বড় চাপা মেয়ে ছিল মৃণাল। তাছাড়া নিজের কথা বড় একটা বলতো না কখনও। বিশেষ করে এখানে আসার আগে তার সব কথা জানায়নি।
তুমি জিজ্ঞাসা করোনি কখনো সে-সব কথা তাকে? কিরীটীর প্রশ্ন।
না। আর জিজ্ঞাসা করেই বা কি করবো বলুন।
কেন?
এ লাইনে যারা আসে তাদের ইতিহাস তো প্রায় সকলেরই এক অন্যরকম আর কি হবে।
আচ্ছা তোমার কি মনে হয়? হঠাৎ সে পালাল কেন?
আমার মনে হয় বাবু, খুনখারাপি দেখে হঠাৎ ভয় পেয়ে হয়ত সে ঘর ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছে।
আচ্ছা মিনতি, কিরীটী বলল, এমন তো হতে পারে তপন ঘোষের খুনের ব্যাপারে সে-রাত্রে ওই মৃণালও জড়িত ছিল বা তার পরোক্ষ হাত ছিল?
না, না বাবু, না। কখনো তা হতে পারে না। মৃণালকে তো আমি জানি।
সে-রাত্রে কি ঘটেছিল বা না ঘটেছিল তুমি তো আর কিছু দেখনি!
তা হলেও আমি জোর গলায় বলতে পারি—মৃণাল সম্পূর্ণ নির্দোষ, সে ওই ধরনের মেয়েই নয়, অমন শান্ত স্বভাবের মেয়েকে–না বাবু, না।
তুমি তো একটু আগে বললে, তোমাদের মধ্যে খুব ভাব ছিল!
হ্যাঁ। পাশাপাশি ঘরে থাকতাম। দিনের বেলা বেশীর ভাগ সময় তো সে আমার ঘরেই থাকত, আমার সঙ্গে খেতো—এক বিছানায় দুজনে শুয়ে থাকতাম।
মৃণালের ঘরে কে আসতো নিশ্চয় তুমি জানতে?
জানতাম বৈকি, তপনবাবুরই যাতায়াত ছিল তার ঘরে।
আর কেউ আসতো না? বিজিতবাবু?
আসতো। তবে মধ্যে মধ্যে।
তপন ঘোষ তখন থাকত?
না। তপন ঘোষ থাকলে বিজিতবাবু আসতো না। তবে একটা কথা। আমার মনে হয় বিজিতবাবুর উপরে মৃণালের বোধ হয় একটা দুর্বলতা ছিল।
হুঁ। আচ্ছা মিনতি—সুদীপবাবুকে কখনো মৃণালের ঘরে আসতে দেখেছো?
দেখেছি।
একা একা?
না–তপন ঘোষের সঙ্গেই বারকয়েক আসতে দেখেছি।
আদালতে সাক্ষী দেবার সময় তো কথাটা তুমি বলোনি!
না, বলিনি।
কেন, কেবল বিজিতবাবুর কথাই বা বলেছিলে কেন?
মিনতি চুপ করে থাকে।
অবিশ্যি তোমার আপত্তি থাকলে আমি শুনতে চাই না।
না, তা নয়—
তবে?
আমার মনে হয় বাবু–বিজিতবাবু কোন চোরাকারবারে লিপ্ত ছিল—তপনবাবুর সঙ্গে তার হয়ত সেই নিয়েই শেষ পর্যন্ত খুনোখুনি হয়েছে। আদালতে সে-কথাটা আমি বলেছিলামও।
আর কেউ কখনো মৃণালের ঘরে আসেনি? আসতে দেখনি?
না।
মৃণালের আত্মীয়-স্বজন কেউ ছিল না?
জানি না? বলতে পারব না।
তার দেশ বা বাড়ি কোথায় ছিল জানো?
না, সেও কোনদিন তার বাড়িঘরের কথা বলেনি, আমিও সে-সব কথা কখনো তাকে শুধাইনি।
কতদিন এখানে মৃণাল ছিল?
তা প্রায় আড়াই বছর তো হবেই।
তার আগে কোথায় ছিল সে?
জানি না।
কথাটা তুমি তাকে কখনো জিজ্ঞাসা করনি?
না।
জানবার কখনো ইচ্ছা করেনি তোমার?
না।
তার অতীত জীবনের কথা তাহলে তুমি কিছুই জানো না?
না।
কিছু না?
কথায় কথায় একদিন সে বলেছিল—
কি?
তার স্বামী তাকে প্রচণ্ড মারধোর করতে প্রতি রাত্রে মাতাল হয়ে ঘরে ফিরে এসে। এক রাত্রে মারধোর করে বাড়ি থেকে বের করে দিয়ে দরজায় তালা দিয়ে চলে যায়।
তারপর?
দুদিন বাড়ির দরজার সামনেই সে বসে ছিল। তৃতীয় দিন বিকেলে হঠাৎ তার স্বামীর এক বন্ধু সেখানে গিয়ে উপস্থিত হয় এবং তার স্বামীর কাছে তাকে পৌঁছে দেবে বলে কলকাতায় নিয়ে আসে।
সেই বন্ধুটিকে মৃণালের স্বামী চিনতো?
হ্যাঁ—প্রায়ই সে যেতো ওদের বাড়িতে।
কে সে? কি নাম তার জানো?
না।
তারপর?
তারপর আর কি, এখানে বাড়িউলী মাসীর হাতে তাকে তুলে দিয়ে বন্ধুটি চলে যায়। পরে জেনেছিল মৃণাল, ওই লোকটির নাকি মেয়ে চালান দেবার ব্যবসা ছিল। আর সেই ব্যবসায় তার স্বামীও একজন ভাগীদার ছিল। সম্ভবত ওই লোকটি মৃণালকে চালান দেবার মতলব করেছিল।
কিন্তু এখানে এলো কি করে মৃণাল?
সে আর এক দৈবচক্র—
কি রকম?
স্বামীর সেই বন্ধুর আশ্রয় থেকে পালিয়ে এল রাত্রে মৃণাল। রাস্তায় এসে নামল। হাঁটতে হাঁটতে নিমতলার গঙ্গার ঘাটে গিয়ে বসে থাকল। সেখানে আমাদের বাড়িউলী মাসীর সঙ্গে দেখা
কিরীটী মৃদু হেসে বললে, ফ্রম ফ্রাইং প্যান টু দ্য ফায়ার!
কি বললেন বাবু?
না, কিছু না, তোমাদের বাড়িউলী মাসী তখন তাকে এখানে এনে তুলল, তাই না?
আজ্ঞে। এ পাপ দেহের ব্যবসায় সে নামতে চায়নি, কিন্তু পালাবার তো আর পথ ছিল, মাসীর চার-পাঁচজন তাবেদার গুণ্ডা আছে—মাসীর পোষ্যও তারা–তারা সর্বক্ষণ চোখ মেলে থাকত। কাজেই বুঝতে পারছেন বাবু–
কিরীটী প্রত্যুত্তরে মৃদু হাসলো।
আচ্ছা সে-রাত্রে ঠিক কি ঘটেছিল, মানে যতটা তুমি জানো বা জানতে পেরেছিলে আমাকে বলতে পার! কিরীটী প্রশ্নটা করে মিনতির দিকে তাকাল।
বাবু, সে রাত্রে আমার ঘরে কেউ ছিল না রাত দশটার পর। আমার বাবু পৌনে দশটা নাগাদ চলে যান
কিন্তু আদালতে বলেছে, অবিনাশ সেন নামে এক ভদ্রলোক আর তুমি—
ঠিকই বলেছি-যার কথা বলেছি সে আমার স্বামী।
স্বামী!
হ্যাঁ, আট বছর আগে তার ঘর ছেড়ে আমি চলে আসি–
কেন?
তার জঘন্য চরিত্র ও নিষ্ঠুর ব্যবহারের জন্য। কিন্তু সে আমাকে বছর তিনেক বাদে খুঁজে বের করে এখানে। এবং তারপর থেকে মধ্যে মধ্যে সে আসতো আমার কাছে।
কেন? টাকার জন্য?
না, সোনার বেনে—মস্তবড় জুয়েলারী ফার্ম তার, টাকার অভাব তো নেই। অনেক টাকা তার। টাকার জন্য সে আমার কাছে আসবে কেন?
তবে কি জন্যে আসতো?
আমাকে আবার ঘরে ফিরিয়ে নেবার জন্য।
ফিরে গেলে না কেন?
না। কারণ আমি জানতাম সেই একই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হবে। তাছাড়া—
কি?
এই পাপ নিয়ে আর কি সেখানে ফিরে যেতে পারি।