- বইয়ের নামঃ রক্তের দাগ
- লেখকের নামঃ নীহাররঞ্জন গুপ্ত
- বিভাগসমূহঃ গোয়েন্দা কাহিনী
০১. ফিরতে ফিরতে রোজই রাত হয়ে যায়
কখনো সাড়ে এগারোটা—কখনো রাত বারোটা বেজে যায়। আজও রাত হয়ে গিয়েছিল। বোধ হয় রাত বারোটা বেজে গিয়েছিল।
হাতঘড়ির দিকে না তাকিয়েও বুঝতে পারছিল সুদীপ। বাড়ির প্রায় কাছাকাছি যখন এসেছে সেই শব্দটা কানে এলো সুদীপের। একটা জুতো পায়ে হাঁটার শব্দ। শব্দটা কানে যেতেই থমকে দাঁড়াল সুদীপ আজও।
আশ্চর্য! সঙ্গে সঙ্গে পিছনের শব্দটাও থেমে গেল। আর কারো হেঁটে আসার শব্দ শোনা যাচ্ছে না।
সুদীপ জানে আবার সে হাঁটতে আরম্ভ করলেই পেছনে সেই শব্দটা শোনা যাবে। প্রথম প্রথম অতটা ভাবায়নি সুদীপকে; ভেবেছে কেউ তার পিছনে পিছনে হেঁটে আসছে।
দুদিন ধরে ওই একই শব্দ শুনে শুনে তৃতীয় দিন থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখবার চেষ্টা করেছিল কে তার পিছনে পিছনে হেঁটে আসছে অত রাত্রে। কিন্তু কাউকে সে দেখতে পায়নি। যতদূর দৃষ্টি চলে একেবারে ফাকা রাস্তাটা।
ছোট শহর। কলকাতা থেকে বেশী দূর নয়। গোটা তিনেক স্টেশন মাত্র। বাঁধানো রাস্তাটা সোজা স্টেশন থেকে কিছুদূরে এসে ডাইনে একটা বাঁক খেয়ে সোজা চলে এসেছে তার বাড়ির দিকে। স্টেশন থেকে দেড় মাইলের বেশী হবে না।
আগে রাস্তার দুপাশে কোন আলোর তেমন ভালো ব্যবস্থা ছিল না। দশ-পনেরো হাত দূরে দূরে মিউনিসিপ্যালিটির লাইটপোস্ট। তাও বেশীর ভাগ দিন বালব ফিউজ হয়ে যাওয়ায় আলোই জ্বলত না।
ইদানীং সমরেন্দ্রবাবু স্থানীয় এম. এল. এ. হওয়ায় মধ্যে মধ্যে কয়েকটা লাইটপোস্ট বসাবার পর বেশ আলো থাকে রাস্তাটায়।
পথে যেতে যেতে দুপাশে কিছু ঘর-বাড়ি ও দোকানপাট আছে কিন্তু অত রাত্রে কোন বাড়ির আলো জ্বলে না—দোকানপাটও বন্ধ হয়ে যায়। রাস্তাটাও একেবারে নির্জন হয়ে যায়। বোধ হয় একমাত্র সুদীপই শেষ ট্রেনের যাত্রী। লোকাল ট্রেন ওই সময় থাকে না–রাত এগারোটায় শেষ লোকাল ট্রেনটা চলে যায়।
পরের জংশন স্টেশনে মেল গাড়িটা থামে—সেই গাড়িতেই ফিরে সুদীপ পিছু হেঁটে আসে জংশন থেকে, নচেৎ অত রাত্রে ফিরবার আর কোনো উপায় নেই। জংশনটা মাইলখানেক দূরে—তাদের স্টেশনের আর জংশনের মাঝামাঝি জায়গাটা।
আজ দিন-দশেক হলো ওই শব্দটা শুনছে সুদীপ।
স্পষ্ট মনে আছে সুদীপের–খুনের মামলায় আদালতে সাক্ষী দেবার পর যেদিন সে ফিরে আসছে, সেইদিনই প্রথম ওই জুতো পায়ের শব্দটা সে শুনতে পেয়েছিল।
তারপর থেকে প্রতি রাত্রেই সে শুনছে ওই জুতো পায়ে চলার শব্দটা।
সুদীপ বোধ হয় অভ্যাসমতই হঠাৎ থেমে আজও পিছনপানে ফিরে তাকাল একবার। না, কেউ নেই–যতদূর দৃষ্টি চলে, রাস্তাটা একেবারে ফাকা—জনপ্রাণী নেই।
তবু আজ দাঁড়িয়ে থাকে সুদীপ রাস্তার দিকে তাকিয়ে। আজ আবার রাস্তার কয়েকটা আলো জ্বলছে না।
কেমন একটা আধো আলো আধো ছায়া থমথম করছে। হঠাৎ সেই আধো আলো আধো ছায়ার মধ্যে দুটো যেন নীল আগুনের মারবেল ভেসে উঠলো।
নীল আগুনের মারবেল দুটো এগিয়ে আসছে তার দিকে।
এমনিতে ভীতু নয় সুদীপ। কিন্তু ওই মুহূর্তে হঠাৎ যেন তার সমস্ত শরীর কাঠ হয়ে যায়, শক্ত হয়ে যায়। হঠাৎ আবার নীল আগুনের মারবেল দুটো অদৃশ্য হয়ে গেল। দপ করে যেন নীল আগুনের মারবেল দুটো নিভে গেল।
শীতের রাত। তবু সুদীপের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠেছে, কোথাও কিছু নেই—যতদূর দৃষ্টি চলে একটা আলো-ছায়ার থমথমানি।
নিশ্চয়ই ভুল দেখছে সুদীপ। চোখের ভুল। সুদীপ আবার চলতে শুরু করে।
সঙ্গে সঙ্গে আবার সেই শব্দ। হেঁটে হেঁটে কেউ যেন আসছে তার পিছনে পিছনে, ঠিক তার পিছনে।
আসুক।
সুদীপ আর থামবে না। পিছন ফিরে তাকাবে না। সুদীপ চলার গতি বাড়িয়ে দিল। বাড়ির সামনাসামনি পৌঁছে দেখে জানলা-পথে ঘরে আলোর ইশারা। ঘরে আলো জ্বলছে রমা জেগে আছে তার জন্য আজও।
প্রথম প্রথম রমা বলত, ইদানীং এত রাত করে ফের কেন? একটু তাড়াতাড়ি ফিরতে পার না আগের মত?
কাজ শেষ হবে—তবে তো আসবো। এখন অনেক বেশী কাজ। সুদীপ বলতো।
কি এমন কাজ তোমার যে রাত দুপুর গড়িয়ে যায়। একা তুমি ছাড়া বোধ হয় কেউ এত রাতে আর এদিকে ফেরে না।
সুদীপ কোন জবাব দেয় না। চুপ করে রমার কথাগুলো শুনে যায়। জামা-কাপড় খুলে বাথরুমে গিয়ে ঢোকে। কনকনে ঠাণ্ডা তোলা ড্রামের জলে ঐ রাত্রে স্নান করে।
কতদিন বলেছে রমা—অভিযোগ তুলেছে সুদীপের অত রাত করে বাড়ি ফেরা নিয়ে। কিন্তু এখন আর বলে না। বোধ হয় অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে রমা ব্যাপারটায়। কিংবা হয়ত বুঝতে পেরেছে রমা রাত করে বাড়ি ফেরার ব্যাপারে সুদীপকে বলে কোন লাভ নেই। সুদীপ তার কথায় কান দেবে না। অথবা রমাই হয়ত সুদীপকে একই কথা বলে বলে হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছে।
হন হন করে হেঁটে এসে সুদীপ দরজার সামনে দাঁড়াল। এবং আজ বেল বাজাবার আগেই দরজাটা খুলে গেল। সামনে দাঁড়িয়ে রমা।
রমা কোন কথা বলল না। দরজা খুলে দিয়ে ভিতরে চলে গেল।
সুদীপ কিন্তু তখুনি ভিতরে প্রবেশ করল না। দরজার উপর দাঁড়িয়ে পশ্চাতে যতদূর দৃষ্টি চলে তাকিয়ে দেখতে লাগল। কিন্তু কিছু তার চোখে পড়ল না।
শীতের মধ্যরাত্রের রাস্তাটা খাঁ খাঁ করছে। কোন জনপ্রাণীর চিহ্নমাত্রও চোখের দৃষ্টিতে পড়ে না। তবুও কয়েকটা মুহূর্ত সুদীপ সামনের রাস্তাটার দিকে তাকিয়ে রইলো।