তোমার কোন সন্তানাদি
না, হয়নি। তবে তার প্রথম পক্ষের দুটি সন্তান ছিল–আমি তার দ্বিতীয় পক্ষ। আরো অনেক কথা আছে, যা বলতে পারবো না।
থাক, বলতে হবে না। কিন্তু তুমি আদালতে সে সব কথা তো প্রকাশ করনি?
না, করিনি।
কেন? ওই সব কি প্রকাশ করবার মত কথা দশজনের সামনে আদালতে দাঁড়িয়ে?
এবার বল, সে রাত্রে ঠিক কি ঘটেছিল।
রাত সাড়ে দশটার পর, বোধ হয় এগারোটা হবে তখন আমার স্বামী এলো।
বললে, সে আমাকে না নিয়ে ফিরবে না। আমিও যাবো না। সেও নাছোড়বান্দা। আমি বললাম আর আমি জীবনে কোনদিন তার ঘরে ফিরে যাবো না, সেও যেন আর না আসে।
০৫. মিনতি বলতে লাগল
মিনতি বলতে লাগল, রাত বোধ হয় বারোটা। হঠাৎ পর পর দুটো গুলির আওয়াজ–আর একটা আর্ত চিৎকার–
দুটো গুলির আওয়াজ শুনেছিলে? প্রশ্ন করলেন সোমনাথ ভাদুড়ী।
হ্যাঁ।
কিন্তু আদালতে বলেছ একটা গুলির আওয়াজই তুমি সে রাত্রে শুনেছিলে। আবার প্রশ্ন করলেন সোমনাথ ভাদুড়ী।
হ্যাঁ, তাই বলেছিলাম বটে।
কিরীটী এবার বললে, দুটো গুলির আওয়াজ শুনেছিলে তবে বলেছিলে কেন একটা গুলির আওয়াজ শুনেছো?
মনে ছিল না।
কিরীটী বললে, হুঁ। ঠিক আছে গুলির আওয়াজ শুনে তুমি কি করলে?
ভয়ে প্রথমে আমরা ঘর থেকে বের হইনি। এদিকে বাড়ির অনেকেই সে আওয়াজ শুনেছে তখন, কিন্তু তারাও কেউ ভয়ে ঘর থেকে বের হয়নি। মিনিট পাঁচেক পরে আমি আর আমার স্বামী দরজা খুলে বের হই। মৃণালের ঘরের দরজা বন্ধ। কোন সাড়া-শব্দ নেই। দরজায় ধাক্কা দিয়ে মৃণালকে ডাকি। কিন্তু মৃণালের কোন সাড়া-শব্দ পেলাম না। বাড়ির অনেকেই তখন এসে ঐ ঘরের দরজার সামনে ভিড় করেছে। হঠাৎ এই সময় আমার মনে পড়ল—আমার আর মৃণালের ঘরের মাঝখানে একটা দরজা আছে। আমার ঘরের ভিতর থেকেই আমি বন্ধ করে রাখতাম বরাবর। তাড়াতাড়ি ছুটে গিয়ে সেই মধ্যবর্তী দরজাটা খুলে মৃণালের ঘরে গিয়ে ঢুকলাম। ঢুকে দেখি তপন ঘোষ রক্তাক্ত অবস্থায় মেঝেতে পড়ে। তার পাশে পড়ে বিজিতবাবু। তার হাতে ধরা একটা পিস্তল। আর—মৃণাল ঘরে নেই?
মৃণাল নেই?
না। বাথরুমের দরজাটা খোলা হাঁ হাঁ করছে। আমি তখন প্রথমে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে বাথরুমের আমার ঘরের দরজা বন্ধ করে বাইরে এলাম। আমার স্বামী দেখি দরজার গায়ে লাথি মারছে-বাড়িউলী মাসীর হুকুমে। দরজা ভেঙে আমি আর আমার স্বামীই প্রথমে ভিতরে ঢুকি—পর পর অন্য সকলে। পরে থানায় খবর দেওয়া হয়। পুলিস আসে।
বাথরুমের ওই দরজা দিয়ে এ বাড়ির বাইরে যাওয়া যায়? কিরীটীর প্রশ্ন।
হ্যাঁ, বাইরে একটা ঘোরানো লোহার সিঁড়ি আছে। সিঁড়িটা বরাবর একতলা থেকে দোতলা পর্যন্ত গিয়েছে।
বলতে চাও তাহলে ওই সিঁড়িপথেই মৃণাল পালিয়েছে?
হ্যাঁ, তাছাড়া আর কি হবে। তবে পুলিসের খটকা থেকে গিয়েছে—মৃণাল কোন্ পথে পালাল-বাথরুমের দরজা যখন বন্ধ ছিল। আমিও পুলিসকে কথাটা বলিনি, আদালতেও প্রকাশ করিনি।
কেন করনি?
পুলিস হয়ত আমাকে সন্দেহ করত যে, আমিই তাকে সে-রাত্রে পালানোর সুযোেগ দিয়েছি।
এ কথাটা তোমার মনে হলো কেন মিনতি? কিরীটী প্রশ্ন করল।
তারা যে অনুসন্ধানের সময় আমার ও মৃণালের ঘরের মধ্যবর্তী দরজাটা আবিষ্কার করেছিল এবং আমাকে নানাভাবে জেরা করেছি।
তা তোমাকে যে তারা শেষ পর্যন্ত সন্দেহ করেনি, তুমি বুঝলে কি করে?
আমি যে একসময় সে-রাত্রে গোলমাল শুনে এক ফাঁকে মৃণালের ঘরের মধ্যে গিয়ে ঢুকেছিলাম, সে কথাটাও কাউকে আমি বলিনি। তারাও সেটা অনুমান করতে পারেনি। তাই আমার মনে হয়, আমাকে তারা মৃণালের সে-রাত্রে পালানোর ব্যাপারে কোনভাবে সন্দেহ করতে পারেনি।
কিরীটী মুখে কিছু না বললেও বুঝতে পারে মেয়েটি রীতিমত বুদ্ধিমতী।
মিনতি।
বলুন।
আমার কিন্তু মনে হয়, মৃণাল কোথায় আছে, অন্তত আর কেউ না জানলেও তুমি জানো।
কি বলছেন আপনি!
যা আমার মনে হচ্ছে তাই বললাম।
আপনি বিশ্বাস করুন, সত্যিই আমি জানি না।
দেখ মৃণালকে আমি খুঁজে বের করবই। সে অন্তত আমার চোখে ধুলো দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকতে পারবে না। আচ্ছা আজ আমরা উঠছি আবার কিন্তু আসবো।
নিশ্চয়ই আসবেন। মিনতি বললে, কিন্তু বিশ্বাস করুন বাবু, মৃণালের সন্ধান জানলে নিশ্চয়ই সে-কথা আমি আপনাদের জানাতাম।
কিরীটী মিনতিকে আর কিছু বললে না। উঠে দাঁড়াল এবং সোমনাথ ভাদুড়ীকে বললে, চলুন ভাদুড়ী মশাই, এবার যাওয়া যাক। ভাল কথা, একবার মৃণালের ঘরটা দেখে গেলে হতো।
সোমনাথ ভাদুড়ী উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, বেশ তো চলুন।
মিনতি বাড়িউলী মাসীর কাছ থেকে ঘরের চাবিটা নিয়ে এলো। দরজা খুলে ওরা দুজনে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল।
রাত তখন প্রায় সোয়া নটা হয়ে গিয়েছে।
দুজনে ওই বাড়ি থেকে বের হয়ে বড় রাস্তায় এসে কিরীটীর অপেক্ষমাণ গাড়িতে উঠে বসলো।
সর্দারজী, বাবুকে তার কোঠিতে নামিয়ে দাও আগে–কিরীটী বললে।
কিছুক্ষণ গাড়ি চলার পর সোমনাথ ভাদুড়ীই স্তব্ধতা ভঙ্গ করলেন, কি ভাবছেন রায় মশাই?
ভাবছি ওই মিনতি মেয়েটির কথা।
সত্যিই কি আপনার মনে হয়, মেয়েটি জানে মৃণাল কোথায়?
আমার অনুমান যদি মিথ্যা না হয় তো জানে।
তবে সে কথা মিনতি প্রকাশ করল না কেন? এত কথা বললে, অথচ ওই কথাটা চেপে গেল কেন?
তার দুটি কারণ হতে পারে ভাদুড়ী মশাই।
কি কারণ?
প্রথমত, কথাটা প্রকাশ করলে সে মামলার মধ্যে জড়িয়ে পড়তো, যেটা হয়ত সে কোনক্রমেই চায়নি। দ্বিতীয়ত, হয়ত সে ব্যাপারটা স্বচক্ষে দেখেছিল সেই রাত্রে।