কি নাম তোমার স্বামীর?
বিজিত মিত্র–
সোমনাথ ভাদুড়ীর মনে পড়লো মাত্র কয়েকদিন পূর্বেই আদালতে এক অ্যাডভোকেটের মুখে শুনেছিলেন ওই কেসটা সম্পর্কে।
বিচার চলেছে তার আদালতে।
মেয়েটি তখন আবার বলল, বাবা, আপনার ফিস দেবার ক্ষমতা আমার নেই। তবু এসেছি আপনার কাছে—এই গরীবকে দয়া করুন।
সোমনাথ ভাদুড়ী বলেছিলেন, তুমি দুদিন বাদে এসো।
বাবা! ব
ললাম তত দিন দুই বাদে এসো।
মেয়েটির হাতে দুগাছি সোনার বালা ছিল। সে দুটি হাত থেকে খুলতে দেখে সোমনাথ ভাদুড়ী বাধা দিলেন, কি করছো–
মেয়েটি বলল, বাবা, এই বালা জোড়া রাখুন; এ দুটো বেচে–
না—ও তুমি হাতে পরে নাও, কোন টাকা-পয়সা লাগবে না তোমার। কি নাম তোমার?
দেবিকা।
মেয়েটি সোমনাথ ভাদুড়ীর পায়ের ধুলো নিয়ে চলে গেল।
সোমনাথ ভাদুড়ী পরে বলেন, পরের দিন আদালতের যে ঘরে মামলাটা চলছিল সেই ঘরে গিয়ে ঢুকলাম। আসামীর কাঠগড়ায় লোকটা দাঁড়িয়েছিল, ভেরি ফারস্ট শাইটেই আমার মনে হয়েছিল রায়মশাই, লোকটা দুশ্চরিত্র এবং যে কোন ক্রাইমই ওর দ্বারা সম্ভব। ভাঙা গাল, হনু দুটো ঠেলে উঠেছে? বাঁদিককার গালে একটা জজুল আছে—সেই জড়লে গোটা দুই বড় বড় লোম।
কিরীটী মনে মনে ভাবে, ভাদুড়ী মশাইয়ের অনুমান হয়ত মিথ্যা নয়, তপন ঘোষকে যখন হত্যা করা হয় সেরাত্রে ওই বিজিত হয়ত সেখানে উপস্থিত ছিল।
মৃণাল মেয়েটি একটি বারবনিতা। দুশ্চরিত্রা মেয়ে।
অনেকেই রাত্রে তার ঘরে যেত। তাদের দলে হয়ত বিজিত, সুদীপ ও তপন ঘোষ ছিল। তারাও হয়ত ওই মৃণাল নামে বারবনিতার ঘরে যাতায়াত করত।
সুদীপ যে তার জবানবন্দিতে বলেছে তপন ঘোষকে সে চিনত না, কথাটা হয়ত মিথ্যা মামলার সঙ্গে জড়িয়ে পড়বার ভয়েই হয়ত সুদীপ সত্য কথাটা প্রকাশ করেনি।
তাছাড়া সত্যিই যদি সুদীপ সম্পূর্ণ নির্দোষ থাকত—বন্ধু ও সহকর্মীকে বাঁচানোর জন্য সে অনেক আগেই বিজিতের নির্দোষিতা প্রমাণের চেষ্টা করত।
সম্ভবত ওই খুনের ব্যাপারে সুদীপ জড়িত ছিল বলেই কোন-না-কোন ভাবে প্রথমটায় সে আদালতের ধারে-কাছেও যায়নি।
পরে যে সে সোমনাথ ভাদুড়ীর কাছে গিয়ে সাক্ষী দেবার কথা বলেছে ওই মামলায়, তার পশ্চাতেও হয়ত কোন কারণ ছিল।
কোন গুঢ় স্বার্থ!
যাহোক, স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে সুদীপ এবং বিজিত দুজনাই ওই হত্যা মামলার সঙ্গে জড়িত।
ওই হত্যা-মামলায় সবচাইতে বড় প্রশ্ন হচ্ছে ওই বারবনিতা মেয়েটি—মৃণাল।
গুলির শব্দের পর পাশের ঘরের লোকেরা ভীত হয়ে পুলিসকে খবর দেয়। পুলিস এসে দেখে তপন ঘোষ মৃত, রক্তাক্ত গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পড়ে আছে আর তার পাশে। জ্ঞানহীন হয়ে পড়ে আছে বিজিত মিত্র।
তার জামা কাপড়ে রক্তের দাগ। হাতে ধরা পিস্তল একটি, সে পিস্তল থেকে গুলি চালিয়েই তপন ঘোষকে হত্যা করা হয়েছিল এবং ঘরের মধ্যে মৃণাল নামে মেয়েটি নেই।
মৃণাল একেবারে উধাও।
কোথায় গেল মৃণাল?
সে কি পালিয়েছে না কারোর পরামর্শে কোথাও গা-ঢাকা দিয়ে আছে? যদি কারো পরামর্শেই গা-ঢাকা দিয়ে থাকে তো কার পরামর্শে?
পুলিস নাকি এখনো চারিদিকে মৃণালকে খুঁজে বেড়াচ্ছে।
সোমনাথ ভাদুড়ীর ধারণা—মৃণাল হত্যাকারী নয়। তবে সম্ভবত মৃণাল হয়ত হত্যা করতে দেখেছে।
কিগো, আজ কি শুতে যাবে না?
কৃষ্ণার গলা শুনে কিরীটী তাকাল কৃষ্ণার মুখের দিকে।
কিরীটী বলল, অনেক রাত হয়েছে, না!
অনেক রাত মানে-সোয়া তিনটে বাজে।
বল কি!
চল! এবারে একটু শোবে চল।
আর কি ঘুম হবে কৃষ্ণা, বেড়াতে বেরুবার সময় হলো।
সারাটা রাত না ঘুমিয়ে এখন বেড়াতে বেরোবে! কৃষ্ণা বললে।
তাহলে আজ আর না হয় না-ই বেড়াতে বেরুলাম। জংলীকে বললা কফি দিতে।
কৃষ্ণা কোনো কথা বললো না, ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
জংলীকে তোলেনি কৃষা, নিজেই কফি করে নিয়ে এল দুকাপ।
কফির কাপটা কিরীটীর হাতে তুলে দিয়ে মুখোমুখি অন্য একটা সোফায় বসলো কৃষ্ণা।
রাত্রিশেষের ঠাণ্ডা হাওয়া ঘরের মধ্যে এসে ঢোকে। হাওয়ায় এখনো বেশ শীতের আমেজ আছে—যদিও ফাল্গুন মাস পড়ে গিয়েছে।
কফির কাপে চুমুক দিয়ে কৃষ্ণা বললে, দেখ ভাবছিলাম, কিছুদিনের জন্য এ সময় বেনারস গিয়ে ঘুরে এলে কেমন হয়, ঠাণ্ডা আছে কিন্তু তীব্রতা নেই।
তা মন্দ হয় না–কিন্তু–
ভাদুড়ী মশাইয়ের মামলার কথা ভাবছো?
হ্যাঁ। মানে—
ওখানে বসেই না হয় ভাববে।
কেবল ভাবলেই তো হবে না, একটা কনকুশনে পৌঁছতে হবে তো?
কৃষ্ণা হেসে বললে, বাবা বিশ্বনাথের চরণে বসে দেখো, তোমার কনক্লশন ঠিক এসে যাবে। তাছাড়া–
কি, থামলে কেন, বল। কথাটা বলে কিরীটী কৃষার মুখের দিকে তাকাল।
তোমার কাহিনীর ঐ মৃণাল মেয়েটি—এমনও তো হতে পারে শেষ-মেশ গিয়ে ঐ বিশ্বনাথের চরণেই আশ্রয় নিয়েছে
মৃণালের জন্য আমি তত ভাবছি না কৃষ্ণা।
ভাবছে না!
না। ঘটনাস্থলে সে ছিলই সে-রাত্রে। কাজেই নিহত তপন ঘোষের দু-এক ফোটা রক্ত কি তার গায়ে আর লাগেনি! লেগেছে নিশ্চয়ই—সে-রক্তের দাগ সে মুছবে কেমন করে। সেই রক্তের দাগ থেকেই ঠিক তাকে আমি চিনে নিতে পারবো। যাকগে সে কথা। তুমি টিকিটের ব্যবস্থা করো-আমরা যাবো।
ঠিক তো?
ঠিক।
পরের দিন বিকালে।
কিরীটী আবার গোড়া থেকে মামলার কাগজগুলো পড়ছিল—সোমনাথ ভাদুড়ী আদালত-ফেরতা এসে কিরীটীর গৃহে হাজির হলেন।
আসুন আসুন ভাদুড়ী মশাই। মনে হচ্ছে কোন সংবাদ আছে।
ভাদুড়ী একটা সোফায় বসতে বসতে বললেন, সংবাদটা বোধ হয় তেমন কিছু নয় রায়মশাই। তবু মনে হলো—আপনাকে যাবার পথে জানিয়ে যাই—তাই এলাম।