কি রকম?
গোলাগুলির আগে হয়ত একটা গোলমাল হয়েছিল। আর সে তখন ওই ঘরের। মধ্যবর্তী দরজা খুলে ব্যাপারটা সবার অলক্ষ্যে দেখেছিল। সে যে পিস্তলের গুলির শব্দেই প্রথমে আকৃষ্ট হয়েছিল কথাটা হয়ত সত্য নয় কিন্তু সে কথাটা প্রকাশ করেনি ওই একই কারণে—পুলিস তার পেটের গোপন কথা হয়ত টেনে বের করত জেরা করে। একটা কথা ভুলে যাবেন না ভাদুড়ী মশাই, ঘটনার সময় মিনতি আর তার স্বামী অবিনাশ ঠিক। পাশের ঘরেই ছিল। অকুস্থানের এক কথায় যাকে বলে সন্নিকটে।
তাহলে–
মিনতির উপর কড়া নজর রাখতে হবে। আপনি ভাববেন না, বাড়ি ফেরার পথেই লালবাজারের সি. আই. ডি. অফিসার প্রতুল সেনকে আমি মিনতির উপর কনস্ট্যান্ট একটা ওয়াচ রাখবার জন্য আজ থেকেই নির্দেশ দিয়ে যাবো।
সোমনাথ ভাদুড়ীকে তার গৃহে নামিয়ে দিয়ে কিরীটী সোজা সার্কাস এভিন্যুতে প্রতুল সেনের গৃহে গিয়ে উপস্থিত হলো।
প্রতুল সেন তখন ডিনারে বসেছিলেন।
সংবাদ পেয়ে তাড়াতাড়ি বের হয়ে এলেন।
কি ব্যাপার মিঃ রায়! এত রাত্রে?
কিরীটী মৃদু হেসে বললে, এত রাত কোথায়, মাত্র তো সোয়া দশটা।
আমি খেতে বসেছিলাম, আপনার নাম শুনে—
ছিঃ ছিঃ, যান আহার শেষ করে আসুন। আমি বসছি।
না না, আপনি বলুন কি দরকার?
বলবো বলেই তো এসেছি। আগে যান ডিনার শেষ করে আসুন, আমি বসছি।
সে হবেখন–আপনি বলুন।
না, এমন কিছু একটা জরুরী ব্যাপার নয়, আপনি যানফিনিশ ইওর ডিনার ফার্স্ট।
প্রতুল সেন চলে গেলেন এবং মিনিট কুড়ি বাদেই ফিরে এলেন একটা সিগারেট ধরিয়ে। একটা সোফায় বসতে বসতে বললেন, বলুন।
কিরীটী সংক্ষেপে ব্যাপারটা খুলে বলল। তারপর বললে, আমি যে জন্য এসেছি সেটা হচ্ছে ঐ মিনতির সবরকম গতিবিধির উপর আপনাকে নজর রাখার একটা ব্যবস্থা করতে হবে। এখুনি।
বেশ, করছি। প্রতুল সেন উঠে গিয়েই ফোনে যেন কাকে নির্দেশ দিয়ে এলেন।
মিঃ রায়, আপনার ধারণা তাহলে মিনতি জানে মৃণালের হোয়ার অ্যাবাউটস!
হ্যাঁ।
মিনতিকে তাহলে অ্যারেস্ট করলেই তো হয়?
না, এখন নয়।
কিন্তু তার স্বার্থ কি?
স্বার্থ একটা আছে বৈকি কিছু—
কি স্বার্থ থাকতে পারে?
ইফ আই অ্যাম নট রং—আমার অনুমান যদি মিথ্যা না হয়ে থাকে তো, কিরীটী বললে, ঐ বাড়িতে একটা চোরাকারবারের ঘাঁটি ছিল।
চোরাকারবারের ঘাঁটি!
হ্যাঁ। যার মধ্যে জড়িত ছিল তপন ঘোষ, বিজিত মিত্র ও সুদীপ রায় তো বটেই— ঐ মিনতি ও মৃণাল সম্ভবত ছিল।
সত্যি বলছেন?
বললাম তো আমার অনুমান। এবং তপন ঘোষের মৃত্যুর পশ্চাতেও ওই চোরাকারবার।
আর মিনতির স্বামী অবিনাশ সেন?
সেও থাকাটাই সম্ভব। আপনাকে আরো একটা কাজ করতে হবে মিঃ সেন।
কি?
ওই অবিনাশ সেনকে একবার লালবাজারে ডাকিয়ে আনাতে হবে কালই।
বেশ। কখন?
বেলা দশটা বা এগারোটা নাগাদ আমরা আপনার অফিসে তাকে জেরা করলে হয়ত কোন সূত্রের সন্ধান পেতে পারি।
আমার তো মনে হচ্ছে ওই মিনতি মেয়েটি—
তাকে তত জেরা করবোই—তার আগে তার জানা দরকার, তাকে ও তার স্বামীকে আমরা সন্দেহ করছি। আচ্ছা এখন তাহলে উঠি। কাল দশটা-এগারোটার মধ্যে আপনার অফিসে যাবো।
গৃহে ফিরে এলে কৃষ্ণা বললে, টিকিট পাওয়া গিয়েছে সামনের সোমবারে ড়ুন এক্সপ্রেসে।
আজ বৃহস্পতিবার হাতে তাহলে এখনো তিনটে দিন-রাত ও একটা বেলা আছে। ঠিক আছে, তার মধ্যে আশা করছি তপন ঘোষের হত্যার ব্যাপারে একটি হদিস হয়ত পেয়েও যেতে পারি।
তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে, তুমি কোন একটা নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তের কাছাকাছি এসে গিয়েছে।
তোমাকে সেদিন বলছিলাম না কৃষ্ণা, কিরীটী একটা আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে বললে, রক্তের দাগ একেবারে নিশ্চিহ্নভাবে মুছে ফেলা যায় না। যতই চেষ্টা করো মুছে। ফেলতে, একটা আবছা দাগ কোথায়ও-না-কোথায়ও থেকে যায়ই। আর সে-রক্তের দাগ যদি হত্যার হয় তো–
হত্যাকারী সনাক্ত হয়ে যায়! কৃষ্ণা মৃদু হেসে বললে।
তাই। কারণ কোন ক্রাইমই আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে একেবারে পারফেক্ট হয় না। হতে পারে না। ছোট একটা কিন্তু কোথাও-না-কোথাও থেকে যাবেই—সেই কিন্তু ধরে যদি এগুতে পারো—ঠিক সত্যে তুমি পৌঁছে যাবেই।
চল, রাত অনেক হয়েছে, এবারে খাবে চল।
হ্যাঁ, চল।
পরের দিন সকাল দশটা নাগাদ কিরীটী বেরুল।
লালবাজারে প্রতুল সেনের অফিস কামরায় প্রবেশ করে দেখলো প্রতুল সেন তারই অপেক্ষায় বসে আছে।
আসুন আসুন সত্যসন্ধানী।
কোন খবর আছে?
প্রতুল সেন বললেন, অবিনাশ সেনকে এখুনি আমার লোক নিয়ে আসবে।
প্রতুল সেনের কথা শেষ হলো না, সাব-ইন্সপেক্টার রঞ্জিত মল্লিক অবিনাশ সেনকে নিয়ে ঘরে প্রবেশ করল।
অবিনাশবাবু এসেছেন, স্যার।
বসুন অবিনাশবাবু। প্রতুল সেন বললেন।
অবিনাশ সেন বসলেন।
কিরীটী চেয়ে দেখে আগন্তুকের দিকে।
বয়স প্রায় পঞ্চাশের কাছাকাছি হবে বলেই মনে হয় ভদ্রলোকের। রোগা লম্বা চেহারা। গাল দুটো ভাঙা। মাথার চুলে কলপ দেওয়া! সযত্ন টেড়ি, মাঝখানে সিঁথি। চোখে সোনার চশমা। নিখুঁতভাবে দাড়ি কামানো। সরু গোঁফ ঠোটের উপর। পরনে দামী শান্তিপুরী ধুতি ও সাদা সিল্কের পাঞ্জাবি। সোনার বোতাম। দুহাতের আঙুলে গোটা দুই সোনার আংটি, তার মধ্যে একটা হীরা। হীরাটি বেশ বড় একটা বাদামের সাইজের, অনেক দাম যে হীরাটার বোঝা যায়।
লোকটি কেবল ধনীই নয়—বনেদী ধনী। শৌখিন প্রকৃতির।
কিন্তু সারা মুখে যেন একটা দীর্ঘ অত্যাচার ও অসংযমের ছাপ।