কিরীটী সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকাল ভাদুড়ী মশাইয়ের দিকে।
আজ দুপুরে আদালতে বিজিতের স্ত্রী—
কে, দেবিকা—
হ্যাঁ। দেবিকা এসেছিল আমার কাছে।
কেন?
বিজিত নাকি ঘরে ফিরে যায়নি জেল থেকে খালাস পাবার পর।
যায়নি।
না। সে জানত না বিজিত ছাড়া পেয়েছে। আজ আলিপুর সেনট্রাল জেলে তার স্বামীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে জানতে পারে গতকালই বিকালের দিকে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে আদালতের রায় বেরুবার পরই বেলা পাঁচটা নাগাদ। কিন্তু আজও সে ঘরে ফেরেনি—তাই দেবিকা এসেছিল আদালতে আমার সঙ্গে দেখা করতে। আমি তখন সেনট্রাল জেলে অমিয়নাথবাবুকে ফোন করি।
তিনি কি বললেন?
জেল-গেটের অদূরে একটা ট্যাক্সি নিয়ে এক ভদ্রমহিলা নাকি অপেক্ষা করছিলেন—
ভদ্রমহিলা।
জেলের প্রহরী সেইরকমই বলেছে। ভদ্রমহিলার মাথায় নাকি ঘোমটা ছিল। গায়ে একটা ব্লু রঙের ব্যাপার ছিল।
তারপর–
বিজিত মিত্র জেল থেকে বেরিয়ে যখন রাস্তার দিকে চলেছে, ভদ্রমহিলা ট্যাক্সি থেকে নেমে বিজিতের নাম ধরে ডাকতেই সে সোজা গিয়ে ট্যাক্সিতে নাকি উঠে বসে। ট্যাক্সিটা ছেড়ে দেয় সঙ্গে সঙ্গে।
ট্যাক্সি–গুনবতী মহিলা।
হ্যাঁ।
কিন্তু সেই মহিলা ঠিক ওই সময়ই বিজিত মিত্রকে ছাড়া হবে জানলেন কি করে? কিরীটীর প্রশ্ন।
ঐ ভদ্রমহিলাই কিনা জানা যায়নি, তবে আগের দিন নাকি এক ভদ্রমহিলা বেলা পাঁচটা নাগাদ এসেছিলেন জেলখানায়—জেলারের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। জেলারের মুখ থেকেই নাকি সে শুনেছিল আদালতের রায়ে তাকে মুক্তি দিলেই তাকে ছেড়ে দেওয়া হবে জেল থেকে।
মামলার রায় পরের দিনই বেরুবে আপনার অমিয়বাবু কি জানতেন?
জানতেন আর এ-ও জানতেন বিজিত মিত্র বেকসুর খালাস পাবে।
কি করে জানলেন?
আমিই বলেছিলাম। আপনি?
হ্যাঁ। অমিয়বাবু যেদিন রায় বের হয় তার আগের দিন সকালে আমাকে ফোন করেছিলেন।
আশ্চর্য!
কি?
হঠাৎ অমিয়বাবু আপনাকে ফোন করতে গিয়েছিলেন কেন, বিশেষত ওই বিচারাধীন কয়েদী সম্পর্কে! কথাটা তাকে জিজ্ঞাসা করেননি?
না।
কিরীটী ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে। বললে, চলুন।
কোথায়?
অমিয়বাবুর কোয়ার্টারে তার সঙ্গে একবার দেখা করে আসি।
বেশ, চলুন। কিন্তু এখুনি যাবেন?
হ্যাঁ।
সোমনাথ ভাদুড়ী উঠে দাঁড়ান।
জেলের নিকটেই অমিয়বাবুর কোয়ার্টার। অমিয়বাবু গৃহেই ছিলেন। সোমনাথ ভাদুড়ী কিরীটীকে নিয়ে এসে তার গৃহে প্রবেশ করলেন।
অমিয় চক্রবর্তী তার বসবার ঘরে বসে ওইদিনকার সংবাদপত্রটা পড়ছিলেন। বয়স্ অনুমান চল্লিশ থেকে বিয়াল্লিশের মধ্যে হবে তার।
বেশ হৃষ্ট-পুষ্ট গোলগাল চেহারা। একজোড়া বেশ ভারী গোঁফ। লম্বা জুলপী। জুলপীর চুলে কিছু কিছু পাক ধরেছে। চোখে চশমা।
সোমনাথ ভাদুড়ীকে ঘরে প্রবেশ করতে দেখে সহাস্যে সম্বোধন করলেন, মিঃ ভাদুড়ী যে—আসুন—আসুন। তারপরই কিরীটীর প্রতি নজর পড়াতে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালেন।
পরিচয় করিয়ে দিই অমিয়বাবু
অমিয়বাবু বললেন, পরিচয় করিয়ে দিতে হবে না মিঃ ভাদুড়ী। সাক্ষাৎ পরিচয় না থাকলেও ওঁকে আমি চিনি। আজ ওঁকে চেনে নাই বা কে? কিরীটীবাবু, বসুন-বসুন।
সোমনাথ ভাদুড়ী ও কিরীটী উপবেশন করে।
অমিয়বাবু! সোমনাথ বললেন।
বলুন–
তপন ঘোষ হত্যা মামলার আসামী বিজিত মিত্রকে কাল বিকালে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে?
হ্যাঁ—আপনাকে তো সে-কথা বলেছি।
সেজন্য আমরা আসিনি অমিয়বাবু। এসেছি অন্য একটা ব্যাপারে, কিরীটী এবার কথা বললে।
কি বলুন তো?
পরশু, মানে বিজিতবাবুকে যেদিন ছেড়ে দেওয়া হয় তার আগের দিন এক ভদ্রমহিলা আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন?
হ্যাঁ—আমার কোয়ার্টারে—বিজিতবাবুর সম্পর্কেই জিজ্ঞাসা করতে। মানে যদি সে আদালত থেকে মুক্তি পায় তো কখন তাকে ছেড়ে দেওয়া হতে পারে সেটাই জানতে।
সেই মহিলার ঠিক বয়স কত হবে বলে আপনার মনে হয় অমিয়বাবু? প্রশ্ন করল কিরীটী।
বোধ হয় ত্রিশ-বত্রিশ হবে। দোহারা পাতলা চেহারা, বেশ সুন্দর দেখতে। পরনে একটা দামী শাড়ি, পায়ে চপ্পল।
আচ্ছা অমিয়বাবু, তার চেহারার মধ্যে বিশেষ কিছু আপনার নজরে পড়েছিল কি? কিরীটী প্রশ্ন করল।
না। সেরকম তো কিছু মনে পড়ছে না। তবে—
কি? কিরীটী সোৎসুক ভাবে তাকাল অমিয়বাবুর মুখের দিকে।
আমার নজরে পড়েছিল তার বাঁ হাতে উল্কিতে লেখা ছিল একটা ইংরেজী অক্ষর এম।
এম! কথাটা মৃদু গলায় উচ্চারণ করে কিরীটী সোমনাথের দিকে তাকাল।
হ্যাঁ। অমিয়বাবু বললেন।
আর কিছু তার মুখের ঢংটা?
না। তার মুখটা আমি দেখতে পাইনি।
কেন?
মুখে ঘোমটা ছিল। চিবুকটা কেবল নজরে পড়েছে। উপরের ও নীচের ঠোট ও চিবুকের কিছুটা অংশ।
তার চলার বা বসবার—দাঁড়াবার ভঙ্গি?
না, আমি সেটা তেমন লক্ষ্য করিনি কিরীটীবাবু। আর তিনি বসেননি—আগাগোড়া। দাঁড়িয়েই ছিলেন মুখে ঘোমটা টেনে। মনে হচ্ছিল তিনি যেন আত্মপ্রকাশে অনিচ্ছুক।
তার নামটা জিজ্ঞেস করেননি? কোন পরিচয় দেন নি?
নাম বলেননি। আমি জিজ্ঞাসাও করিনি। তবে অবিশ্যি বলেছিলেন তিনি বিজিতবাবুর স্ত্রী।
কিরীটী সোমনাথ ভাদুড়ীর দিকে তাকাল।
দুজনের মধ্যে দৃষ্টি বিনিময় হলো।
চলুন ভাদুড়ী মশাই, এবার যাওয়া যাক। কিরীটী বললে।
০৪. অমিয়বাবুর কাছ থেকে বিদায়
ধন্যবাদ জানিয়ে অমিয়বাবুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে দুজনে বের হয়ে এলেন।
গাড়িতে উঠতে উঠতে কিরীটী বললে, আপনি তো দেবিকাকে দেখেছেন ভাদুড়ী মশাই?
হ্যাঁ। আজও তো মেয়েটি আদালতে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। কখনো সে মাথায় ঘোমটা দিয়ে আসেনি। তাছাড়া তার হাতে কোন উল্কি দেখিনি। তার রং অবিশ্যি। ফর্সাই। আমার মনে হয় সে দেবিকা নয় রায় মশাই।