কিরীটী উপবেশন করবার পর সোমনাথ ভাদুড়ী তাড়াতাড়ি শেষ মক্কেলটিকে বিদায় করলেন।
আপনাকে ফোন করেছিলাম বাড়িতে—আপনার স্ত্রী বললেন আপনি সকালেই বের হয়েছেন। ভাদুড়ী বললেন।
হ্যাঁ, লালবাজারে গিয়েছিলাম।
আজকের সকালবেলার কাগজ পড়েছেন রায় মশাই?
না, সময় পাইনি। তাছাড়া আমি সাধারণত কাগজ দুপুরে বিশ্রামের সময় পড়ি।
সুদীপ রায়—
কি হয়েছে সুদীপের?
সে খুন হয়েছে—
খুন! কে বললে?
সংবাদপত্রে বের হয়েছে। তার গুলিবিদ্ধ রক্তাক্ত মৃতদেহটা রেল লাইনের ধারে গতকাল সকালে পাওয়া গিয়েছে।
তার মানে যেদিন সন্ধ্যায় সে আপনার এখানে এসেছিল, সেইদিনই রাত্রে সে খুন হয়েছে!
হিসাবমত তাই দাঁড়াচ্ছে। সোমনাথ ভাদুড়ী বললেন।
কিন্তু প্রতুলবাবু তো কিছু বললেন না!
বোধ হয় ব্যাপারটা এখনো তিনি শোনেননি।
হয়ত তাই, কিন্তু লোকটা যে ওই সুদীপ রায়ই–সেটা জানলেন কি করে?
কাগজে অবিশ্যি বের হয়েছে এক ব্যক্তির মৃতদেহ আবিষ্কৃত হয়েছে এবং মৃতের মুখটা কোন ধারানো অস্ত্রের সাহায্যে ক্ষত-বিক্ষত করা হয়েছে। আইডেনটিফাই নাকি করেছে আজই তার স্ত্রী রমা।
খবরের কাগজে কি সংবাদ বের হয়েছে?
না। আসলে আমিও সংবাদপত্রে নিউজটা পড়িনি রায়মশাই-আজ সকালে একটা ফোন পাই–
ফোন!
হ্যাঁ, অজ্ঞাতনামা এক নারীর কাছ থেকে। সে-ই সংবাদটা দেয়। সংবাদটা দিয়েই সে ফোনের কানেকশন কেটে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে আপনাকে ফোন করি সংবাদটা দেবার জন্য।
ফোনে ঠিক কি বলেছিল আপনাকে সেই মহিলা?
বলেছিল রেল লাইনের ধারে যে মৃতদেহটা পাওয়া গিয়েছে সেটা সুদীপ রায়ের।
যিনি ফোন করেছিলেন তাঁর কণ্ঠস্বর আপনি চিনতে পারেননি।
না।
ঠিক আছে—বলতে বলতে সামনেই টেবিলের উপর রক্ষিত ফোনের রিসিভারটা তুলে নিয়ে কিরীটী ডায়েল করল লালবাজারে।
কিন্তু প্রতুল সেনকে তার অফিসে পেল না।
কাকে ফোন করছিলেন? সোমনাথ ভাদুড়ী জিজ্ঞাসা করলেন।
প্রতুল সেনকে, পাওয়া গেল না—অফিসে নেই।
আচ্ছা রায়মশাই, কে আপনাকে ফোন করেছিল বলুন তো?
মনে হয় হত্যাকারীর সহকারিণী এবং হত্যাকারীরই নির্দেশে?
কিন্তু আমাকে সংবাদটা দেবার কি প্রয়োজন ছিল?
ভাদুড়ী মশাই, হত্যাকারী বরাবরই সজাগ ছিল। সুদীপবাবু যে আপনার কাছে। এসেছিলেন তাও সে জানত। তাই সে আপনাকে জানিয়ে দিল—ভবিষ্যতের কথা ভেবেই সুদীপবাবুকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়া হলো।
তার মানে–যাতে সে ভবিষ্যতে আরো কিছু প্রকাশ করতে না পারে!
হ্যাঁ—সেই সন্দেহেই তাকে এ পৃথিবী থেকে সরানো হয়েছে। তবে একটা ব্যাপার সুদীপবাবুর মৃত্যুতে পরিষ্কার হয়ে গেল
কোন্ ব্যাপারের কথা বলছেন?
তপন ঘোষের হত্যার ষড়যন্ত্রের মধ্যে সুদীপবাবু না থাকলেও তিনি ব্যাপারটা অনুমান করতে পেরেছিলেন।
আমি কিন্তু একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি না রায়মশাই।
সুদীপবাবু এগিয়ে এসে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে কেন সাক্ষী দিলেন তাই বোধ হয়।
হ্যাঁ। সে যদি ষড়যন্ত্রের মধ্যে ছিলই—
সুদীপবাবুর মনের মধ্যে একটা ভয় ঢুকেছিল।
ভয়! কিসের ভয়?
তার নিজের প্রাণের ভয়।
প্রাণের ভয়!
হ্যাঁ। তার মনে ভয় ঢুকেছিল, বিজিত মিত্র যদি প্রাণের ভয়ে শেষ পর্যন্ত অ্যাপ্রুভার হয়ে সব কিছু প্রকাশ করে দেয়–
তাই সে সাক্ষী দিয়ে বিজিত মিত্রকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল বলতে চান?
হ্যাঁ-বিজিত মিত্রকে আইন-আদালতের এক্তিয়ারের বাইরে নিয়ে যেতে চেয়েছিল।
কেমন যেন সব কিছু গোলমাল হয়ে যাচ্ছে আমার রায়মশাই। সোমনাথ ভাদুড়ী বললেন দু আঙুলের মাঝখানে মোটা পেনসিলটা নাচাতে নাচাতে।
একটা ব্যাপার কিন্তু পরিষ্কার হয়ে গেল ভাদুড়ী মশাই। কিরীটী বললে।
কি বলুন তো? সোমনাথ ভাদুড়ী তাকালেন কিরীটীর মুখের দিকে।
তপন ঘোষ, বিজিত মিত্র ও সুদীপ রায় সব একদলের এবং সত্যিই ওরা পরস্পর কোন দুষ্কর্মের সঙ্গী ছিল পরস্পরের।
চোরাকারবার!
হতে পারে। আমি কিন্তু ব্যাপারটা পূর্বাহ্রেই অনুমান করেছিলাম—তাই আজ ফাঁদ পাতার ব্যবস্থা করে এসেছি।
ফাঁদ।
হ্যাঁ–আর আমার অনুমান যদি মিথ্যা না হয় তো আজই রাত্রে ফাঁদে নাটের গুরুকে আটকা পড়তে হবে।
কার কথা বলছেন?
রহস্যের মেঘনাদ যিনি—তারই কথা বলছি। ব্যাপারটা সত্যি কথা বলতে কি, আমি কিন্তু এত সহজে নিষ্পত্তি হয়ে যাবে ভাবতে পারিনি। ভাবতে পারিনি হত্যাকারী এত বড়।
একটা ভুল তড়িঘড়ির মাথায় করে বসবে বা করে বসতে পারে।
তাহলে সুদীপবাবুর নিহত হওয়াটা এ ব্লেসিং ইন ডিসগাইজ বলুন রায়মশাই, সোমনাথ বললেন।
তাই।
কিরীটীর অনুমান যে মিথ্যা নয় সেটা ওই রাত্রেই প্রমাণিত হয়ে গেল।
ব্যবস্থামত রাত্রি এগারোটা নাগাদ কিরীটী ও প্রতুল সেন এসে খিড়কির দরজাপথে বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করে খোলা বাথরুমের দরজা দিয়ে মৃণালের ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল।
ঘরের মধ্যে পূর্ব হতেই অন্ধকারে ঘাপটি মেরে ছিল প্রতুল সেনের এক বিশ্বস্ত অনুচর।
ফিসফিস করে প্রতুল সেন শুধালেন, কেউ এসেছে মৃণালের পাশের ঘরে?
না, স্যার।
মিনতি আছে তো ঘরে?
আছে।
প্রার্থিত আগন্তুক ঠিক এল রাত বারোটায়।
টুক টুক করে পাশের ঘরের দরজায় নক করলো।
দরজা খোলার শব্দ শোনা গেল।
তাদের মধ্যে সেরাত্রে যে সব কথাবার্তা হয়েছিল, পরে টেপ থেকেই তা শোনা যায়।
কে? মিনতির প্রশ্ন।
আমি।
তুমি? আবার কেন তুমি এসেছো?
তোমাকে আমার সঙ্গে নিয়ে যেতে, চল আমার সঙ্গে–
না।
চুল।
না, কিন্তু এখানে আর তুমি থেকো না—চলে যাও, আমি টের পেয়েছি পুলিস ছদ্মবেশে এ বাড়ির আশেপাশে ওৎ পেতে রয়েছে।