আমারও তাই অনুমান। কিরীটী বললে, তাই ভাবছি কে হতে পারে মেয়েটি?
ভাদুড়ী মশাই!
বলুন।
মৃণালের চেহারার কোন ডেসক্রিপশন আপনার জানা আছে?
মেয়েটিকে তো আমরা কেউ দেখিনি।
আচ্ছা ঘটনার দিন পাশের ঘরে যে ভদ্রলোক ও মেয়েটি ছিল?
অবিনাশ সেন আর মিনতি দত্ত।
মেয়েটির নাম মিনতি দত্ত?
হ্যাঁ।
সে মেয়েটি তো মৃণালের পাশের ঘরেই থাকত। সেও রূপোপজীবিনী ছিল।
তার সাক্ষ্যও তো নেওয়া হয়েছে আদালতে।
জানি। আমি বলছিলাম—
কি বলুন?
মৃণালের ডিটেলস ওই মিনতির কাছে পাওয়া যেতে পারে।
তা অবিশ্যি পারে। তা এখনো তো বেশী রাত হয়নি। সেই পল্লীটা একবার ঘুরে যাবেন নাকি? সোমনাথ ভাদুড়ী বললেন।
গেলে আমার মনে হয় ভালোই হতো।
বেশ, চলুন।
সোমনাথ ভাদুড়ী ড্রাইভার সমরেশকে বললেন, কলেজ স্ট্রীটে যে শিবমন্দিরটা আছে সেদিকে যেতে।
গলিটা কুখ্যাত ছিল এককালে। বর্তমানে অবিশ্যি আর ততটা নেই—তাহলেও সেখানকার পুরাতন বাসিন্দারা কিছু কিছু সেখানে এখনো ছড়িয়ে আছে।
গলির মধ্যে গাড়ি নিলেন না সোমনাথ ভাদুড়ী। ট্রাম রাস্তার উপরেই একপাশে গাড়িটা দাঁড় করিয়ে দুজনে হেঁটে চললেন। সন্ধ্যার পর থেকেই গলিটাতে মানুষের চলাচল যেন বৃদ্ধি পায়। সোমনাথ ভাদুড়ী বাড়িটা ঠিক চিনতেন না কিন্তু বাড়ির নম্বরটা মনে ছিল। নম্বরটা খুঁজে পেতে দেরি হল না।
একটা দোতলা লাল রংয়ের পুরনো বাড়ি!
মিনতিকে একটি মেয়ে ডেকে দিল।
মিনতি বোধ হয় ঘরে বসে সাজসজ্জা করছিল। ডাক শুনে বের হয়ে এলো।
কি রে চাঁপা!
এই ভদ্রলোক দুটি তাকে খুঁজছেন।
মিনতি তাকাল। সোমনাথ ভাদুড়ীকে আদালতে দেখেছে। চিনতে তার কষ্ট হলো না। বললে, উকিলবাবু—
মিনতি, তোমার সঙ্গে আমাদের কিছু কথা আছে।
মিনতি মুহূর্তকাল যেন কি ভাবলো। তারপর বললে, আসুন উকিলবাবু ঘরে।
তিনজনে মিনতির ঘরে প্রবেশ করল।
ঘরটি বেশ গোছানো। ছিমছাম। একদিকে একটি পালঙ্ক পাতা। উপরে ধবধবে শয্যা পাতা। দুটি দুটি চারটি মাথার বালিশ, একটি মোটা পাশ-বালিশ। একধারে একটি কাঁচের পাল্লাওয়ালা আলমারি। কিছু রুপোর, কাঁচের ও কাঁসার বাসনপত্র। নানা ধরনের পুতুল, খান দুই চেয়ারও আছে একধারে।
বসুন উকিলবাবু। একটু চায়ের জোগাড় করি।
না না মেয়ে, তুমি ব্যস্ত হয়ো না। সোমনাথ ভাদুড়ী বললেন চেয়ারে বসতে বসতে।
মিনতি আর কথা বলে না।ওদের মুখের দিকে পর্যায়ক্রমে তাকায়।
মিনতি—
বলুন।
এই ভদ্রলোক তোমাকে মৃণালের ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করতে চান। সোমনাথ ভাদুড়ী বললেন।
মৃণাল!
কিরীটী দেওয়ালে একটা ফটোগ্রাফের দিকে তাকিয়েছিল। সেই ফটোর দিকে তাকিয়েই
কিরীটী প্রশ্ন করল, ওই ফটোটার একজনকে তো চিনতে পারছি–মনে হচ্ছে তুমিই, তাই না?
মিনতি বললে, হ্যাঁ, আমিই। আমার পাশে—
তোমার বোন বা কোন আত্মীয়া বুঝি? কিরীটী বললে।
না। আমার পাশে ওই মৃণাল। মিনতি বললে।
মৃণাল! মানে যে মেয়েটি–
ঠিকই ধরেছেন। যে মৃণালকে নিয়ে এতদিন ধরে মামলা চললো। যার খোঁজ পাওয়া যায়নি—
ফটোটা কবেকার তোলা? কতদিনের?
তা প্রায় বছর দুই হবে। হঠাৎ একদিন মৃণালের খেয়াল হলো একটা ফটো তুলবে আমাকে নিয়ে—কথাটা বলতে বলতে মিনতির চোখ দুটি ছলছল করে ওঠে।
বছর দুই আগেকার ও ফটো তাহলে?
হ্যাঁ। মৃণালই একদিন আমাকে জোর করে ধরে নিয়ে গিয়ে হ্যারিসন রোডের একটা স্টুডিও থেকে ফটোটা তোলায়। একটা কপি তার ঘরে ছিল, অন্যটা আমার ঘরে আমি বাঁধিয়ে রেখে দিয়েছিলাম। কিন্তু–
কি?
পুলিসের লোক খানা-তল্লাসী করতে এলে ফটোটা কিন্তু তার ঘরে পায় না। মনে হয় বাড়ি ছেড়ে সে-রাত্রে যাবার আগে ফটোটা সে সঙ্গেই নিয়ে গিয়েছে।
পুলিস সেদিন তোমার ঘর খানা-তল্লাসী করেনি?
করেছিল।
ওই ফটো সম্পর্কে কোন প্রশ্ন করেনি?
না।
মৃণালের সঙ্গে মনে হচ্ছে তোমার যথেষ্ট বন্ধুত্ব ছিল, তাই না?
ঠিক ধরেছেন, পুলিশকেও বলেছি—আপনাকেও বলছি, মৃণাল অত্যন্ত লক্ষ্মী ও শান্ত স্বভাবের ছিল। এ বাড়িতে একমাত্র আমার সঙ্গে ছাড়া আর কারো সঙ্গে মিশতো না, কথাও বলতো না বড় একটা।
মৃণাল তো তোমার পাশের ঘরেই থাকত?
হ্যাঁ।
ওই ঘরে এখন কে আছে?
কেউ নেই, ঘরটা আজও খালিই পড়ে আছে মৃণাল চলে যাবার পর থেকে।
কেন?
কেউ ও-ঘরে থাকতে চায়নি। মৃণাল খুব ভাল গান গাইতে পারত নাচতেও পারত। আজও মধ্যে মধ্যে রাত্রে নাকি ওর ঘর থেকে ঘুঙুরের শব্দ শোনা যায়।
তুমি শুনেছো?
না। সত্যি বলবো, আমি কোনদিন কিছু শুনিনি। কিন্তু মৃণালের কথা এত শুনতে চাইছেন কেন?
কথাটা তাহলে তোমাকে খুলেই বলি, কিরীটী বলল-তপন ঘোষের হত্যাকারীকে আজও পুলিস সর্বত্র খুঁজে বেড়াচ্ছে।
কিন্তু বাবু, বিশ্বাস করুন, মৃণাল তপনবাবুকে হত্যা করেনি।
আমিও সে-কথাটা বিশ্বাস করি–কিরীটী বলল।
বিশ্বাস করেন?
করি, আর তাই তো মৃণালের সন্ধান আমিও করছি।
আপনি–
সোমনাথ ভাদুড়ী ওই সময় বললেন, এই ভদ্রলোকের পরিচয় তুমি জান না। কিরীটী রায়ের নাম শুনেছ?
না তো!
উনি সত্যসন্ধানী। সে-রাত্রে পাশের ঘরে সত্যই কি ঘটেছিল উনি সেটাই জানবার চেষ্টা করছেন।
কিন্তু বাবু, আমি তো মৃণালের কোন সন্ধানই জানি না। বিশ্বাস করুন।
হয়তো জানো না, কিরীটী বললে, কিন্তু তুমি মৃণালের কথা যতটা জানো–অন্য কেউ হয়ত সেটা জানে না।
মিনতি বললে, পাশের ঘরে ছিল মৃণাল। দিনের বেলাটা প্রায়ই তার আমার ঘরেই কেটে যেত-তবে–
কি?