাপারে সুদীপ জড়িত ছিল বলেই কোন-না-কোন ভাবে প্রথমটায় সে আদালতের ধারে-কাছেও যায়নি।

পরে যে সে সোমনাথ ভাদুড়ীর কাছে গিয়ে সাক্ষী দেবার কথা বলেছে ওই মামলায়, তার পশ্চাতেও হয়ত কোন কারণ ছিল।

কোন গুঢ় স্বার্থ!

যাহোক, স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে সুদীপ এবং বিজিত দুজনাই ওই হত্যা মামলার সঙ্গে জড়িত।

ওই হত্যা-মামলায় সবচাইতে বড় প্রশ্ন হচ্ছে ওই বারবনিতা মেয়েটি—মৃণাল।

গুলির শব্দের পর পাশের ঘরের লোকেরা ভীত হয়ে পুলিসকে খবর দেয়। পুলিস এসে দেখে তপন ঘোষ মৃত, রক্তাক্ত গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পড়ে আছে আর তার পাশে। জ্ঞানহীন হয়ে পড়ে আছে বিজিত মিত্র।

তার জামা কাপড়ে রক্তের দাগ। হাতে ধরা পিস্তল একটি, সে পিস্তল থেকে গুলি চালিয়েই তপন ঘোষকে হত্যা করা হয়েছিল এবং ঘরের মধ্যে মৃণাল নামে মেয়েটি নেই।

মৃণাল একেবারে উধাও।

কোথায় গেল মৃণাল?

সে কি পালিয়েছে না কারোর পরামর্শে কোথাও গা-ঢাকা দিয়ে আছে? যদি কারো পরামর্শেই গা-ঢাকা দিয়ে থাকে তো কার পরামর্শে?

পুলিস নাকি এখনো চারিদিকে মৃণালকে খুঁজে বেড়াচ্ছে।

সোমনাথ ভাদুড়ীর ধারণা—মৃণাল হত্যাকারী নয়। তবে সম্ভবত মৃণাল হয়ত হত্যা করতে দেখেছে।

কিগো, আজ কি শুতে যাবে না?

কৃষ্ণার গলা শুনে কিরীটী তাকাল কৃষ্ণার মুখের দিকে।

কিরীটী বলল, অনেক রাত হয়েছে, না!

অনেক রাত মানে-সোয়া তিনটে বাজে।

বল কি!

চল! এবারে একটু শোবে চল।

আর কি ঘুম হবে কৃষ্ণা, বেড়াতে বেরুবার সময় হলো।

সারাটা রাত না ঘুমিয়ে এখন বেড়াতে বেরোবে! কৃষ্ণা বললে।

তাহলে আজ আর না হয় না-ই বেড়াতে বেরুলাম। জংলীকে বললা কফি দিতে।

কৃষ্ণা কোনো কথা বললো না, ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

জংলীকে তোলেনি কৃষা, নিজেই কফি করে নিয়ে এল দুকাপ।

কফির কাপটা কিরীটীর হাতে তুলে দিয়ে মুখোমুখি অন্য একটা সোফায় বসলো কৃষ্ণা।

রাত্রিশেষের ঠাণ্ডা হাওয়া ঘরের মধ্যে এসে ঢোকে। হাওয়ায় এখনো বেশ শীতের আমেজ আছে—যদিও ফাল্গুন মাস পড়ে গিয়েছে।

কফির কাপে চুমুক দিয়ে কৃষ্ণা বললে, দেখ ভাবছিলাম, কিছুদিনের জন্য এ সময় বেনারস গিয়ে ঘুরে এলে কেমন হয়, ঠাণ্ডা আছে কিন্তু তীব্রতা নেই।

তা মন্দ হয় না–কিন্তু–

ভাদুড়ী মশাইয়ের মামলার কথা ভাবছো?

হ্যাঁ। মানে—

ওখানে বসেই না হয় ভাববে।

কেবল ভাবলেই তো হবে না, একটা কনকুশনে পৌঁছতে হবে তো?

কৃষ্ণা হেসে বললে, বাবা বিশ্বনাথের চরণে বসে দেখো, তোমার কনক্লশন ঠিক এসে যাবে। তাছাড়া–

কি, থামলে কেন, বল। কথাটা বলে কিরীটী কৃষার মুখের দিকে তাকাল।

তোমার কাহিনীর ঐ মৃণাল মেয়েটি—এমনও তো হতে পারে শেষ-মেশ গিয়ে ঐ বিশ্বনাথের চরণেই আশ্রয় নিয়েছে

মৃণালের জন্য আমি তত ভাবছি না কৃষ্ণা।

ভাবছে না!

না। ঘটনাস্থলে সে ছিলই সে-রাত্রে। কাজেই নিহত তপন ঘোষের দু-এক ফোটা রক্ত কি তার গায়ে আর লাগেনি! লেগেছে নিশ্চয়ই—সে-রক্তের দাগ সে মুছবে কেমন করে। সেই রক্তের দাগ থেকেই ঠিক তাকে আমি চিনে নিতে পারবো। যাকগে সে কথা। তুমি টিকিটের ব্যবস্থা করো-আমরা যাবো।

ঠিক তো?

ঠিক।

 

পরের দিন বিকালে।

কিরীটী আবার গোড়া থেকে মামলার কাগজগুলো পড়ছিল—সোমনাথ ভাদুড়ী আদালত-ফেরতা এসে কিরীটীর গৃহে হাজির হলেন।

আসুন আসুন ভাদুড়ী মশাই। মনে হচ্ছে কোন সংবাদ আছে।

ভাদুড়ী একটা সোফায় বসতে বসতে বললেন, সংবাদটা বোধ হয় তেমন কিছু নয় রায়মশাই। তবু মনে হলো—আপনাকে যাবার পথে জানিয়ে যাই—তাই এলাম।

কিরীটী সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকাল ভাদুড়ী মশাইয়ের দিকে।

আজ দুপুরে আদালতে বিজিতের স্ত্রী—

কে, দেবিকা—

হ্যাঁ। দেবিকা এসেছিল আমার কাছে।

কেন?

বিজিত নাকি ঘরে ফিরে যায়নি জেল থেকে খালাস পাবার পর।

যায়নি।

না। সে জানত না বিজিত ছাড়া পেয়েছে। আজ আলিপুর সেনট্রাল জেলে তার স্বামীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে জানতে পারে গতকালই বিকালের দিকে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে আদালতের রায় বেরুবার পরই বেলা পাঁচটা নাগাদ। কিন্তু আজও সে ঘরে ফেরেনি—তাই দেবিকা এসেছিল আদালতে আমার সঙ্গে দেখা করতে। আমি তখন সেনট্রাল জেলে অমিয়নাথবাবুকে ফোন করি।

তিনি কি বললেন?

জেল-গেটের অদূরে একটা ট্যাক্সি নিয়ে এক ভদ্রমহিলা নাকি অপেক্ষা করছিলেন—

ভদ্রমহিলা।

জেলের প্রহরী সেইরকমই বলেছে। ভদ্রমহিলার মাথায় নাকি ঘোমটা ছিল। গায়ে একটা ব্লু রঙের ব্যাপার ছিল।

তারপর–

বিজিত মিত্র জেল থেকে বেরিয়ে যখন রাস্তার দিকে চলেছে, ভদ্রমহিলা ট্যাক্সি থেকে নেমে বিজিতের নাম ধরে ডাকতেই সে সোজা গিয়ে ট্যাক্সিতে নাকি উঠে বসে। ট্যাক্সিটা ছেড়ে দেয় সঙ্গে সঙ্গে।

ট্যাক্সি–গুনবতী মহিলা।

হ্যাঁ।

কিন্তু সেই মহিলা ঠিক ওই সময়ই বিজিত মিত্রকে ছাড়া হবে জানলেন কি করে? কিরীটীর প্রশ্ন।

ঐ ভদ্রমহিলাই কিনা জানা যায়নি, তবে আগের দিন নাকি এক ভদ্রমহিলা বেলা পাঁচটা নাগাদ এসেছিলেন জেলখানায়—জেলারের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। জেলারের মুখ থেকেই নাকি সে শুনেছিল আদালতের রায়ে তাকে মুক্তি দিলেই তাকে ছেড়ে দেওয়া হবে জেল থেকে।

মামলার রায় পরের দিনই বেরুবে আপনার অমিয়বাবু কি জানতেন?

জানতেন আর এ-ও জানতেন বিজিত মিত্র বেকসুর খালাস পাবে।

কি করে জানলেন?

আমিই বলেছিলাম। আপনি?

হ্যাঁ। অমিয়বাবু যেদিন রায় বের হয় তার আগের দিন সকালে আমাকে ফোন করেছিলেন।

আশ্চর্য!

কি?

হঠাৎ অমিয়বাবু আপনাকে ফোন করতে গিয়েছিলেন কেন, বিশেষত ওই বিচারাধীন কয়েদী সম্পর্কে! কথাটা তাকে জিজ্ঞাসা করেননি?

না।

কিরীটী ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে। বললে, চলুন।

কোথায়?

অমিয়বাবুর কোয়ার্টারে তার সঙ্গে একবার দেখা করে আসি।

বেশ, চলুন। কিন্তু এখুনি যাবেন?

হ্যাঁ।

সোমনাথ ভাদুড়ী উঠে দাঁড়ান।

 

জেলের নিকটেই অমিয়বাবুর কোয়ার্টার। অমিয়বাবু গৃহেই ছিলেন। সোমনাথ ভাদুড়ী কিরীটীকে নিয়ে এসে তার গৃহে প্রবেশ করলেন।

অমিয় চক্রবর্তী তার বসবার ঘরে বসে ওইদিনকার সংবাদপত্রটা পড়ছিলেন। বয়স্ অনুমান চল্লিশ থেকে বিয়াল্লিশের মধ্যে হবে তার।

বেশ হৃষ্ট-পুষ্ট গোলগাল চেহারা। একজোড়া বেশ ভারী গোঁফ। লম্বা জুলপী। জুলপীর চুলে কিছু কিছু পাক ধরেছে। চোখে চশমা।

সোমনাথ ভাদুড়ীকে ঘরে প্রবেশ করতে দেখে সহাস্যে সম্বোধন করলেন, মিঃ ভাদুড়ী যে—আসুন—আসুন। তারপরই কিরীটীর প্রতি নজর পড়াতে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালেন।

পরিচয় করিয়ে দিই অমিয়বাবু

অমিয়বাবু বললেন, পরিচয় করিয়ে দিতে হবে না মিঃ ভাদুড়ী। সাক্ষাৎ পরিচয় না থাকলেও ওঁকে আমি চিনি। আজ ওঁকে চেনে নাই বা কে? কিরীটীবাবু, বসুন-বসুন।

সোমনাথ ভাদুড়ী ও কিরীটী উপবেশন করে।

অমিয়বাবু! সোমনাথ বললেন।

বলুন–

তপন ঘোষ হত্যা মামলার আসামী বিজিত মিত্রকে কাল বিকালে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে?

হ্যাঁ—আপনাকে তো সে-কথা বলেছি।

সেজন্য আমরা আসিনি অমিয়বাবু। এসেছি অন্য একটা ব্যাপারে, কিরীটী এবার কথা বললে।

কি বলুন তো?

পরশু, মানে বিজিতবাবুকে যেদিন ছেড়ে দেওয়া হয় তার আগের দিন এক ভদ্রমহিলা আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন?

হ্যাঁ—আমার কোয়ার্টারে—বিজিতবাবুর সম্পর্কেই জিজ্ঞাসা করতে। মানে যদি সে আদালত থেকে মুক্তি পায় তো কখন তাকে ছেড়ে দেওয়া হতে পারে সেটাই জানতে।

সেই মহিলার ঠিক বয়স কত হবে বলে আপনার মনে হয় অমিয়বাবু? প্রশ্ন করল কিরীটী।

বোধ হয় ত্রিশ-বত্রিশ হবে। দোহারা পাতলা চেহারা, বেশ সুন্দর দেখতে। পরনে একটা দামী শাড়ি, পায়ে চপ্পল।

আচ্ছা অমিয়বাবু, তার চেহারার মধ্যে বিশেষ কিছু আপনার নজরে পড়েছিল কি? কিরীটী প্রশ্ন করল।

না। সেরকম তো কিছু মনে পড়ছে না। তবে—

কি? কিরীটী সোৎসুক ভাবে তাকাল অমিয়বাবুর মুখের দিকে।

আমার নজরে পড়েছিল তার বাঁ হাতে উল্কিতে লেখা ছিল একটা ইংরেজী অক্ষর এম।

এম! কথাটা মৃদু গলায় উচ্চারণ করে কিরীটী সোমনাথের দিকে তাকাল।

হ্যাঁ। অমিয়বাবু বললেন।

আর কিছু তার মুখের ঢংটা?

না। তার মুখটা আমি দেখতে পাইনি।

কেন?

মুখে ঘোমটা ছিল। চিবুকটা কেবল নজরে পড়েছে। উপরের ও নীচের ঠোট ও চিবুকের কিছুটা অংশ।

তার চলার বা বসবার—দাঁড়াবার ভঙ্গি?

না, আমি সেটা তেমন লক্ষ্য করিনি কিরীটীবাবু। আর তিনি বসেননি—আগাগোড়া। দাঁড়িয়েই ছিলেন মুখে ঘোমটা টেনে। মনে হচ্ছিল তিনি যেন আত্মপ্রকাশে অনিচ্ছুক।

তার নামটা জিজ্ঞেস করেননি? কোন পরিচয় দেন নি?

নাম বলেননি। আমি জিজ্ঞাসাও করিনি। তবে অবিশ্যি বলেছিলেন তিনি বিজিতবাবুর স্ত্রী।

কিরীটী সোমনাথ ভাদুড়ীর দিকে তাকাল।

দুজনের মধ্যে দৃষ্টি বিনিময় হলো।

চলুন ভাদুড়ী মশাই, এবার যাওয়া যাক। কিরীটী বললে।

 ০৪. অমিয়বাবুর কাছ থেকে বিদায়

ধন্যবাদ জানিয়ে অমিয়বাবুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে দুজনে বের হয়ে এলেন।

গাড়িতে উঠতে উঠতে কিরীটী বললে, আপনি তো দেবিকাকে দেখেছেন ভাদুড়ী মশাই?

হ্যাঁ। আজও তো মেয়েটি আদালতে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। কখনো সে মাথায় ঘোমটা দিয়ে আসেনি। তাছাড়া তার হাতে কোন উল্কি দেখিনি। তার রং অবিশ্যি। ফর্সাই। আমার মনে হয় সে দেবিকা নয় রায় মশাই।

আমারও তাই অনুমান। কিরীটী বললে, তাই ভাবছি কে হতে পারে মেয়েটি?

ভাদুড়ী মশাই!

বলুন।

মৃণালের চেহারার কোন ডেসক্রিপশন আপনার জানা আছে?

মেয়েটিকে তো আমরা কেউ দেখিনি।

আচ্ছা ঘটনার দিন পাশের ঘরে যে ভদ্রলোক ও মেয়েটি ছিল?

অবিনাশ সেন আর মিনতি দত্ত।

মেয়েটির নাম মিনতি দত্ত?

হ্যাঁ।

সে মেয়েটি তো মৃণালের পাশের ঘরেই থাকত। সেও রূপোপজীবিনী ছিল।

তার সাক্ষ্যও তো নেওয়া হয়েছে আদালতে।

জানি। আমি বলছিলাম—

কি বলুন?

মৃণালের ডিটেলস ওই মিনতির কাছে পাওয়া যেতে পারে।

তা অবিশ্যি পারে। তা এখনো তো বেশী রাত হয়নি। সেই পল্লীটা একবার ঘুরে যাবেন নাকি? সোমনাথ ভাদুড়ী বললেন।

গেলে আমার মনে হয় ভালোই হতো।

বেশ, চলুন।

সোমনাথ ভাদুড়ী ড্রাইভার সমরেশকে বললেন, কলেজ স্ট্রীটে যে শিবমন্দিরটা আছে সেদিকে যেতে।

 

গলিটা কুখ্যাত ছিল এককালে। বর্তমানে অবিশ্যি আর ততটা নেই—তাহলেও সেখানকার পুরাতন বাসিন্দারা কিছু কিছু সেখানে এখনো ছড়িয়ে আছে।

গলির মধ্যে গাড়ি নিলেন না সোমনাথ ভাদুড়ী। ট্রাম রাস্তার উপরেই একপাশে গাড়িটা দাঁড় করিয়ে দুজনে হেঁটে চললেন। সন্ধ্যার পর থেকেই গলিটাতে মানুষের চলাচল যেন বৃদ্ধি পায়। সোমনাথ ভাদুড়ী বাড়িটা ঠিক চিনতেন না কিন্তু বাড়ির নম্বরটা মনে ছিল। নম্বরটা খুঁজে পেতে দেরি হল না।

একটা দোতলা লাল রংয়ের পুরনো বাড়ি!

মিনতিকে একটি মেয়ে ডেকে দিল।

মিনতি বোধ হয় ঘরে বসে সাজসজ্জা করছিল। ডাক শুনে বের হয়ে এলো।

কি রে চাঁপা!

এই ভদ্রলোক দুটি তাকে খুঁজছেন।

মিনতি তাকাল। সোমনাথ ভাদুড়ীকে আদালতে দেখেছে। চিনতে তার কষ্ট হলো না। বললে, উকিলবাবু—

মিনতি, তোমার সঙ্গে আমাদের কিছু কথা আছে।

মিনতি মুহূর্তকাল যেন কি ভাবলো। তারপর বললে, আসুন উকিলবাবু ঘরে।

তিনজনে মিনতির ঘরে প্রবেশ করল।

ঘরটি বেশ গোছানো। ছিমছাম। একদিকে একটি পালঙ্ক পাতা। উপরে ধবধবে শয্যা পাতা। দুটি দুটি চারটি মাথার বালিশ, একটি মোটা পাশ-বালিশ। একধারে একটি কাঁচের পাল্লাওয়ালা আলমারি। কিছু রুপোর, কাঁচের ও কাঁসার বাসনপত্র। নানা ধরনের পুতুল, খান দুই চেয়ারও আছে একধারে।

বসুন উকিলবাবু। একটু চায়ের জোগাড় করি।

না না মেয়ে, তুমি ব্যস্ত হয়ো না। সোমনাথ ভাদুড়ী বললেন চেয়ারে বসতে বসতে।

মিনতি আর কথা বলে না।ওদের মুখের দিকে পর্যায়ক্রমে তাকায়।

মিনতি—

বলুন।

এই ভদ্রলোক তোমাকে মৃণালের ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করতে চান। সোমনাথ ভাদুড়ী বললেন।

মৃণাল!

কিরীটী দেওয়ালে একটা ফটোগ্রাফের দিকে তাকিয়েছিল। সেই ফটোর দিকে তাকিয়েই

কিরীটী প্রশ্ন করল, ওই ফটোটার একজনকে তো চিনতে পারছি–মনে হচ্ছে তুমিই, তাই না?

মিনতি বললে, হ্যাঁ, আমিই। আমার পাশে—

তোমার বোন বা কোন আত্মীয়া বুঝি? কিরীটী বললে।

না। আমার পাশে ওই মৃণাল। মিনতি বললে।

মৃণাল! মানে যে মেয়েটি–

ঠিকই ধরেছেন। যে মৃণালকে নিয়ে এতদিন ধরে মামলা চললো। যার খোঁজ পাওয়া যায়নি—

ফটোটা কবেকার তোলা? কতদিনের?

তা প্রায় বছর দুই হবে। হঠাৎ একদিন মৃণালের খেয়াল হলো একটা ফটো তুলবে আমাকে নিয়ে—কথাটা বলতে বলতে মিনতির চোখ দুটি ছলছল করে ওঠে।

বছর দুই আগেকার ও ফটো তাহলে?

হ্যাঁ। মৃণালই একদিন আমাকে জোর করে ধরে নিয়ে গিয়ে হ্যারিসন রোডের একটা স্টুডিও থেকে ফটোটা তোলায়। একটা কপি তার ঘরে ছিল, অন্যটা আমার ঘরে আমি বাঁধিয়ে রেখে দিয়েছিলাম। কিন্তু–

কি?

পুলিসের লোক খানা-তল্লাসী করতে এলে ফটোটা কিন্তু তার ঘরে পায় না। মনে হয় বাড়ি ছেড়ে সে-রাত্রে যাবার আগে ফটোটা সে সঙ্গেই নিয়ে গিয়েছে।

পুলিস সেদিন তোমার ঘর খানা-তল্লাসী করেনি?

করেছিল।

ওই ফটো সম্পর্কে কোন প্রশ্ন করেনি?

না।

মৃণালের সঙ্গে মনে হচ্ছে তোমার যথেষ্ট বন্ধুত্ব ছিল, তাই না?

ঠিক ধরেছেন, পুলিশকেও বলেছি—আপনাকেও বলছি, মৃণাল অত্যন্ত লক্ষ্মী ও শান্ত স্বভাবের ছিল। এ বাড়িতে একমাত্র আমার সঙ্গে ছাড়া আর কারো সঙ্গে মিশতো না, কথাও বলতো না বড় একটা।

মৃণাল তো তোমার পাশের ঘরেই থাকত?

হ্যাঁ।

ওই ঘরে এখন কে আছে?

কেউ নেই, ঘরটা আজও খালিই পড়ে আছে মৃণাল চলে যাবার পর থেকে।

কেন?

কেউ ও-ঘরে থাকতে চায়নি। মৃণাল খুব ভাল গান গাইতে পারত নাচতেও পারত। আজও মধ্যে মধ্যে রাত্রে নাকি ওর ঘর থেকে ঘুঙুরের শব্দ শোনা যায়।

তুমি শুনেছো?

না। সত্যি বলবো, আমি কোনদিন কিছু শুনিনি। কিন্তু মৃণালের কথা এত শুনতে চাইছেন কেন?

কথাটা তাহলে তোমাকে খুলেই বলি, কিরীটী বলল-তপন ঘোষের হত্যাকারীকে আজও পুলিস সর্বত্র খুঁজে বেড়াচ্ছে।

কিন্তু বাবু, বিশ্বাস করুন, মৃণাল তপনবাবুকে হত্যা করেনি।

আমিও সে-কথাটা বিশ্বাস করি–কিরীটী বলল।

বিশ্বাস করেন?

করি, আর তাই তো মৃণালের সন্ধান আমিও করছি।

আপনি–

সোমনাথ ভাদুড়ী ওই সময় বললেন, এই ভদ্রলোকের পরিচয় তুমি জান না। কিরীটী রায়ের নাম শুনেছ?

না তো!

উনি সত্যসন্ধানী। সে-রাত্রে পাশের ঘরে সত্যই কি ঘটেছিল উনি সেটাই জানবার চেষ্টা করছেন।

কিন্তু বাবু, আমি তো মৃণালের কোন সন্ধানই জানি না। বিশ্বাস করুন।

হয়তো জানো না, কিরীটী বললে, কিন্তু তুমি মৃণালের কথা যতটা জানো–অন্য কেউ হয়ত সেটা জানে না।

মিনতি বললে, পাশের ঘরে ছিল মৃণাল। দিনের বেলাটা প্রায়ই তার আমার ঘরেই কেটে যেত-তবে–

কি?

বড় চাপা মেয়ে ছিল মৃণাল। তাছাড়া নিজের কথা বড় একটা বলতো না কখনও। বিশেষ করে এখানে আসার আগে তার সব কথা জানায়নি।

তুমি জিজ্ঞাসা করোনি কখনো সে-সব কথা তাকে? কিরীটীর প্রশ্ন।

না। আর জিজ্ঞাসা করেই বা কি করবো বলুন।

কেন?

এ লাইনে যারা আসে তাদের ইতিহাস তো প্রায় সকলেরই এক অন্যরকম আর কি হবে।

আচ্ছা তোমার কি মনে হয়? হঠাৎ সে পালাল কেন?

আমার মনে হয় বাবু, খুনখারাপি দেখে হঠাৎ ভয় পেয়ে হয়ত সে ঘর ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছে।

আচ্ছা মিনতি, কিরীটী বলল, এমন তো হতে পারে তপন ঘোষের খুনের ব্যাপারে সে-রাত্রে ওই মৃণালও জড়িত ছিল বা তার পরোক্ষ হাত ছিল?

না, না বাবু, না। কখনো তা হতে পারে না। মৃণালকে তো আমি জানি।

সে-রাত্রে কি ঘটেছিল বা না ঘটেছিল তুমি তো আর কিছু দেখনি!

তা হলেও আমি জোর গলায় বলতে পারি—মৃণাল সম্পূর্ণ নির্দোষ, সে ওই ধরনের মেয়েই নয়, অমন শান্ত স্বভাবের মেয়েকে–না বাবু, না।

তুমি তো একটু আগে বললে, তোমাদের মধ্যে খুব ভাব ছিল!

হ্যাঁ। পাশাপাশি ঘরে থাকতাম। দিনের বেলা বেশীর ভাগ সময় তো সে আমার ঘরেই থাকত, আমার সঙ্গে খেতো—এক বিছানায় দুজনে শুয়ে থাকতাম।

মৃণালের ঘরে কে আসতো নিশ্চয় তুমি জানতে?

জানতাম বৈকি, তপনবাবুরই যাতায়াত ছিল তার ঘরে।

আর কেউ আসতো না? বিজিতবাবু?

আসতো। তবে মধ্যে মধ্যে।

তপন ঘোষ তখন থাকত?

না। তপন ঘোষ থাকলে বিজিতবাবু আসতো না। তবে একটা কথা। আমার মনে হয় বিজিতবাবুর উপরে মৃণালের বোধ হয় একটা দুর্বলতা ছিল।

হুঁ। আচ্ছা মিনতি—সুদীপবাবুকে কখনো মৃণালের ঘরে আসতে দেখেছো?

দেখেছি।

একা একা?

না–তপন ঘোষের সঙ্গেই বারকয়েক আসতে দেখেছি।

আদালতে সাক্ষী দেবার সময় তো কথাটা তুমি বলোনি!

না, বলিনি।

কেন, কেবল বিজিতবাবুর কথাই বা বলেছিলে কেন?

মিনতি চুপ করে থাকে।

অবিশ্যি তোমার আপত্তি থাকলে আমি শুনতে চাই না।

না, তা নয়—

তবে?

আমার মনে হয় বাবু–বিজিতবাবু কোন চোরাকারবারে লিপ্ত ছিল—তপনবাবুর সঙ্গে তার হয়ত সেই নিয়েই শেষ পর্যন্ত খুনোখুনি হয়েছে। আদালতে সে-কথাটা আমি বলেছিলামও।

আর কেউ কখনো মৃণালের ঘরে আসেনি? আসতে দেখনি?

না।

মৃণালের আত্মীয়-স্বজন কেউ ছিল না?

জানি না? বলতে পারব না।

তার দেশ বা বাড়ি কোথায় ছিল জানো?

না, সেও কোনদিন তার বাড়িঘরের কথা বলেনি, আমিও সে-সব কথা কখনো তাকে শুধাইনি।

কতদিন এখানে মৃণাল ছিল?

তা প্রায় আড়াই বছর তো হবেই।

তার আগে কোথায় ছিল সে?

জানি না।

কথাটা তুমি তাকে কখনো জিজ্ঞাসা করনি?

না।

জানবার কখনো ইচ্ছা করেনি তোমার?

না।

তার অতীত জীবনের কথা তাহলে তুমি কিছুই জানো না?

না।

কিছু না?

কথায় কথায় একদিন সে বলেছিল—

কি?

তার স্বামী তাকে প্রচণ্ড মারধোর করতে প্রতি রাত্রে মাতাল হয়ে ঘরে ফিরে এসে। এক রাত্রে মারধোর করে বাড়ি থেকে বের করে দিয়ে দরজায় তালা দিয়ে চলে যায়।

তারপর?

দুদিন বাড়ির দরজার সামনেই সে বসে ছিল। তৃতীয় দিন বিকেলে হঠাৎ তার স্বামীর এক বন্ধু সেখানে গিয়ে উপস্থিত হয় এবং তার স্বামীর কাছে তাকে পৌঁছে দেবে বলে কলকাতায় নিয়ে আসে।

সেই বন্ধুটিকে মৃণালের স্বামী চিনতো?

হ্যাঁ—প্রায়ই সে যেতো ওদের বাড়িতে।

কে সে? কি নাম তার জানো?

না।

তারপর?

তারপর আর কি, এখানে বাড়িউলী মাসীর হাতে তাকে তুলে দিয়ে বন্ধুটি চলে যায়। পরে জেনেছিল মৃণাল, ওই লোকটির নাকি মেয়ে চালান দেবার ব্যবসা ছিল। আর সেই ব্যবসায় তার স্বামীও একজন ভাগীদার ছিল। সম্ভবত ওই লোকটি মৃণালকে চালান দেবার মতলব করেছিল।

কিন্তু এখানে এলো কি করে মৃণাল?

সে আর এক দৈবচক্র—

কি রকম?

স্বামীর সেই বন্ধুর আশ্রয় থেকে পালিয়ে এল রাত্রে মৃণাল। রাস্তায় এসে নামল। হাঁটতে হাঁটতে নিমতলার গঙ্গার ঘাটে গিয়ে বসে থাকল। সেখানে আমাদের বাড়িউলী মাসীর সঙ্গে দেখা

কিরীটী মৃদু হেসে বললে, ফ্রম ফ্রাইং প্যান টু দ্য ফায়ার!

কি বললেন বাবু?

না, কিছু না, তোমাদের বাড়িউলী মাসী তখন তাকে এখানে এনে তুলল, তাই না?

আজ্ঞে। এ পাপ দেহের ব্যবসায় সে নামতে চায়নি, কিন্তু পালাবার তো আর পথ ছিল, মাসীর চার-পাঁচজন তাবেদার গুণ্ডা আছে—মাসীর পোষ্যও তারা–তারা সর্বক্ষণ চোখ মেলে থাকত। কাজেই বুঝতে পারছেন বাবু–

কিরীটী প্রত্যুত্তরে মৃদু হাসলো।

আচ্ছা সে-রাত্রে ঠিক কি ঘটেছিল, মানে যতটা তুমি জানো বা জানতে পেরেছিলে আমাকে বলতে পার! কিরীটী প্রশ্নটা করে মিনতির দিকে তাকাল।

বাবু, সে রাত্রে আমার ঘরে কেউ ছিল না রাত দশটার পর। আমার বাবু পৌনে দশটা নাগাদ চলে যান

কিন্তু আদালতে বলেছে, অবিনাশ সেন নামে এক ভদ্রলোক আর তুমি—

ঠিকই বলেছি-যার কথা বলেছি সে আমার স্বামী।

স্বামী!

হ্যাঁ, আট বছর আগে তার ঘর ছেড়ে আমি চলে আসি–

কেন?

তার জঘন্য চরিত্র ও নিষ্ঠুর ব্যবহারের জন্য। কিন্তু সে আমাকে বছর তিনেক বাদে খুঁজে বের করে এখানে। এবং তারপর থেকে মধ্যে মধ্যে সে আসতো আমার কাছে।

কেন? টাকার জন্য?

না, সোনার বেনে—মস্তবড় জুয়েলারী ফার্ম তার, টাকার অভাব তো নেই। অনেক টাকা তার। টাকার জন্য সে আমার কাছে আসবে কেন?

তবে কি জন্যে আসতো?

আমাকে আবার ঘরে ফিরিয়ে নেবার জন্য।

ফিরে গেলে না কেন?

না। কারণ আমি জানতাম সেই একই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হবে। তাছাড়া—

কি?

এই পাপ নিয়ে আর কি সেখানে ফিরে যেতে পারি।

তোমার কোন সন্তানাদি

না, হয়নি। তবে তার প্রথম পক্ষের দুটি সন্তান ছিল–আমি তার দ্বিতীয় পক্ষ। আরো অনেক কথা আছে, যা বলতে পারবো না।

থাক, বলতে হবে না। কিন্তু তুমি আদালতে সে সব কথা তো প্রকাশ করনি?

না, করিনি।

কেন? ওই সব কি প্রকাশ করবার মত কথা দশজনের সামনে আদালতে দাঁড়িয়ে?

এবার বল, সে রাত্রে ঠিক কি ঘটেছিল।

রাত সাড়ে দশটার পর, বোধ হয় এগারোটা হবে তখন আমার স্বামী এলো।

বললে, সে আমাকে না নিয়ে ফিরবে না। আমিও যাবো না। সেও নাছোড়বান্দা। আমি বললাম আর আমি জীবনে কোনদিন তার ঘরে ফিরে যাবো না, সেও যেন আর না আসে।

০৫. মিনতি বলতে লাগল

মিনতি বলতে লাগল, রাত বোধ হয় বারোটা। হঠাৎ পর পর দুটো গুলির আওয়াজ–আর একটা আর্ত চিৎকার–

দুটো গুলির আওয়াজ শুনেছিলে? প্রশ্ন করলেন সোমনাথ ভাদুড়ী।

হ্যাঁ।

কিন্তু আদালতে বলেছ একটা গুলির আওয়াজই তুমি সে রাত্রে শুনেছিলে। আবার প্রশ্ন করলেন সোমনাথ ভাদুড়ী।

হ্যাঁ, তাই বলেছিলাম বটে।

কিরীটী এবার বললে, দুটো গুলির আওয়াজ শুনেছিলে তবে বলেছিলে কেন একটা গুলির আওয়াজ শুনেছো?

মনে ছিল না।

কিরীটী বললে, হুঁ। ঠিক আছে গুলির আওয়াজ শুনে তুমি কি করলে?

ভয়ে প্রথমে আমরা ঘর থেকে বের হইনি। এদিকে বাড়ির অনেকেই সে আওয়াজ শুনেছে তখন, কিন্তু তারাও কেউ ভয়ে ঘর থেকে বের হয়নি। মিনিট পাঁচেক পরে আমি আর আমার স্বামী দরজা খুলে বের হই। মৃণালের ঘরের দরজা বন্ধ। কোন সাড়া-শব্দ নেই। দরজায় ধাক্কা দিয়ে মৃণালকে ডাকি। কিন্তু মৃণালের কোন সাড়া-শব্দ পেলাম না। বাড়ির অনেকেই তখন এসে ঐ ঘরের দরজার সামনে ভিড় করেছে। হঠাৎ এই সময় আমার মনে পড়ল—আমার আর মৃণালের ঘরের মাঝখানে একটা দরজা আছে। আমার ঘরের ভিতর থেকেই আমি বন্ধ করে রাখতাম বরাবর। তাড়াতাড়ি ছুটে গিয়ে সেই মধ্যবর্তী দরজাটা খুলে মৃণালের ঘরে গিয়ে ঢুকলাম। ঢুকে দেখি তপন ঘোষ রক্তাক্ত অবস্থায় মেঝেতে পড়ে। তার পাশে পড়ে বিজিতবাবু। তার হাতে ধরা একটা পিস্তল। আর—মৃণাল ঘরে নেই?

মৃণাল নেই?

না। বাথরুমের দরজাটা খোলা হাঁ হাঁ করছে। আমি তখন প্রথমে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে বাথরুমের আমার ঘরের দরজা বন্ধ করে বাইরে এলাম। আমার স্বামী দেখি দরজার গায়ে লাথি মারছে-বাড়িউলী মাসীর হুকুমে। দরজা ভেঙে আমি আর আমার স্বামীই প্রথমে ভিতরে ঢুকি—পর পর অন্য সকলে। পরে থানায় খবর দেওয়া হয়। পুলিস আসে।

বাথরুমের ওই দরজা দিয়ে এ বাড়ির বাইরে যাওয়া যায়? কিরীটীর প্রশ্ন।

হ্যাঁ, বাইরে একটা ঘোরানো লোহার সিঁড়ি আছে। সিঁড়িটা বরাবর একতলা থেকে দোতলা পর্যন্ত গিয়েছে।

বলতে চাও তাহলে ওই সিঁড়িপথেই মৃণাল পালিয়েছে?

হ্যাঁ, তাছাড়া আর কি হবে। তবে পুলিসের খটকা থেকে গিয়েছে—মৃণাল কোন্ পথে পালাল-বাথরুমের দরজা যখন বন্ধ ছিল। আমিও পুলিসকে কথাটা বলিনি, আদালতেও প্রকাশ করিনি।

কেন করনি?

পুলিস হয়ত আমাকে সন্দেহ করত যে, আমিই তাকে সে-রাত্রে পালানোর সুযোেগ দিয়েছি।

এ কথাটা তোমার মনে হলো কেন মিনতি? কিরীটী প্রশ্ন করল।

তারা যে অনুসন্ধানের সময় আমার ও মৃণালের ঘরের মধ্যবর্তী দরজাটা আবিষ্কার করেছিল এবং আমাকে নানাভাবে জেরা করেছি।

তা তোমাকে যে তারা শেষ পর্যন্ত সন্দেহ করেনি, তুমি বুঝলে কি করে?

আমি যে একসময় সে-রাত্রে গোলমাল শুনে এক ফাঁকে মৃণালের ঘরের মধ্যে গিয়ে ঢুকেছিলাম, সে কথাটাও কাউকে আমি বলিনি। তারাও সেটা অনুমান করতে পারেনি। তাই আমার মনে হয়, আমাকে তারা মৃণালের সে-রাত্রে পালানোর ব্যাপারে কোনভাবে সন্দেহ করতে পারেনি।

কিরীটী মুখে কিছু না বললেও বুঝতে পারে মেয়েটি রীতিমত বুদ্ধিমতী।

মিনতি।

বলুন।

আমার কিন্তু মনে হয়, মৃণাল কোথায় আছে, অন্তত আর কেউ না জানলেও তুমি জানো।

কি বলছেন আপনি!

যা আমার মনে হচ্ছে তাই বললাম।

আপনি বিশ্বাস করুন, সত্যিই আমি জানি না।

দেখ মৃণালকে আমি খুঁজে বের করবই। সে অন্তত আমার চোখে ধুলো দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকতে পারবে না। আচ্ছা আজ আমরা উঠছি আবার কিন্তু আসবো।

নিশ্চয়ই আসবেন। মিনতি বললে, কিন্তু বিশ্বাস করুন বাবু, মৃণালের সন্ধান জানলে নিশ্চয়ই সে-কথা আমি আপনাদের জানাতাম।

কিরীটী মিনতিকে আর কিছু বললে না। উঠে দাঁড়াল এবং সোমনাথ ভাদুড়ীকে বললে, চলুন ভাদুড়ী মশাই, এবার যাওয়া যাক। ভাল কথা, একবার মৃণালের ঘরটা দেখে গেলে হতো।

সোমনাথ ভাদুড়ী উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, বেশ তো চলুন।

মিনতি বাড়িউলী মাসীর কাছ থেকে ঘরের চাবিটা নিয়ে এলো। দরজা খুলে ওরা দুজনে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল।

 

রাত তখন প্রায় সোয়া নটা হয়ে গিয়েছে।

দুজনে ওই বাড়ি থেকে বের হয়ে বড় রাস্তায় এসে কিরীটীর অপেক্ষমাণ গাড়িতে উঠে বসলো।

সর্দারজী, বাবুকে তার কোঠিতে নামিয়ে দাও আগে–কিরীটী বললে।

কিছুক্ষণ গাড়ি চলার পর সোমনাথ ভাদুড়ীই স্তব্ধতা ভঙ্গ করলেন, কি ভাবছেন রায় মশাই?

ভাবছি ওই মিনতি মেয়েটির কথা।

সত্যিই কি আপনার মনে হয়, মেয়েটি জানে মৃণাল কোথায়?

আমার অনুমান যদি মিথ্যা না হয় তো জানে।

তবে সে কথা মিনতি প্রকাশ করল না কেন? এত কথা বললে, অথচ ওই কথাটা চেপে গেল কেন?

তার দুটি কারণ হতে পারে ভাদুড়ী মশাই।

কি কারণ?

প্রথমত, কথাটা প্রকাশ করলে সে মামলার মধ্যে জড়িয়ে পড়তো, যেটা হয়ত সে কোনক্রমেই চায়নি। দ্বিতীয়ত, হয়ত সে ব্যাপারটা স্বচক্ষে দেখেছিল সেই রাত্রে।

কি রকম?

গোলাগুলির আগে হয়ত একটা গোলমাল হয়েছিল। আর সে তখন ওই ঘরের। মধ্যবর্তী দরজা খুলে ব্যাপারটা সবার অলক্ষ্যে দেখেছিল। সে যে পিস্তলের গুলির শব্দেই প্রথমে আকৃষ্ট হয়েছিল কথাটা হয়ত সত্য নয় কিন্তু সে কথাটা প্রকাশ করেনি ওই একই কারণে—পুলিস তার পেটের গোপন কথা হয়ত টেনে বের করত জেরা করে। একটা কথা ভুলে যাবেন না ভাদুড়ী মশাই, ঘটনার সময় মিনতি আর তার স্বামী অবিনাশ ঠিক। পাশের ঘরেই ছিল। অকুস্থানের এক কথায় যাকে বলে সন্নিকটে।

তাহলে–

মিনতির উপর কড়া নজর রাখতে হবে। আপনি ভাববেন না, বাড়ি ফেরার পথেই লালবাজারের সি. আই. ডি. অফিসার প্রতুল সেনকে আমি মিনতির উপর কনস্ট্যান্ট একটা ওয়াচ রাখবার জন্য আজ থেকেই নির্দেশ দিয়ে যাবো।

সোমনাথ ভাদুড়ীকে তার গৃহে নামিয়ে দিয়ে কিরীটী সোজা সার্কাস এভিন্যুতে প্রতুল সেনের গৃহে গিয়ে উপস্থিত হলো।

প্রতুল সেন তখন ডিনারে বসেছিলেন।

সংবাদ পেয়ে তাড়াতাড়ি বের হয়ে এলেন।

কি ব্যাপার মিঃ রায়! এত রাত্রে?

কিরীটী মৃদু হেসে বললে, এত রাত কোথায়, মাত্র তো সোয়া দশটা।

আমি খেতে বসেছিলাম, আপনার নাম শুনে—

ছিঃ ছিঃ, যান আহার শেষ করে আসুন। আমি বসছি।

না না, আপনি বলুন কি দরকার?

বলবো বলেই তো এসেছি। আগে যান ডিনার শেষ করে আসুন, আমি বসছি।

সে হবেখন–আপনি বলুন।

না, এমন কিছু একটা জরুরী ব্যাপার নয়, আপনি যানফিনিশ ইওর ডিনার ফার্স্ট।

প্রতুল সেন চলে গেলেন এবং মিনিট কুড়ি বাদেই ফিরে এলেন একটা সিগারেট ধরিয়ে। একটা সোফায় বসতে বসতে বললেন, বলুন।

কিরীটী সংক্ষেপে ব্যাপারটা খুলে বলল। তারপর বললে, আমি যে জন্য এসেছি সেটা হচ্ছে ঐ মিনতির সবরকম গতিবিধির উপর আপনাকে নজর রাখার একটা ব্যবস্থা করতে হবে। এখুনি।

বেশ, করছি। প্রতুল সেন উঠে গিয়েই ফোনে যেন কাকে নির্দেশ দিয়ে এলেন।

মিঃ রায়, আপনার ধারণা তাহলে মিনতি জানে মৃণালের হোয়ার অ্যাবাউটস!

হ্যাঁ।

মিনতিকে তাহলে অ্যারেস্ট করলেই তো হয়?

না, এখন নয়।

কিন্তু তার স্বার্থ কি?

স্বার্থ একটা আছে বৈকি কিছু—

কি স্বার্থ থাকতে পারে?

ইফ আই অ্যাম নট রং—আমার অনুমান যদি মিথ্যা না হয়ে থাকে তো, কিরীটী বললে, ঐ বাড়িতে একটা চোরাকারবারের ঘাঁটি ছিল।

চোরাকারবারের ঘাঁটি!

হ্যাঁ। যার মধ্যে জড়িত ছিল তপন ঘোষ, বিজিত মিত্র ও সুদীপ রায় তো বটেই— ঐ মিনতি ও মৃণাল সম্ভবত ছিল।

সত্যি বলছেন?

বললাম তো আমার অনুমান। এবং তপন ঘোষের মৃত্যুর পশ্চাতেও ওই চোরাকারবার।

আর মিনতির স্বামী অবিনাশ সেন?

সেও থাকাটাই সম্ভব। আপনাকে আরো একটা কাজ করতে হবে মিঃ সেন।

কি?

ওই অবিনাশ সেনকে একবার লালবাজারে ডাকিয়ে আনাতে হবে কালই।

বেশ। কখন?

বেলা দশটা বা এগারোটা নাগাদ আমরা আপনার অফিসে তাকে জেরা করলে হয়ত কোন সূত্রের সন্ধান পেতে পারি।

আমার তো মনে হচ্ছে ওই মিনতি মেয়েটি—

তাকে তত জেরা করবোই—তার আগে তার জানা দরকার, তাকে ও তার স্বামীকে আমরা সন্দেহ করছি। আচ্ছা এখন তাহলে উঠি। কাল দশটা-এগারোটার মধ্যে আপনার অফিসে যাবো।

গৃহে ফিরে এলে কৃষ্ণা বললে, টিকিট পাওয়া গিয়েছে সামনের সোমবারে ড়ুন এক্সপ্রেসে।

আজ বৃহস্পতিবার হাতে তাহলে এখনো তিনটে দিন-রাত ও একটা বেলা আছে। ঠিক আছে, তার মধ্যে আশা করছি তপন ঘোষের হত্যার ব্যাপারে একটি হদিস হয়ত পেয়েও যেতে পারি।

তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে, তুমি কোন একটা নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তের কাছাকাছি এসে গিয়েছে।

তোমাকে সেদিন বলছিলাম না কৃষ্ণা, কিরীটী একটা আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে বললে, রক্তের দাগ একেবারে নিশ্চিহ্নভাবে মুছে ফেলা যায় না। যতই চেষ্টা করো মুছে। ফেলতে, একটা আবছা দাগ কোথায়ও-না-কোথায়ও থেকে যায়ই। আর সে-রক্তের দাগ যদি হত্যার হয় তো–

হত্যাকারী সনাক্ত হয়ে যায়! কৃষ্ণা মৃদু হেসে বললে।

তাই। কারণ কোন ক্রাইমই আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে একেবারে পারফেক্ট হয় না। হতে পারে না। ছোট একটা কিন্তু কোথাও-না-কোথাও থেকে যাবেই—সেই কিন্তু ধরে যদি এগুতে পারো—ঠিক সত্যে তুমি পৌঁছে যাবেই।

চল, রাত অনেক হয়েছে, এবারে খাবে চল।

হ্যাঁ, চল।

 

পরের দিন সকাল দশটা নাগাদ কিরীটী বেরুল।

লালবাজারে প্রতুল সেনের অফিস কামরায় প্রবেশ করে দেখলো প্রতুল সেন তারই অপেক্ষায় বসে আছে।

আসুন আসুন সত্যসন্ধানী।

কোন খবর আছে?

প্রতুল সেন বললেন, অবিনাশ সেনকে এখুনি আমার লোক নিয়ে আসবে।

প্রতুল সেনের কথা শেষ হলো না, সাব-ইন্সপেক্টার রঞ্জিত মল্লিক অবিনাশ সেনকে নিয়ে ঘরে প্রবেশ করল।

অবিনাশবাবু এসেছেন, স্যার।

বসুন অবিনাশবাবু। প্রতুল সেন বললেন।

অবিনাশ সেন বসলেন।

কিরীটী চেয়ে দেখে আগন্তুকের দিকে।

বয়স প্রায় পঞ্চাশের কাছাকাছি হবে বলেই মনে হয় ভদ্রলোকের। রোগা লম্বা চেহারা। গাল দুটো ভাঙা। মাথার চুলে কলপ দেওয়া! সযত্ন টেড়ি, মাঝখানে সিঁথি। চোখে সোনার চশমা। নিখুঁতভাবে দাড়ি কামানো। সরু গোঁফ ঠোটের উপর। পরনে দামী শান্তিপুরী ধুতি ও সাদা সিল্কের পাঞ্জাবি। সোনার বোতাম। দুহাতের আঙুলে গোটা দুই সোনার আংটি, তার মধ্যে একটা হীরা। হীরাটি বেশ বড় একটা বাদামের সাইজের, অনেক দাম যে হীরাটার বোঝা যায়।

লোকটি কেবল ধনীই নয়—বনেদী ধনী। শৌখিন প্রকৃতির।

কিন্তু সারা মুখে যেন একটা দীর্ঘ অত্যাচার ও অসংযমের ছাপ।

কি ব্যাপার স্যার—এত জরুরী তলব দিয়ে আমাকে এখানে ডেকে আনলেন কেন? অবিনাশ বললেন।

কোন রকমের ভনিতা না করেই প্রতুল সেন বললেন, আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে। তপন ঘোষ হত্যা-মামলার ব্যাপারটা!

সঙ্গে সঙ্গে অবিনাশ সেনের চোখের দৃষ্টি যেন সজাগ, তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে।

মামলায় আপনি তো সাক্ষীও দিয়েছিলেন—

আজ্ঞে।

আপনি ওই বাড়িতে মিনতির ঘরে যেতেন? প্রশ্ন করল এবার কিরীটী।

অবিনাশ সেন চকিতে তাকালেন কিরীটীর মুখের দিকে।

প্রতুল সেন বললেন, উনি যা জিজ্ঞাসা করছেন তার জবাব দিন।

কিন্তু স্যার—সে মামলা তো চুকেবুকে গিয়েছে।

না, যায়নি।

যায়নি! অবিনাশ সেনের কষ্ঠে বিস্ময়।

না, তপন ঘোষের হত্যাকারী এখনো সনাক্ত হয়নি। কিরীটী আবার বললে, কিন্তু আপনি আমার প্রশ্নের এখনো জবাব দেননি।

হ্যাঁ, তা মধ্যে মধ্যে যেতাম।

আপনার সঙ্গে তার পূর্ব-পরিচয় ছিল, তাই না?

পূর্ব-পরিচয় আর কি স্যার—একজন বারবনিতা—

কিন্তু তা তো নয়—

কি বলতে চান স্যার?

মিনতির সঙ্গে আপনার সত্যিকারের কি সম্পর্ক ছিল?

সম্পর্ক আবার কি থাকবে?

আপনি সত্য গোপন করছেন অবিনাশবাবু—

সত্য!

হ্যাঁ, তিনি ঐ লাইনে আসার আগে আপনার স্ত্রী বিবাহিতা স্ত্রী ছিলেন, দ্বিতীয় পক্ষের–

অবিনাশ সেনের চোয়ালটা ঝুলে পড়লো সহসা। দুচোখে বোবা দৃষ্টি।

কি, তাই না?

বাড়ি থেকে বের হয়ে এসেছিল কুলত্যাগিনী—

কথাটা আপনি আদালতে চেপে গেলেন কেন?

প্রয়োজন হয়নি-অবান্তর–

না, অনেক সত্য কথা বের হয়ে পড়ার ভয়ে কথাটা চেপে গিয়েছিলেন।

না, না—

তা সেই কুলত্যাগিনী স্ত্রীর কাছে আবার কেন আসতেন মধ্যে মধ্যে? নিশ্চয়ই ভালবাসার টানে নয়!

সত্যিই তাই স্যার। বিশ্বাস করুন ওকে আমি ভুলতে পারিনি।

তা মিনতি যে ওইখানে আছে খবর পেলেন কি করে?

হঠাৎ-ই—মানে অ্যাকসিডেন্টালি!

মানে ওই সব পাড়ায়—ওই ধরনের মেয়েদের কাছে যেতে যেতে!

অবিনাশ সেন চুপ করে থাকেন।

অবিনাশবাবু!

আজ্ঞে—

আমরা কিন্তু খবর পেয়েছি—

কি–কি খবর পেয়েছেন?

ওই বাড়িতে একটা চোরাই কারবারের আড্ডা ছিল।

চোরাই কারবার!

সেই কারবারের সঙ্গে আপনি ও মিনতি যুক্ত ছিলেন।

না, না–বিশ্বাস করুন, ওসব ব্যাপারের মধ্যে আমি নেই।

কিরীটী মৃদু হাসলো।

অবিনাশবাবু, আপনি জানেন মৃণাল কোথায়?

না, কেমন করে জানবো!

জানেন না?

না।

কিন্তু আমি যদি বলি আপনি জানেন!

মৃণাল পাশের ঘরে থাকত। মিনতির মুখেই আমি শুনেছিলাম, কিন্তু তার সঙ্গে কোন আলাপ-পরিচয় ছিল না, এমন কি আগে তার নামও জানতাম না।

তপন ঘোষের সঙ্গে আপনার পরিচয় ছিল না?

না।

বিজিতবাবুর সঙ্গে?

না।

সুদীপবাবুর সঙ্গে?

না।

তাহলে ওদের কাউকেই আপনি চিনতেন না বলতে চান অবিনাশবাবু? কথাটা বলে কিরীটী অবিনাশ সেনের মুখের দিকে তাকাল।

না। বিশ্বাস করুন, ওদের কাউকেই আমি চিনতাম না।

পন্টুকে আপনি চিনতেন?

পন্টু।

হ্যাঁ, সে তো মধ্যে মধ্যে আপনার দোকানে গিয়ে আপনার সঙ্গে দেখা করত। কথাটা কি অস্বীকার করতে পারেন?

ওই নামই জীবনে কখনো শুনিনি।

কিন্তু মিনতি বলেছে—

কি বলেছে মিনতি?

মধ্যে মধ্যে আপনি ঐ তপনবাবুর সঙ্গে বিশেষ করে দেখা করবার জন্য তার ঘরে রাত্রের দিকে যেতেন।

মিনতি বলেছে?

হ্যাঁ, আরো বলেছে তপন পাশের ঘর থেকে মিনতির ঘরে আসতো মাঝখানের দরজা-পথে—আবার কথাবার্তা হয়ে চলে যেতো ওই দরজা দিয়েই পাশের ঘরে।

মিনতি বলেছে ওই কথা আপনাকে! হারামজাদী! শেষেব শব্দটা কাপা আক্রোশভরা গলায় অবিনাশ সেন যেন অস্পষ্টভাবে উচ্চারণ করলেন।

ঠিক আছে অবিনাশবাবু—আপনি যেতে পারেন।

ধন্যবাদ। অস্ফুট কণ্ঠে কথাটা বলে অবিনাশ সেন বের হয়ে গেলেন ঘর থেকে।

অবিনাশ ঘর ছেড়ে চলে যাবার পর প্রতুল সেন কিরীটীর মুখের দিকে তাকালেন।

কিরীটী অন্যমনস্ক ভাবে পাইপটায় নতুন তামাক ভরছে তখন।

কি বুঝলেন মিঃ রায়। প্রতুল সেন প্রশ্ন করলেন।

গভীর জলের কাতলা। কিরীটী বললে।

সে তো বোঝাই গেল। নচেৎ সব স্রেফ অস্বীকার করে যেতে পারে!

তবে কাতলা টোপ গিলেছে।

টোপ!

হ্যাঁ, দেখলেন না—বঁড়শী টাকরায় গিয়ে বিঁধেছে।

মিনতি কি সত্যিই ওইসব কথা বলেছে মিঃ রায়?

না।

তবে যে বললেন—

টোপ ফেলেছিলাম একটা স্রেফ অনুমানের ওপরে নির্ভর করে দেখলেন তো, অনুমানটা মিথ্যে হয়নি। এবারে আপনাকে একটা কাজ করতে হবে মিঃ সেন।

কি বলুন?

মৃণালের ঘরটা এখনো খালি পড়ে আছে—সেই ঘরটার আমাদের প্রয়োজন।

সে আর এমন কঠিন কি!

এখুনি লোক পাঠান—আর একটা টেপ-রেকর্ডার।

পাবেন।

ওই বাড়ির খিড়কির দরজাটা

তাও খোলা থাকবে। তার আশেপাশে আমাদের একজন প্লেন ড্রেসে ওয়াচারও থাকবে। কিন্তু এত আয়োজন কিসের?

কিরীটী তখন তার প্ল্যানটা বুঝিয়ে দিল প্রতুল সেনকে। তারপর বললে, সন্ধ্যার পরই যেন সব প্রস্তুত থাকে।

কিন্তু আপনি কি মনে করেন মিঃ রায়–

কি?

টোপ গিলবে লোকটা!

গিলবে বলেই আমার ধারণা।

আজ না হয় কাল।

বেশ।

এবার আমি উঠবো।

তা কখন দেখা হচ্ছে?

ঠিক রাত সোয়া আটটায়।

অতঃপর কিরীটী বিদায় নিল।

 ০৬. সেদিনটা ছিল রবিবার

সেদিনটা ছিল রবিবার। অফিস আদালত সব বন্ধ।

লালবাজার থেকে বের হয়ে সোজা কিরীটী সোমনাথ ভাদুড়ীর গৃহের দিকে গাড়ি চালাতে বলল সর্দারজীকে!

বেলা তখন প্রায় সাড়ে বারোটা। সোমনাথ ভাদুড়ীর ঘর প্রায় খালিই ছিল। একজন মাত্র মক্কেল ছিল ঘরে। সোমনাথ ভাদুড়ী তার সঙ্গেই কথা বলছিলেন।

কিরীটীকে ঘরে প্রবেশ করতে দেখে সাদর আহ্বান জানালেন সোমনাথ ভাদুড়ী, আসুন রায়মশাই, বসুন–

কিরীটী উপবেশন করবার পর সোমনাথ ভাদুড়ী তাড়াতাড়ি শেষ মক্কেলটিকে বিদায় করলেন।

আপনাকে ফোন করেছিলাম বাড়িতে—আপনার স্ত্রী বললেন আপনি সকালেই বের হয়েছেন। ভাদুড়ী বললেন।

হ্যাঁ, লালবাজারে গিয়েছিলাম।

আজকের সকালবেলার কাগজ পড়েছেন রায় মশাই?

না, সময় পাইনি। তাছাড়া আমি সাধারণত কাগজ দুপুরে বিশ্রামের সময় পড়ি।

সুদীপ রায়—

কি হয়েছে সুদীপের?

সে খুন হয়েছে—

খুন! কে বললে?

সংবাদপত্রে বের হয়েছে। তার গুলিবিদ্ধ রক্তাক্ত মৃতদেহটা রেল লাইনের ধারে গতকাল সকালে পাওয়া গিয়েছে।

তার মানে যেদিন সন্ধ্যায় সে আপনার এখানে এসেছিল, সেইদিনই রাত্রে সে খুন হয়েছে!

হিসাবমত তাই দাঁড়াচ্ছে। সোমনাথ ভাদুড়ী বললেন।

কিন্তু প্রতুলবাবু তো কিছু বললেন না!

বোধ হয় ব্যাপারটা এখনো তিনি শোনেননি।

হয়ত তাই, কিন্তু লোকটা যে ওই সুদীপ রায়ই–সেটা জানলেন কি করে?

কাগজে অবিশ্যি বের হয়েছে এক ব্যক্তির মৃতদেহ আবিষ্কৃত হয়েছে এবং মৃতের মুখটা কোন ধারানো অস্ত্রের সাহায্যে ক্ষত-বিক্ষত করা হয়েছে। আইডেনটিফাই নাকি করেছে আজই তার স্ত্রী রমা।

খবরের কাগজে কি সংবাদ বের হয়েছে?

না। আসলে আমিও সংবাদপত্রে নিউজটা পড়িনি রায়মশাই-আজ সকালে একটা ফোন পাই–

ফোন!

হ্যাঁ, অজ্ঞাতনামা এক নারীর কাছ থেকে। সে-ই সংবাদটা দেয়। সংবাদটা দিয়েই সে ফোনের কানেকশন কেটে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে আপনাকে ফোন করি সংবাদটা দেবার জন্য।

ফোনে ঠিক কি বলেছিল আপনাকে সেই মহিলা?

বলেছিল রেল লাইনের ধারে যে মৃতদেহটা পাওয়া গিয়েছে সেটা সুদীপ রায়ের।

যিনি ফোন করেছিলেন তাঁর কণ্ঠস্বর আপনি চিনতে পারেননি।

না।

ঠিক আছে—বলতে বলতে সামনেই টেবিলের উপর রক্ষিত ফোনের রিসিভারটা তুলে নিয়ে কিরীটী ডায়েল করল লালবাজারে।

কিন্তু প্রতুল সেনকে তার অফিসে পেল না।

কাকে ফোন করছিলেন? সোমনাথ ভাদুড়ী জিজ্ঞাসা করলেন।

প্রতুল সেনকে, পাওয়া গেল না—অফিসে নেই।

আচ্ছা রায়মশাই, কে আপনাকে ফোন করেছিল বলুন তো?

মনে হয় হত্যাকারীর সহকারিণী এবং হত্যাকারীরই নির্দেশে?

কিন্তু আমাকে সংবাদটা দেবার কি প্রয়োজন ছিল?

ভাদুড়ী মশাই, হত্যাকারী বরাবরই সজাগ ছিল। সুদীপবাবু যে আপনার কাছে। এসেছিলেন তাও সে জানত। তাই সে আপনাকে জানিয়ে দিল—ভবিষ্যতের কথা ভেবেই সুদীপবাবুকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়া হলো।

তার মানে–যাতে সে ভবিষ্যতে আরো কিছু প্রকাশ করতে না পারে!

হ্যাঁ—সেই সন্দেহেই তাকে এ পৃথিবী থেকে সরানো হয়েছে। তবে একটা ব্যাপার সুদীপবাবুর মৃত্যুতে পরিষ্কার হয়ে গেল

কোন্ ব্যাপারের কথা বলছেন?

তপন ঘোষের হত্যার ষড়যন্ত্রের মধ্যে সুদীপবাবু না থাকলেও তিনি ব্যাপারটা অনুমান করতে পেরেছিলেন।

আমি কিন্তু একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি না রায়মশাই।

সুদীপবাবু এগিয়ে এসে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে কেন সাক্ষী দিলেন তাই বোধ হয়।

হ্যাঁ। সে যদি ষড়যন্ত্রের মধ্যে ছিলই—

সুদীপবাবুর মনের মধ্যে একটা ভয় ঢুকেছিল।

ভয়! কিসের ভয়?

তার নিজের প্রাণের ভয়।

প্রাণের ভয়!

হ্যাঁ। তার মনে ভয় ঢুকেছিল, বিজিত মিত্র যদি প্রাণের ভয়ে শেষ পর্যন্ত অ্যাপ্রুভার হয়ে সব কিছু প্রকাশ করে দেয়–

তাই সে সাক্ষী দিয়ে বিজিত মিত্রকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল বলতে চান?

হ্যাঁ-বিজিত মিত্রকে আইন-আদালতের এক্তিয়ারের বাইরে নিয়ে যেতে চেয়েছিল।

কেমন যেন সব কিছু গোলমাল হয়ে যাচ্ছে আমার রায়মশাই। সোমনাথ ভাদুড়ী বললেন দু আঙুলের মাঝখানে মোটা পেনসিলটা নাচাতে নাচাতে।

একটা ব্যাপার কিন্তু পরিষ্কার হয়ে গেল ভাদুড়ী মশাই। কিরীটী বললে।

কি বলুন তো? সোমনাথ ভাদুড়ী তাকালেন কিরীটীর মুখের দিকে।

তপন ঘোষ, বিজিত মিত্র ও সুদীপ রায় সব একদলের এবং সত্যিই ওরা পরস্পর কোন দুষ্কর্মের সঙ্গী ছিল পরস্পরের।

চোরাকারবার!

হতে পারে। আমি কিন্তু ব্যাপারটা পূর্বাহ্রেই অনুমান করেছিলাম—তাই আজ ফাঁদ পাতার ব্যবস্থা করে এসেছি।

ফাঁদ।

হ্যাঁ–আর আমার অনুমান যদি মিথ্যা না হয় তো আজই রাত্রে ফাঁদে নাটের গুরুকে আটকা পড়তে হবে।

কার কথা বলছেন?

রহস্যের মেঘনাদ যিনি—তারই কথা বলছি। ব্যাপারটা সত্যি কথা বলতে কি, আমি কিন্তু এত সহজে নিষ্পত্তি হয়ে যাবে ভাবতে পারিনি। ভাবতে পারিনি হত্যাকারী এত বড়।

একটা ভুল তড়িঘড়ির মাথায় করে বসবে বা করে বসতে পারে।

তাহলে সুদীপবাবুর নিহত হওয়াটা এ ব্লেসিং ইন ডিসগাইজ বলুন রায়মশাই, সোমনাথ বললেন।

তাই।

 

কিরীটীর অনুমান যে মিথ্যা নয় সেটা ওই রাত্রেই প্রমাণিত হয়ে গেল।

ব্যবস্থামত রাত্রি এগারোটা নাগাদ কিরীটী ও প্রতুল সেন এসে খিড়কির দরজাপথে বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করে খোলা বাথরুমের দরজা দিয়ে মৃণালের ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল।

ঘরের মধ্যে পূর্ব হতেই অন্ধকারে ঘাপটি মেরে ছিল প্রতুল সেনের এক বিশ্বস্ত অনুচর।

ফিসফিস করে প্রতুল সেন শুধালেন, কেউ এসেছে মৃণালের পাশের ঘরে?

না, স্যার।

মিনতি আছে তো ঘরে?

আছে।

প্রার্থিত আগন্তুক ঠিক এল রাত বারোটায়।

টুক টুক করে পাশের ঘরের দরজায় নক করলো।

দরজা খোলার শব্দ শোনা গেল।

তাদের মধ্যে সেরাত্রে যে সব কথাবার্তা হয়েছিল, পরে টেপ থেকেই তা শোনা যায়।

কে? মিনতির প্রশ্ন।

আমি।

তুমি? আবার কেন তুমি এসেছো?

তোমাকে আমার সঙ্গে নিয়ে যেতে, চল আমার সঙ্গে–

না।

চুল।

না, কিন্তু এখানে আর তুমি থেকো না—চলে যাও, আমি টের পেয়েছি পুলিস ছদ্মবেশে এ বাড়ির আশেপাশে ওৎ পেতে রয়েছে।

পুলিসের সাধ্যও নেই আমাকে ধরে।

বিশ্বাস করো, আমি সত্যি বলছি, আর তুমি হয়ত একটা কথা জানো না—

কিরীটী রায়–

সেই ছুঁচোর ব্যাটা চামচিকেতার সঙ্গে আমার মোলাকাত হয়েছে। চল—আর দেরি করো না।

তুমি আমার কথা শোন। আমি বলছি তুমি চলে যাও।

একা চলে যাবো-তাই কি হয়, তোমাকে একা ফেলে তো যেতে পারি না।

ওগো—

তারপরই একটা গোঁ গোঁ শব্দ।

কিরীটী পাশের ঘরে প্রস্তুতই ছিল। সঙ্গে সঙ্গে পরদা তুলে পাশের ঘরে ঢুকে পড়ে, তার পশ্চাতে প্রতুল সেন, তার হাতে ধরা পিস্তল।

বলাই বাহুল্য, আততায়ী পালাবার পথ পায় না। যে দুটো হাত তার মিনতির গলায় ফস পরিয়েছিল—তার সেই হাতের মুষ্টি আপনা থেকেই শিথিল হয়ে আসে। সে ফ্যালফ্যাল করে তাকায় প্রতুল সেনের হাতে ধরা উদ্যত পিস্তলটার দিকে। লোকটার পরনে পাজামা ও গায়ে কালো শার্ট। মুখে চাপদাড়ি।

কিরীটী কঠিন কণ্ঠে বললে, মিঃ সেন, ওই তপন ঘোষ ও সুদীপের হত্যাকারীঅ্যারেস্ট করুন।

প্রতুল সেন ডাকলেন, বীরবল, ওর হাতে হ্যান্ডকাপ লাগাও।

বীরবল পশ্চাতেই ছিল, হাতকড়া নিয়ে এগিয়ে এলো। লোকটার হাতে হাতকড়া পরাল।

মিনতিকেও ছাড়বেন না। ওর হাতেও হ্যান্ডকাপ পরান। আর এক জোড়া আনেননি?

বীরবলের কাছে আর এক জোড়া হাতকড়া ছিল; সে সেটার সদ্ব্যবহার করল।

ইতিমধ্যে গোলমাল শুনে বাড়ির অনেকে সেখানে এসে ভিড় করে।

তারা ব্যাপার দেখে ভীত-সন্ত্রস্ত।

কিরীটী এবার বললে প্রতুল সেনের দিকে তাকিয়ে, মহাপুরুষটিকে চিনতে পারলেন মিঃ সেন?

না তো।

অবিনাশ—

অবিনাশ সেন!

হ্যাঁ, দাড়িটা উৎপাটন করুন—বেশি লাগবে না কারণ স্পিরিট গামের সাহায্য নেওয়া হয়েছে—উৎপাটন করলেই আসল চেহারাটা প্রকাশ পাবে।

কিরীটীর কথা মিথ্যে নয় দেখা গেল।

অবিনাশ সেনই।

 

সেইদিন রাত্রিশেষে লালবাজারে প্রতুল সেনের অফিস কক্ষে—

কিরীটীকে ফিরে যেতে দেননি প্রতুল সেন। টেনে এনেছিলেন সঙ্গে করে।

প্রতুল সেন বলছিলেন, ব্যাপারটা কি আপনি বুঝতে পেরেছিলেন আগেই—মানে আসল হত্যাকারী কে?

বুঝতে পেরেছিলাম প্রথমেই বললে ভুল হবে—তবে কিছুটা অনুমান করেছিলাম।

কি?

বুঝতে পেরেছিলাম তপন ঘোষ, বিজিত মিত্র ও সুদীপ রায়—আপনার কাহিনীগুলির একঝকের পাখী—বার্ডস অফ দি সেম ফেদার। আর এও বুঝেছিলাম ওরা যন্ত্র মাত্র, আসল যন্ত্রী ওদের পশ্চাতে কেউ ছিল। কিন্তু কে সে? একটা ধাঁধা থেকে গিয়েছিল। তারপর মিনতির সঙ্গে দেখা করতেই ব্যাপারটাকে ঘিরে সন্দেহ আরো ঘনীভূত হলো।

কি রকম?

বিজিত মিত্রের স্ত্রী দেবিকার পরিচয় দিয়ে ভাদুড়ী মশাইয়ের পায়ে যে গিয়ে পড়েছিল সে আসলে দেবিকা নয়। বিজিত মিত্রের স্ত্রী নেই।

প্রতুল সেন বললেন, কি বলছেন আপনি?

ঠিকই বলছি। বিজিত মিত্রের কোন স্ত্রীই ছিল না।

তবে কে সে?

সে ওই মিনতি।

মিনতি।

হ্যাঁ। মনে আছে আপনার, অমিয়বাবুর সঙ্গে একটি মেয়ে ঘোমটা মাথায় এসে দেখা করেছিল?

মনে আছে।

সেই মেয়েটি ও দেবিকা নাম ধরে যে মেয়েটি ভাদুড়ী মশাইয়ের কাছে গিয়েছিল তারা এক ও অকৃত্রিম।

ও-ই মিনতি কি করে বুঝলেন?

ব্যাপারটা আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল সেইদিনই, যেদিন আমি আর ভাদুড়ী মশাই মিনতির সঙ্গে দেখা করতে যাই। মিনতির হাতে উল্কিতে লেখা এম অক্ষরটা দেখে। একবার ঘোমটা খুলে, একবার ঘোমটা দিয়ে গিয়েছিল সে। সঙ্গে সঙ্গে আমি অনুমান করছিলাম-মিনতিও ওই দলে আছে। আর তাই আজ রাত্রে ফাদটা পেতেছিলাম আপনার সক্রিয় সাহায্যে।

আচ্ছা সেদিন রাত্রে কি ঘটেছিল বলে আপনার মনে হয় মিঃ রায়?

অনুমানে মনে হয়–ওই অবিনাশ সেনই সে-রাত্রে পাশের ঘর থেকে মাঝের দরজা খুলে ওই ঘরে ঢুকে তপন ঘোষকে হত্যা করে। তারপর এক ঢিলে দুই পাখী মারার প্ল্যান। করে বিজিত মিত্রের মাথায় আঘাত করে এবং তার হাতে পিস্তলটা গুজে দিয়ে পালিয়ে যায়।

আচ্ছা মিনতি যদি ওই দলেরই, তবে সে অত কথা আপনাকে বললে কেন?

তার উপর থেকে সন্দেহটা দূর করবার জন্য। কারণ সে আমাকে দেখে আমার কথাবার্তা শুনে বুঝতে পেরেছিল, আদালতে যে মামলা শেষ হয়ে গিয়েছে সেটা আমার বিচারে শেষ নিষ্পত্তি নয়। এবারে হয়ত কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ বেরুবে। তাই অত কথা সে বলে আমাদের। কিন্তু সে বুঝতে পারেনি তখন তার ওই সব কথা তার বিরুদ্ধে আমার মনে সন্দেহ জাগাবে।

বিজিত মিত্রর কি হলো?

সম্ভবত মৃত্যুভয়ে সে আত্মগোপন করে আছে।

আর মৃণাল?

মনে হয় মৃণালকে আর কখনো খুঁজে পাওয়া যাবে না।

কিন্তু এরপর আমি–

নিরস্ত হবেন না, এই তো, তা খুঁজুন–যদি কখনো খুঁজে পান তাকে। কথাটা বলে কিরীটী মৃদু হাসলো।

Exit mobile version