কি ব্যাপার স্যার—এত জরুরী তলব দিয়ে আমাকে এখানে ডেকে আনলেন কেন? অবিনাশ বললেন।
কোন রকমের ভনিতা না করেই প্রতুল সেন বললেন, আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে। তপন ঘোষ হত্যা-মামলার ব্যাপারটা!
সঙ্গে সঙ্গে অবিনাশ সেনের চোখের দৃষ্টি যেন সজাগ, তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে।
মামলায় আপনি তো সাক্ষীও দিয়েছিলেন—
আজ্ঞে।
আপনি ওই বাড়িতে মিনতির ঘরে যেতেন? প্রশ্ন করল এবার কিরীটী।
অবিনাশ সেন চকিতে তাকালেন কিরীটীর মুখের দিকে।
প্রতুল সেন বললেন, উনি যা জিজ্ঞাসা করছেন তার জবাব দিন।
কিন্তু স্যার—সে মামলা তো চুকেবুকে গিয়েছে।
না, যায়নি।
যায়নি! অবিনাশ সেনের কষ্ঠে বিস্ময়।
না, তপন ঘোষের হত্যাকারী এখনো সনাক্ত হয়নি। কিরীটী আবার বললে, কিন্তু আপনি আমার প্রশ্নের এখনো জবাব দেননি।
হ্যাঁ, তা মধ্যে মধ্যে যেতাম।
আপনার সঙ্গে তার পূর্ব-পরিচয় ছিল, তাই না?
পূর্ব-পরিচয় আর কি স্যার—একজন বারবনিতা—
কিন্তু তা তো নয়—
কি বলতে চান স্যার?
মিনতির সঙ্গে আপনার সত্যিকারের কি সম্পর্ক ছিল?
সম্পর্ক আবার কি থাকবে?
আপনি সত্য গোপন করছেন অবিনাশবাবু—
সত্য!
হ্যাঁ, তিনি ঐ লাইনে আসার আগে আপনার স্ত্রী বিবাহিতা স্ত্রী ছিলেন, দ্বিতীয় পক্ষের–
অবিনাশ সেনের চোয়ালটা ঝুলে পড়লো সহসা। দুচোখে বোবা দৃষ্টি।
কি, তাই না?
বাড়ি থেকে বের হয়ে এসেছিল কুলত্যাগিনী—
কথাটা আপনি আদালতে চেপে গেলেন কেন?
প্রয়োজন হয়নি-অবান্তর–
না, অনেক সত্য কথা বের হয়ে পড়ার ভয়ে কথাটা চেপে গিয়েছিলেন।
না, না—
তা সেই কুলত্যাগিনী স্ত্রীর কাছে আবার কেন আসতেন মধ্যে মধ্যে? নিশ্চয়ই ভালবাসার টানে নয়!
সত্যিই তাই স্যার। বিশ্বাস করুন ওকে আমি ভুলতে পারিনি।
তা মিনতি যে ওইখানে আছে খবর পেলেন কি করে?
হঠাৎ-ই—মানে অ্যাকসিডেন্টালি!
মানে ওই সব পাড়ায়—ওই ধরনের মেয়েদের কাছে যেতে যেতে!
অবিনাশ সেন চুপ করে থাকেন।
অবিনাশবাবু!
আজ্ঞে—
আমরা কিন্তু খবর পেয়েছি—
কি–কি খবর পেয়েছেন?
ওই বাড়িতে একটা চোরাই কারবারের আড্ডা ছিল।
চোরাই কারবার!
সেই কারবারের সঙ্গে আপনি ও মিনতি যুক্ত ছিলেন।
না, না–বিশ্বাস করুন, ওসব ব্যাপারের মধ্যে আমি নেই।
কিরীটী মৃদু হাসলো।
অবিনাশবাবু, আপনি জানেন মৃণাল কোথায়?
না, কেমন করে জানবো!
জানেন না?
না।
কিন্তু আমি যদি বলি আপনি জানেন!
মৃণাল পাশের ঘরে থাকত। মিনতির মুখেই আমি শুনেছিলাম, কিন্তু তার সঙ্গে কোন আলাপ-পরিচয় ছিল না, এমন কি আগে তার নামও জানতাম না।
তপন ঘোষের সঙ্গে আপনার পরিচয় ছিল না?
না।
বিজিতবাবুর সঙ্গে?
না।
সুদীপবাবুর সঙ্গে?
না।
তাহলে ওদের কাউকেই আপনি চিনতেন না বলতে চান অবিনাশবাবু? কথাটা বলে কিরীটী অবিনাশ সেনের মুখের দিকে তাকাল।
না। বিশ্বাস করুন, ওদের কাউকেই আমি চিনতাম না।
পন্টুকে আপনি চিনতেন?
পন্টু।
হ্যাঁ, সে তো মধ্যে মধ্যে আপনার দোকানে গিয়ে আপনার সঙ্গে দেখা করত। কথাটা কি অস্বীকার করতে পারেন?
ওই নামই জীবনে কখনো শুনিনি।
কিন্তু মিনতি বলেছে—
কি বলেছে মিনতি?
মধ্যে মধ্যে আপনি ঐ তপনবাবুর সঙ্গে বিশেষ করে দেখা করবার জন্য তার ঘরে রাত্রের দিকে যেতেন।
মিনতি বলেছে?
হ্যাঁ, আরো বলেছে তপন পাশের ঘর থেকে মিনতির ঘরে আসতো মাঝখানের দরজা-পথে—আবার কথাবার্তা হয়ে চলে যেতো ওই দরজা দিয়েই পাশের ঘরে।
মিনতি বলেছে ওই কথা আপনাকে! হারামজাদী! শেষেব শব্দটা কাপা আক্রোশভরা গলায় অবিনাশ সেন যেন অস্পষ্টভাবে উচ্চারণ করলেন।
ঠিক আছে অবিনাশবাবু—আপনি যেতে পারেন।
ধন্যবাদ। অস্ফুট কণ্ঠে কথাটা বলে অবিনাশ সেন বের হয়ে গেলেন ঘর থেকে।
অবিনাশ ঘর ছেড়ে চলে যাবার পর প্রতুল সেন কিরীটীর মুখের দিকে তাকালেন।
কিরীটী অন্যমনস্ক ভাবে পাইপটায় নতুন তামাক ভরছে তখন।
কি বুঝলেন মিঃ রায়। প্রতুল সেন প্রশ্ন করলেন।
গভীর জলের কাতলা। কিরীটী বললে।
সে তো বোঝাই গেল। নচেৎ সব স্রেফ অস্বীকার করে যেতে পারে!
তবে কাতলা টোপ গিলেছে।
টোপ!
হ্যাঁ, দেখলেন না—বঁড়শী টাকরায় গিয়ে বিঁধেছে।
মিনতি কি সত্যিই ওইসব কথা বলেছে মিঃ রায়?
না।
তবে যে বললেন—
টোপ ফেলেছিলাম একটা স্রেফ অনুমানের ওপরে নির্ভর করে দেখলেন তো, অনুমানটা মিথ্যে হয়নি। এবারে আপনাকে একটা কাজ করতে হবে মিঃ সেন।
কি বলুন?
মৃণালের ঘরটা এখনো খালি পড়ে আছে—সেই ঘরটার আমাদের প্রয়োজন।
সে আর এমন কঠিন কি!
এখুনি লোক পাঠান—আর একটা টেপ-রেকর্ডার।
পাবেন।
ওই বাড়ির খিড়কির দরজাটা
তাও খোলা থাকবে। তার আশেপাশে আমাদের একজন প্লেন ড্রেসে ওয়াচারও থাকবে। কিন্তু এত আয়োজন কিসের?
কিরীটী তখন তার প্ল্যানটা বুঝিয়ে দিল প্রতুল সেনকে। তারপর বললে, সন্ধ্যার পরই যেন সব প্রস্তুত থাকে।
কিন্তু আপনি কি মনে করেন মিঃ রায়–
কি?
টোপ গিলবে লোকটা!
গিলবে বলেই আমার ধারণা।
আজ না হয় কাল।
বেশ।
এবার আমি উঠবো।
তা কখন দেখা হচ্ছে?
ঠিক রাত সোয়া আটটায়।
অতঃপর কিরীটী বিদায় নিল।
০৬. সেদিনটা ছিল রবিবার
সেদিনটা ছিল রবিবার। অফিস আদালত সব বন্ধ।
লালবাজার থেকে বের হয়ে সোজা কিরীটী সোমনাথ ভাদুড়ীর গৃহের দিকে গাড়ি চালাতে বলল সর্দারজীকে!
বেলা তখন প্রায় সাড়ে বারোটা। সোমনাথ ভাদুড়ীর ঘর প্রায় খালিই ছিল। একজন মাত্র মক্কেল ছিল ঘরে। সোমনাথ ভাদুড়ী তার সঙ্গেই কথা বলছিলেন।
কিরীটীকে ঘরে প্রবেশ করতে দেখে সাদর আহ্বান জানালেন সোমনাথ ভাদুড়ী, আসুন রায়মশাই, বসুন–