পুলিসের সাধ্যও নেই আমাকে ধরে।
বিশ্বাস করো, আমি সত্যি বলছি, আর তুমি হয়ত একটা কথা জানো না—
কিরীটী রায়–
সেই ছুঁচোর ব্যাটা চামচিকেতার সঙ্গে আমার মোলাকাত হয়েছে। চল—আর দেরি করো না।
তুমি আমার কথা শোন। আমি বলছি তুমি চলে যাও।
একা চলে যাবো-তাই কি হয়, তোমাকে একা ফেলে তো যেতে পারি না।
ওগো—
তারপরই একটা গোঁ গোঁ শব্দ।
কিরীটী পাশের ঘরে প্রস্তুতই ছিল। সঙ্গে সঙ্গে পরদা তুলে পাশের ঘরে ঢুকে পড়ে, তার পশ্চাতে প্রতুল সেন, তার হাতে ধরা পিস্তল।
বলাই বাহুল্য, আততায়ী পালাবার পথ পায় না। যে দুটো হাত তার মিনতির গলায় ফস পরিয়েছিল—তার সেই হাতের মুষ্টি আপনা থেকেই শিথিল হয়ে আসে। সে ফ্যালফ্যাল করে তাকায় প্রতুল সেনের হাতে ধরা উদ্যত পিস্তলটার দিকে। লোকটার পরনে পাজামা ও গায়ে কালো শার্ট। মুখে চাপদাড়ি।
কিরীটী কঠিন কণ্ঠে বললে, মিঃ সেন, ওই তপন ঘোষ ও সুদীপের হত্যাকারীঅ্যারেস্ট করুন।
প্রতুল সেন ডাকলেন, বীরবল, ওর হাতে হ্যান্ডকাপ লাগাও।
বীরবল পশ্চাতেই ছিল, হাতকড়া নিয়ে এগিয়ে এলো। লোকটার হাতে হাতকড়া পরাল।
মিনতিকেও ছাড়বেন না। ওর হাতেও হ্যান্ডকাপ পরান। আর এক জোড়া আনেননি?
বীরবলের কাছে আর এক জোড়া হাতকড়া ছিল; সে সেটার সদ্ব্যবহার করল।
ইতিমধ্যে গোলমাল শুনে বাড়ির অনেকে সেখানে এসে ভিড় করে।
তারা ব্যাপার দেখে ভীত-সন্ত্রস্ত।
কিরীটী এবার বললে প্রতুল সেনের দিকে তাকিয়ে, মহাপুরুষটিকে চিনতে পারলেন মিঃ সেন?
না তো।
অবিনাশ—
অবিনাশ সেন!
হ্যাঁ, দাড়িটা উৎপাটন করুন—বেশি লাগবে না কারণ স্পিরিট গামের সাহায্য নেওয়া হয়েছে—উৎপাটন করলেই আসল চেহারাটা প্রকাশ পাবে।
কিরীটীর কথা মিথ্যে নয় দেখা গেল।
অবিনাশ সেনই।
সেইদিন রাত্রিশেষে লালবাজারে প্রতুল সেনের অফিস কক্ষে—
কিরীটীকে ফিরে যেতে দেননি প্রতুল সেন। টেনে এনেছিলেন সঙ্গে করে।
প্রতুল সেন বলছিলেন, ব্যাপারটা কি আপনি বুঝতে পেরেছিলেন আগেই—মানে আসল হত্যাকারী কে?
বুঝতে পেরেছিলাম প্রথমেই বললে ভুল হবে—তবে কিছুটা অনুমান করেছিলাম।
কি?
বুঝতে পেরেছিলাম তপন ঘোষ, বিজিত মিত্র ও সুদীপ রায়—আপনার কাহিনীগুলির একঝকের পাখী—বার্ডস অফ দি সেম ফেদার। আর এও বুঝেছিলাম ওরা যন্ত্র মাত্র, আসল যন্ত্রী ওদের পশ্চাতে কেউ ছিল। কিন্তু কে সে? একটা ধাঁধা থেকে গিয়েছিল। তারপর মিনতির সঙ্গে দেখা করতেই ব্যাপারটাকে ঘিরে সন্দেহ আরো ঘনীভূত হলো।
কি রকম?
বিজিত মিত্রের স্ত্রী দেবিকার পরিচয় দিয়ে ভাদুড়ী মশাইয়ের পায়ে যে গিয়ে পড়েছিল সে আসলে দেবিকা নয়। বিজিত মিত্রের স্ত্রী নেই।
প্রতুল সেন বললেন, কি বলছেন আপনি?
ঠিকই বলছি। বিজিত মিত্রের কোন স্ত্রীই ছিল না।
তবে কে সে?
সে ওই মিনতি।
মিনতি।
হ্যাঁ। মনে আছে আপনার, অমিয়বাবুর সঙ্গে একটি মেয়ে ঘোমটা মাথায় এসে দেখা করেছিল?
মনে আছে।
সেই মেয়েটি ও দেবিকা নাম ধরে যে মেয়েটি ভাদুড়ী মশাইয়ের কাছে গিয়েছিল তারা এক ও অকৃত্রিম।
ও-ই মিনতি কি করে বুঝলেন?
ব্যাপারটা আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল সেইদিনই, যেদিন আমি আর ভাদুড়ী মশাই মিনতির সঙ্গে দেখা করতে যাই। মিনতির হাতে উল্কিতে লেখা এম অক্ষরটা দেখে। একবার ঘোমটা খুলে, একবার ঘোমটা দিয়ে গিয়েছিল সে। সঙ্গে সঙ্গে আমি অনুমান করছিলাম-মিনতিও ওই দলে আছে। আর তাই আজ রাত্রে ফাদটা পেতেছিলাম আপনার সক্রিয় সাহায্যে।
আচ্ছা সেদিন রাত্রে কি ঘটেছিল বলে আপনার মনে হয় মিঃ রায়?
অনুমানে মনে হয়–ওই অবিনাশ সেনই সে-রাত্রে পাশের ঘর থেকে মাঝের দরজা খুলে ওই ঘরে ঢুকে তপন ঘোষকে হত্যা করে। তারপর এক ঢিলে দুই পাখী মারার প্ল্যান। করে বিজিত মিত্রের মাথায় আঘাত করে এবং তার হাতে পিস্তলটা গুজে দিয়ে পালিয়ে যায়।
আচ্ছা মিনতি যদি ওই দলেরই, তবে সে অত কথা আপনাকে বললে কেন?
তার উপর থেকে সন্দেহটা দূর করবার জন্য। কারণ সে আমাকে দেখে আমার কথাবার্তা শুনে বুঝতে পেরেছিল, আদালতে যে মামলা শেষ হয়ে গিয়েছে সেটা আমার বিচারে শেষ নিষ্পত্তি নয়। এবারে হয়ত কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ বেরুবে। তাই অত কথা সে বলে আমাদের। কিন্তু সে বুঝতে পারেনি তখন তার ওই সব কথা তার বিরুদ্ধে আমার মনে সন্দেহ জাগাবে।
বিজিত মিত্রর কি হলো?
সম্ভবত মৃত্যুভয়ে সে আত্মগোপন করে আছে।
আর মৃণাল?
মনে হয় মৃণালকে আর কখনো খুঁজে পাওয়া যাবে না।
কিন্তু এরপর আমি–
নিরস্ত হবেন না, এই তো, তা খুঁজুন–যদি কখনো খুঁজে পান তাকে। কথাটা বলে কিরীটী মৃদু হাসলো।