সোমনাথ ভাদুড়ী কিন্তু আরো কিছুক্ষণ দোরগোড়ায় দাঁড়িয়েই রইলেন।
০৩. গৃহে ফিরতেই কৃষ্ণা শুধাল
গৃহে ফিরতেই কৃষ্ণা শুধাল, হঠাৎ সোমনাথ ভাদুড়ী তোমাকে ফোন করে ডেকেছিলেন কেন?
কিরীটী মৃদু হেসে বললে, চল, আগে খেয়ে নেওয়া যাক।
আহারাদির পর দুজনে এসে বসবার ঘরে দুটো সোফায় মুখখামুখি বসল।
জংলী এসে দুকাপ কফি রেখে গেল। কফির পাত্র শেষ করে কিরীটী একটা সিগারে অগ্নিসংযোগ করল।
বাইরে শীতের রাত্রি-ঝিমঝিম করছে যেন।
কিরীটী একসময় বললে, ভাদুড়ী মশায় একটা খুনের মামলার ব্যাপারে আমাকে ডেকেছিলেন। তবে আদালতে একপ্রস্থ ব্যাপারটার চরম নিষ্পত্তি হয়ে গিয়েছে—মানে আজ আদালত তার রায় দিয়েছে। হত্যাকারী বলে যে ব্যক্তি ধৃত হয়েছিল—দীর্ঘদিন ধরে যার বিচার হয়েছে—আদালত তাকে সম্পূর্ণ নির্দোষ বলে মুক্তি দিয়েছে।
তবে?
সেই তবেই ভাদুড়ী মশায়ের প্রশ্ন, কৃষ্ণা।
বুঝলাম না ঠিক। কৃষ্ণা বলল।
মামলায় আসামীর বিরুদ্ধে এমন সাক্ষ্য-প্রমাণাদি ছিল যে সোমনাথ ভাদুড়ীর মত উঁদে লইয়ারও হালে পানি পাচ্ছিলেন না। এমন সময় এক সাক্ষীর আবির্ভাব–
কি রকম?
সে এসে সোমনাথ ভাদুড়ীকে বলল, আসামী নির্দোষ—সে সাক্ষী দেবে। সোমনাথ ভাদুড়ী কিন্তু খুশি হলেন না—যদিও আসামীর স্ত্রী চোখের জলের মিনতিতে তিনি তখন। রীতিমত বিচলিত–আপ্রাণ চেষ্টা করছেন আইনের কোন ফাঁক বের করতে, যাতে করে আসামীকে মুক্ত করে আনতে পারেন।
তারপর–
আসামী ওই লোকটির সাক্ষ্যর জোরেই শেষ পর্যন্ত মুক্তি পেল কিন্তু ভাদুড়ী মশাইয়ের মনের মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব থেকে গিয়েছে।
কিসের দ্বন্দ্ব? সাক্ষী যা বলছে তা পুরোপুরি সত্য নয়। দেখ, যা বুঝলাম, তা হচ্ছে—
কি?
ওই সাক্ষীকেই সোমনাথ ভাদুড়ী সন্দেহ করছেন।
সত্যি?
হ্যাঁ।
ওই ফাইলটা বোধ হয় সেই মামলার? কৃষ্ণা শুধালো।
হ্যাঁ।
রাত্রের ঘুমও তাহলে গেল আজ—
না, না—তুমি শুয়ে পড়গে কৃষ্ণা—আমি ফাইলগুলো একটু উল্টেই আসছি।
ঠিক আছে। বেশী দেরি করো না কিন্তু!
কিরীটী সহধর্মিণীর দিকে তাকিয়ে একটু হাসল।
ফাইলের টাইপ করা পৃষ্ঠাগুলো ওল্টাতে ওল্টাতে অন্যমনস্কভাবে একটা পাতায় এসে তার দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো।
আদালতের প্রশ্ন : আপনার নাম?
উত্তর : শ্ৰীমতী দেবিকা মিত্র।
আসামীর কাঠগড়ায় যে দাঁড়িয়ে আছে তাকে আপনি চেনেন?
চিনি। আমার স্বামী।
কতদিন আপনাদের বিবাহ হয়েছে?
সাত বছর।
ছেলেপুলে?
না। কোন সন্তান হয়নি আদৌ।
সন্তান চান না আপনারা?
চাই বৈকি।
তা কোন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেননি?
নিয়েছিলাম। ডাঃ গোরাদ নন্দী, স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ।
তিনি কি বলেছিলেন পরীক্ষা করে?
বলেছিলেন—
বলুন।
আমাদের নাকি কখনো কোন সন্তানাদি হবার আশা নেই।
কেন?
তা তিনি বলেননি।
কিরীটী দ্রুত কয়েকটা পৃষ্ঠা উল্টে গেল। নিশ্চয়ই আদালত ডেকেছিল ডাঃ নন্দীকে তার সাক্ষ্য দেবার জন্য। তার অনুমান মিথ্যা নয়।
পাওয়া গেল—-ডাঃ নন্দী তার পুরাতন রেকর্ড দেখে বলেছেন, ওদের সন্তান হবার কোন সম্ভাবনাই ছিল না। কারণ-বিবাহের আগেই বিজিত মিত্র কুৎসিত এক রোগে আক্রান্ত হয়েছিল কিন্তু তখন চিকিৎসা করেননি ভদ্রলোক—ফলে সেই রোগ স্ত্রীর দেহে সংক্রামিত হয়, পরে অবিশ্যি বেশ কিছুদিন পরে চিকিৎসা করান দুজনই। কিন্তু ঐ রোগ যা ক্ষতি করবার করে দিয়েছিল—স্বামীর প্রজনন-শক্তি সম্পূর্ণভাবে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল।
আদালতের প্রশ্ন, আপনি কথাটা বলেননি ওদের?
স্বামীকে বলেছিলাম।
চিকিৎসা কোনরকম করেননি?
করেছিলাম কিন্তু কোন ফল হয়নি।
লোকটির চরিত্র কিরীটীর চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কিরীটী একটা সিগারে নতুন করে অগ্নিসংযোগ করে।
দেওয়াল-ঘড়িটা ঢং করে একটা শব্দ তুলে থেমে গেল সময়ের সমুদ্রে।
বাইরে শীতের ঝিমঝিম রাত।
কিরীটী আবার অন্যমনস্কভাবে ফাইলের পাতা ওল্টাতে থাকে আর মনের মধ্যে তার অলক্ষ্যে একটা অদেখা মানুষের ছবি যেন একটু অন্ধকারে স্পষ্ট আকার নিতে থাকে, আজ রাত্রেই সোমনাথ ভাদুড়ীর মুখ থেকে শোনা কাহিনী থেকে।
মানুষটার চেহারা–সোমনাথ ভাদুড়ী বলেছিলেন, অত্যন্ত সাদামাটা-মোস্ট আনইমপ্রেসিভ যাকে বলে। গাল দুটো ভাঙা কিছুটা যেন গর্তে ঢোকানো। পাতলা ভ্র। গোল বর্তুলাকার দুটি চক্ষু। কিন্তু চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ। গালের হনু দুটো বদ্বীপের মত যেন ঠেলে উঠেছে।
মাথায় পাতলা চুল। শরীরটার উপর মনে হয় অনেক অত্যাচার হয়েছে।
কিন্তু আপনাকে তো আগেই বলেছি রায়মশাই, ওই হত্যা-মামলা আমার হাতে নেবার কোন সম্ভাবনাই ছিল না, নিতামও না, কিন্তু মেয়েটি এসে হঠাৎ একদিন আমার চেম্বারে দুপা জড়িয়ে ধরে কেঁদে পড়ল।
কে? কি ব্যাপার? আরে, উঠুন—উঠুন।
আমার স্বামীকে আপনি বাঁচান, বাবা।
উঠুন—বলুন কি হয়েছে আপনার স্বামীর?
না। আগে বলুন দয়া করবেন।
কি হয়েছে আপনার স্বামীর?
খুনের মামলার আসামী সে আজ।
খুনের মামলা!
হাঁ বাবা, আমার স্বামীর চরিত্রের মধ্যে যত দোষই থাক—সে ওই তপন ঘোষকে খুন করেনি।
উঠে বসুন। ব্যাপারটা আমাকে খুলে বলুন।
আগে আমাকে কথা দিন।
ঠিক আছে, তুমি উঠে বসো।
মেয়েটি উঠে বসে মাথার ঘোমটা খুলে দিল। বয়স ত্রিশ-বত্রিশ হবে—কিন্তু মধ্যযৌবন অতিক্রান্ত হতে চললেও যেমন এখনও দেহের বাঁধুনি, তেমনি রূপ, রূপের যেন। অবধি নেই। দুচোখে অবিরত অশ্রু ঝরে চলেছে।
মেয়েটি বলল, বাবা, এ সংসারে আমার আর কেউ নেই—ওই স্বামী ছাড়া। গরীবের মেয়ে। দয়া করে উনি আমাকে বিয়ে না করলে হয়ত শেষ পর্যন্ত রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভিক্ষে করতে হতো—কিংবা—