হঠাৎ রমার কণ্ঠস্বরে চমকে ফিরে তাকাল।
রমা যেন কখন এসে আবার তার পাশে দাঁড়িয়েছে। বললে, কি দেখছো?
না। কই, কিছু না তো!
তবে অমন করে দেখছিলে কি?
চল। ভিতরে চল। সুদীপ বললে।
মনে মনে একটা হিসাব করছিল সুদীপ। কথাটা আজই তার মনে হয়েছে সর্বপ্রথম। ঠিক দশদিন ধরে রাত্রে বাড়ি ফিরবার সময় সে ওর পশ্চাতে পদশব্দটা শুনছে।
ঠিক দশদিন। পনেরোই নভেম্বর আজ। তিন, চার ও পাঁচই নভেম্বর পর পর তিনতিনটে দিন সাক্ষীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আদালতে তাকে সাক্ষ্য দিতে হয়েছিল তপন ঘোষের হত্যার ব্যাপারে।
আদালতের রায় বের হয়েছে কিনা জানে না সুদীপ। কোন খোঁজ রাখে নি। তবে এটা সে বুঝেছিল তার সাক্ষ্যের পর বিজিতের ফাঁসি হবে না। সোমনাথ ভাদুড়ী সেই রকমই বলেছেন। এবং সে সাক্ষ্য না দিলে হয়ত বিজিতের ফাঁসিই হতো। কারণ মৃতের গুলিবিদ্ধ রক্তাক্ত দেহটার সামনে সেও পড়েছিল জ্ঞান হারিয়ে। হাতের মুঠোর মধ্যে তার যে পিস্তলটা ছিল সেই পিস্তলের চেম্বারে পাঁচটি গুলি ছিল। একটি ছিল ফাকা। এবং ব্যালেস্টিক পরীক্ষায় তা প্রমাণিত হয়েছে। সেই পিস্তল থেকে গুলি ছোঁড়া হয়েছিল। এবং যে গুলিটা মৃতদেহকে ভেদ করে গিয়ে পাশের দেওয়ালে বিঁধেছিল সেটা ওই পিস্তল থেকেই যে ফায়ার করা হয়েছিল তাও প্রমাণিত হয়েছিল।
মৃণালের পাশের ঘরের লোকটি অবিনাশ সেন ও মেয়েটি মিনতিতারা সাক্ষ্য দিয়েছিল আদালতে। সন্ধ্যার কিছু পরে মৃণাল নামে মেয়েটির ঘরে তারা বিজিত মিত্রকে ঢুকতে দেখেছে। বিজিত মিত্র নাকি প্রায়ই মৃণালের ঘরে আসত। ঘণ্টা দু-তিন থাকত। আবোরা প্রমাণিত হয়েছিল–বিজিত মিত্র তপন ঘোষের সঙ্গে চোরাকারবার করত। এবং মধ্যে মধ্যে মৃণালের ঘরে ওরা দুজন কখনো একা, কখনো একত্রে যাতায়াত করত।
মৃণালের কিন্তু কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি।
সুদীপ সাক্ষ্য দিয়েছিল আদালতে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে : যে রাত্রে দুর্ঘটনা ঘটে, সে-রাত্রে ওই পল্লীর সামনে দিয়ে সে ও বিজিত মিত্র একত্রে ফিরছিল—হঠাৎ দুজন লোক তাদের আক্রমণ করে—বিজিতের মাথায় একটা ভারী বস্তু দিয়ে আঘাত করে। বিজিত সঙ্গে সঙ্গে অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে যায়—সুদীপ ছুটে পালায় প্রাণভয়ে। কিছুদূর গিয়ে একটা গলির মুখে দাঁড়িয়ে সে দেখে সেই লোক দুটো বিজিতের জ্ঞানহীন দেহটা একটা গাড়িতে তুলে নিয়ে চলে গেল। রাত তখন পৌনে দুটো।
কাজেই রাত সাড়ে বারোটা নাগাদ যদি মৃণালের ঘর থেকে পিস্তলের আওয়াজ শোনা গিয়ে থাকে এবং ময়না তদন্তে যদি প্রমাণিত হয়ে থাকে রাত বারোটা থেকে সাড়ে বারোটার মধ্যে কোন এক সময় গুলির আঘাতে তপন ঘোষের মৃত্যু হয়েছে, সেক্ষেত্রে তপন ঘোষের হত্যাকারী বিজিত মিত্র হতেই পারে না। সারকামস্টানশিয়াল এভিডেন্স যেমন তার বিরুদ্ধে নেই—তেমনি আছে রিজনেবল ডাউট।
সুদীপ মকদ্দমার রায় বের হয়েছে কিনা জানে না কিন্তু বিজিত মিত্র যে দোষী সাব্যস্ত হবে না সোমনাথ ভাদুড়ীর কথায় সেটা সে বুঝেছিল। তাছাড়া মৃণাল নামক মেয়েটির সন্ধান আজও পাওয়া যায়নি—একমাত্র হয়ত যে ছিল প্রত্যক্ষ সাক্ষী।
স্নান ও আহারাদির পর সুদীপ জানালার সামনে ইজিচেয়ারটায় গা এলিয়ে একটা পাতলা শাল গায়ে দিয়ে বসে বসে সিগ্রেট টানছিল।
আজ রাত আরো বেশী হয়েছে, বোধ করি রাত দুটো।
রমা রান্নাঘরের কাজ সেরে এসে পাশে দাঁড়াল, কি হলো? শুতে যাবে না?
বোসো রমা, তোমার সঙ্গে কথা আছে। সুদীপ বললো।
আমার বড্ড ঘুম পাচ্ছে।
ঘুম পাচ্ছে।
হ্যাঁ।
দাঁড়াও—আসছি। সুদীপ পাশের ঘরে গেল। আলমারি খুলে একটা স্মাগল করা স্কচ হুইস্কির ছোট চ্যাপটা বোতল থেকে দুটো গ্লাসে হুইস্কি ঢালল, একটু জল মেশাল কুঁজো থেকে—পরে ফিরে এলো গ্লাস দুটো হাতে পাশের ঘরে।
নিজে একটা গ্লাস নিয়ে, অন্য গ্লাসটা রমার দিকে এগিয়ে দিল সুদীপ। নাও এটা খেয়ে নাও।
কি এটা?
খেয়ে ফেল।
না! বল কি?
বিষ নয়। খাও।
রমা আর আপত্তি জানায় না। এক চুমুকে গ্লাসটা শেষ করে ফেলে, গলার ভিতরটা জ্বলে ওঠে।
মাগো, কি এটা—
হুইস্কি।
তুমি আমাকে মদ খাওয়ালে?
মধ্যে মধ্যে খাওয়া ভাল।
ভাল?
হ্যাঁ। শরীরের উপকার হয়। ডাক্তাররা বলেন, অ্যালকোহল ইজ দ্য বেস্ট ফুড।
রমার মাথাটা তখন যেন ঝিম ঝিম করছে।
আমার বোধ হয় নেশা হচ্ছে–রমা বলল।
সুদীপ বলল, কিছু হবে না। অতটুকু হুইস্কিতে নেশা হয় না কারো। কিছুক্ষণ বাদেই সব ঠিক হয়ে যাবে দেখো। বোসো ঐ চেয়ারটায়।
রমা বসলো সামনের চেয়ারটার উপরে।
রমার বুকটা গরম গরম লাগছে। কান দুটোও।
জান রমা, আজ কদিন ধরে দেখছি বাড়ি ফেরার পথে কে যেন আমাকে ফলো করে।
ফলো করে তোমায়?
হ্যাঁ।
কে ফলো করে?
তা জানি না।
দেখতে পাওনি লোকটাকে?
না।
তবে বুঝলে কি করে ফলো করছে কেউ তোমাকে?
করে। আমি জানি।
কিন্তু কেই বা তোমায় ফলো করবে–আর কেনই বা করতে যাবে!
হয়ত—
কি?
কেউ কিছু বলতে চায় আমায়।
কে আবার কি বলতে চাইবে তোমাকে? আর যদি বলতে চায় তো সামনাসামনি এসে বললেই তো পারে। ফলো করবার কি দরকার?
আমার কি মনে হয় জানো রমা—
কি?
তপন ঘোষ আমাকে কিছু বলতে চায়।
তপন ঘোষ! কে সে?
আমার সঙ্গে লোকটার পরিচয় ছিল। মানে তাকে আমি চিনতাম।
তা তার সঙ্গে একদিন দেখা করে কথাটা জিজ্ঞাসা করলেই পারো।
তার যে কোন উপায়ই আর নেই।
উপায় নেই! কেন? রমা বিস্ময়ের সঙ্গেই যেন তাকায় সুদীপের মুখের দিকে।