না। তপন ঘোষ মাস তিনেক হলো মারা গিয়েছে—পিস্তলের গুলিতে।
কি বলছো তুমি আবোল-তাবোল?
এই দেখো রমা, আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছে। আমি ঠিকই বলছি। এ তপন ঘোষ ছাড়া আর কেউ নয়।
রমা কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। তারপর বলল, রাত অনেক হয়েছে। এবারে শোবে চল।
আর এক পেগ হুইস্কি খাবে রমা? সুদীপ বলল।
না।
একটা কথা ভাবছি রমা।
কি?
কলকাতায় একটা ফ্ল্যাট কিনবো।
ফ্ল্যাট কিনবে কলকাতায়! কি বলছো? রমার কণ্ঠে বিস্ময় স্পষ্ট হয়ে ওঠে, অত টাকা তুমি পাবে কোথায়?
ফ্ল্যাট আমি দেখেছি—এখন হাজার দশেক মত দিতে হবে, তারপর বাকী চল্লিশ হাজার টাকা মাসে মাসে ত্রিশটা ইনস্টলমেন্টে—সে হয়ে যাবে।
কিন্তু ওই দশ হাজার টাকা কোথা থেকে আসবে? রমা আবার প্রশ্ন করে।
ব্যাঙ্কে কিছু আছে। কিছু ফিক্সড ডিপোজিট তোমার নামে আছে—আর বাকীটা ধার করবো বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে।
না না—এই তো বেশ আছি আমরা। ফ্ল্যাট নিয়ে কি হবে?
ফ্ল্যাটটা দেখলে তোমার খুব পছন্দ হবে দেখো। বালিগঞ্জে—একেবারে স্টেশনের কাছাকাছি। সাততলার উপরে। হু হু করে বাতাস বইতে থাকে সর্বক্ষণ। রাত্রে ট্রেনের শব্দ শুনতে পাবে। ট্রেন আসছে-যাচ্ছে–
না। ওসব ধার-কর্জের মধ্যে যেও না।
সত্যি রমা তোমার কোন অ্যামবিশন নেই। আমি কিন্তু ফ্ল্যাটটা কিনবো ঠিক করেছি।
দেখো ধার-কর্জর মধ্যে যেও না।
চল-শুইগে। সুদীপ গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে পড়ল।
০২. সুদীপের ঘুম আসে না
বিছানায় শুয়ে সুদীপের ঘুম কিন্তু আসে না। অন্ধকারে বালিশে মাথা রেখে সামনের খোলা জানালাটার দিকে চেয়ে থাকে।
সব টাকাটাই অবিশ্যি সে নগদ এখুনি দিয়ে দিতে পারে। কিন্তু তাহলে টাকাটার সোর্স নিয়ে গোলমাল বাধবে। ব্যাঙ্কে মাত্র হাজার তিনেক আছে আর ফিক্সড ডিপোজিটে আছে হাজার পাঁচেক হিসাবে মিলাতে পারবে না; বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে আর কত সে ধার পেতে পারে, বড়জোর হাজার দু-তিন। অথচ তার অফিসের ড্রয়ারের মধ্যে করকরে চল্লিশ হাজার টাকার নোট রয়েছে। ওই চল্লিশ আর ফিক্সড ডিপোজিটের পাঁচ ব্যাঙ্কের তিন—মাত্র হাজার দুই টাকা বেশী-সে তো অফিস থেকেই লোন পেতে পারে।
কিন্তু হিসাব মেলাতে পারবে না। চল্লিশ হাজার টাকা ধার দেবে কে তাকে? মাত্র তো তিনশো টাকা মাসমাহিনা তার।
না। রমা ঠিকই বলেছে। ফ্ল্যাট কেনার এখন দরকার নেই। ওই সময় আবার মনে পড়লো বিজিত মিত্রর কথা।
কাল একবার অফিসের পর বিজিতের অ্যাডভোকেট সোমনাথ ভাদুড়ীর সঙ্গে দেখা করবে। লোকটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেই যেন বুকের মধ্যে কেমন দুপদুপ করতে থাকে।
সুদীপ শুনেছে ক্রিমিন্যাল সাইডের একজন বাঘা অ্যাডভোকেট সোমনাথ ভাদুড়ী।
চশমার পুরু কাঁচের মধ্যে দিয়ে লোকটা যখন তাকায় মনে হয় যেন অপর পক্ষের পেট থেকে কথা টেনে বের করবেন। রোমশ জোড়া ভ্র। বয়েস প্রায় এখন সত্তরের কাছাকাছি। মাথার সব চুল সাদা হয়ে গিয়েছে।
বেঁটে-খাটো মানুষটা। কথা বলার সময় ডান হাতে ধরা পেনসিলটা দু আঙুলের সাহায্যে মধ্যে মধ্যে নাচান। ভরাট ভারী গলা।
কথা বললে মনে হয় যেন একটা জালার ভিতর থেকে কথাগুলো গম গম করে বের হয়ে আসছে।
সুদীপের সাক্ষ্য দেবার কথাটা বলতে শুনে মানুষটা এমনভাবে তার দিকে তাকিয়ে ছিলো যেন সুদীপ কত বড় অপরাধ করে ফেলেছে।
আপনি সাক্ষ্য দেবেন?
আজ্ঞে। মানে-হঠাৎ যেন তোতলাতে শুরু করেছিল সুদীপ সেদিন।
কি নাম আপনার বললেন যেন! রোমশ ভ্র-যুগলের নীচে চশমার পুরু লেন্সের ওধার থেকে তাকালেন সোমনাথ ভাদুড়ী।
সুদীপ রায়।
নিহত তপন ঘোষকে আপনি চিনতেন? প্রশ্ন এলো যেন তীক্ষ্ণ ছুরির ফলার মত বিদ্ধ করলো সুদীপকে।
না। তবে আসামী বিজিত মিত্রকে চিনি।
চেনেন? কতদিনের পরিচয় আপনাদের?
তা বলতে পারেন অনেক দিনের। বিজিত তপন ঘোষকে মারেনি। মানে হত্যা করেনি।
হত্যা করেনি?
না। আমার সব কথা শুনলেই বুঝতে পারবেন স্যার—ব্যাপারটা সব সাজানো বলেই আমার মনে হয়।
বলতে চান কনককটেড?
হ্যাঁ, মানে—
কি রকম।
সুদীপ তখন আদালতে যা পরে বলেছিল সেই কথাগুলো সোমনাথ ভাদুড়ীকে বলল। মন দিয়ে সুদীপের সব কথা শুনলেন সোমনাথ ভাদুড়ী।
হুঁ। তা এসব কথা আগে পুলিসকে জানাননি কেন?
ভয়ে।
কি বললেন? ভয়ে?
হ্যাঁ–বুঝতেই তো পারছেন খুনের মামলা। এই সব মামলায় কে সেধে জড়িয়ে পড়তে চায় বলুন, স্যার।
তবে আজকেই বা বলতে চান কেন?
একজন নির্দোষীর ফাঁসি হবে–
রোমশ ভ্রর তলায় পুরু লেন্সের ওধার থেকে কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন অতঃপর সোমনাথ ভাদুড়ী সুদীপের মুখের দিকে।
সুদীপের ওই মুহূর্তে মনে হয়েছিল সেই দৃষ্টির মধ্যে যেন সন্দেহ-অবিশ্বাস তার আপাদ-মস্তককে জরীপ করে চলেছে।
পাবলিক প্রসিকিউটার অম্বিকা সান্যাল-তার জেরার মুখে দাঁড়াতে পারবেন তো? তিনি আপনাকে পোস্টমর্টেম করবেন। বাঘা বাঘা সাক্ষীও তার জেরার মুখে নার্ভ হারায়।
যা সত্যি তা বলবোভয় পাবো কেন, আপনিই বলুন না স্যার।
ঠিক আছে, আদালতে একটা এফিডেবিট করতে হবে। যা করবার আমিই করবো। আপনার ঠিকানাটা রেখে যান। সময়মত সমন পাবেন।
সমন!
হ্যাঁ, সাক্ষীর সমন যাবে আদালত থেকে আপনার ঠিকানাটা বলুন।
সুদীপ তার অফিসের ঠিকানাই দিয়ে এসেছিল।
চলে আসবার আগে সোেমনাথ আবার শুধিয়েছিলেন, শেষ পর্যন্ত পিছিয়ে যাবেন না তো?
না, না।
সাক্ষীর কাঠগড়ায় দণ্ডায়মান সুদীপ রায়কে সরকারপক্ষের কৌসুলী অম্বিকা সান্যাল রীতিমত প্রশ্নে প্রশ্নে পর্যদস্ত করেছিলেন।