বাথরুমের আলো নেভানো ছিল-অন্ধকার। দরজাটা যেমন আমি খুলেছি, সহসা অন্ধকার বাথরুমটা বাইরের বিদ্যুতের আলোকে ক্ষণিকের জন্য উদ্ভাসিত হয়ে উঠল; কড়কড় করে মেঘের গর্জন শোনা গেল, হঠাৎ চমকে উঠলাম। বিদ্যুতের আলোয় ঘরের জানালার দিকে চোখ পড়তেই… আমি স্পষ্ট দেখলাম…কাকা! হ্যাঁ, আমার কাকা স্যার দিগেন্দ্র জানালার কাচ দিয়ে রক্তচক্ষুতে চেয়ে দাঁতে দাঁত ঘষছেন। আমি সািভয়ে অস্ফুট চিৎকার করে চোখ বুজলাম।
কথা বলতে বলতে অধীর আগ্রহে কুমারসাহেব কিরীটীর হাত দুটো সজোরে চেপে হয়ে ফুটে উঠেছে। কপালে এই শীতের রাতেও বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে, ঘন ঘন নিঃশ্বাসপ্রশ্বাস পড়ছে।
জানালার ধারে, কুমারসাহেব। আবার বলতে লাগলেন, কাকা ছায়ার মত দাঁড়িয়ে ছিলেন মাথাটা একদিকে একটু হেলিয়ে, একটা হাত ঝুলছে। তখনকার তাঁর সেই চোখের দৃষ্টিতে যেন একটা দানবীয় জিঘাংসা ফুটে বের হচ্ছিল।
ডঃ চট্টরাজ আমাদের মুখের দিকে তাকালেন।
কুমারসাহেব নিঝুম হয়ে মাথা নীচু করে বসে আছেন।
সহসা যেন এক সময় কুমারসাহেব কেঁপে উঠলেন।
কিরীটী ধীর স্বরে প্রশ্ন করলে, তারপর?
আমার অস্পপুট চিৎকার বোধ হয় পাশের ঘরে মিঃ মিত্র ও মিঃ শৰ্মার কানে গিয়েছিল, র্তারা এক প্রকার ছুটেই বাথরুমে এসে প্রবেশ করলেন এবং প্রশ্ন করলেন, ব্যাপার কি কুমারবাহাদুর?
তাড়াতাড়ি তাঁরা সুইচ টিপে বাথরুমের আলোটা জ্বেলে দিলেন; আশ্চর্য ঘরে কেউ নেই! একদম খালি, অথচ.
বাথরুমে অন্য কোন দরজা ছিল কী? কিরীটী প্রশ্ন করল।
না। আমি যে দরজা দিয়ে প্রবেশ করেছিলাম সেটা ছাড়া বাথরুমে আর দ্বিতীয় দরজা নেই। যে জানালায় কাকাকে দেখেছিলাম, তারও সার্সি দুটো ঘরের ভিতর থেকে আটকানো ছিল।
ডাঃ চট্টরাজ বললেন, আপনার অবচেতন মনে আপনার কাকা সম্পর্কে যে অতীত দিনের আতঙ্ক সেটাই আপনার মনকে আচ্ছন্ন করে ছিল কুমারসাহেব এবং সেই চিন্তা থেকেই আপনার এ বিভীষিকার সৃষ্টি। এটা আপনার স্বগত কৃত্রিম নিদ্রাচ্ছন্নতা বা ইংরাজীতে যাকে বলে ‘self hypnosis”—আপনার স্নানঘরের মধ্যস্থিত আলো ও আয়নার সংমিশ্রিত প্রভাবেই ওটা সৃষ্টি হয়েছিল।
ডাক্তারের কথা শেষ হতে না হতেই কুমারসাহেব বলে উঠলেন, ডাক্তার, আপনাকে আমি আগেই বলেছি, আমি যা দেখেছি বা শুনেছি সেটা আমার ভ্রান্ত ধারণা বা মতিভ্ৰম, যাকে আপনারা ইংরাজীতে hallucination বলেন, সে রকম কোন কিছুই নয়, আমি কাকাকে স্পষ্ট দেখেছি। সত্যিই তাকে দেখেছি। কিন্তু তারপর কিন্তু আর সেখানে উপস্থিত ছিলেন না; অদৃশ্য হয়ে যান। আমার সেক্রেটারী ও মিঃ শমা চারিদিকে আশেপাশে তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখলেন, কিন্তু কিছুই দেখতে পেলেন না। অবিশ্যি তাঁদের আমি তখন বলেছিলাম, ব্যাপারটা আগাগোড়াই হয়তো আমার চোখের ভুলও হতে পারে। কেননা এ ব্যাপারে তাদের আমি, বিশেষ করে আজকের উৎসবের দিনে, চিন্তিত করতে চাইনি। কিন্তু আমি ভগবানের নামে শপথ করে বলতে পারি মিঃ রায়, আমার ভুল হয়নি। আমি তাঁকে দেখেছি, সুস্পষ্ট ভাবেই প্রত্যক্ষ দেখেছি।
কিরীটী বললে, ভাল কথা, আচ্ছা ডাঃ চট্টরাজ, আপনাদের ডাক্তারী শাস্ত্রের মনোবিজ্ঞানে এ ধরনের ব্যাপারকে কি বলে?
ডাঃ চট্টরাজ প্রবলভাবে মাথা দোলাতে দোলাতে বললেন, কুমারসাহেব হয় আমাদের আষাঢ়ে গল্প শোনাচ্ছেন, না হয় তামাসা করছেন নিছক আনন্দ দেবার জন্য। কিন্তু সে যাই হোক, এ ধরনের তামাসা…না, উনি একেবারে অসম্ভব কথা বলছেন।
ঘরের আলোয় কুমারসাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছিল, যেন তিনি অত্যন্ত ক্লান্ত ও ভীত হয়ে পড়েছেন।
ধীরে ধীরে এক সময় কুমারসাহেব বললেন, দেখুন ডাঃ চট্টরাজ, বিশেষ করে এ ব্যাপারে আপনাদের চাইতেও আমি বেশী বুঝি। একদিন আমি আমার কাকাকে কতখানি শ্রদ্ধা করতাম ও ভালবাসতাম। সে কথা কারও অজানা নেই; কাকার এই দুর্ঘটনার জন্য হয়তো জগতে আমার চাইতে আর কেউ বেশী দুঃখ পায়নি; শিশু বয়সে মা-বাবাকে হারাই, তারপর বারো বছর পর্যন্ত ঐ কাকার কাছেই আমি একাধারে মা ও বাবার স্নেহ-ভালবাসা পেয়ে এসেছি। কাকা যে আমার কতখানি ছিলেন তা বুঝিয়ে আপনাদের বলতে পারব না। কিন্তু এখন তীকেই আমি পৃথিবীতে সব চাইতে বেশী ভয় ও ঘৃণা করি। আমার সুখ শান্তি সব গেছে। রাতের পর রাত আমি নিদ্রাহীন চক্ষে নিদারুণ ভয়ে বিছানার ওপরেই বসে কাটিয়েছি।
এমন সময় সুশ্ৰী দোহারা পাতলা চেহারার ডিপ ব্লু রঙের সুট-পরা একজন ভদ্রলোক আমাদের সামনে এসে দাঁড়ালেন। মুহুর্তে যেন কুমারসাহেব আপনাকে সামলে নিলেন এবং ভদ্রলোকটির দিকে তাকিয়ে সহাস্য মুখে বললেন, আসুন মিঃ শৰ্মা, এদের সঙ্গে বোধ হয় আপনার পরিচয় নেই, ইনি মিঃ কালিদাস শৰ্মা,-সিটি কলেজের প্রফেসার। আর ইনি মিঃ কিরীটী রায়— বিখ্যাত রহস্যভেদী, ইনি মিলিওনিয়ার মিঃ সুব্রত রায়—ওঁর বিশেষ বন্ধু. আর ইনি ডাঃ চট্টরাজ, বিখ্যাত নিউরালজিস্ট (মনাবিজ্ঞান বিশারদ)।
আমরা প্রত্যেককে নমস্কার ও প্রতিনমস্কার করলাম।
এতক্ষণ বরাবরই আমি বিশেষ ভাবে লক্ষ্য করছিলাম, ওদিককার যে দরজা দিয়ে অল্প আগে মিঃ মিত্র গিয়ে ঢুকেছেন কুমারসাহেবের প্রাইভেট রুমে, সেইদিকেই কিরীটী যেন সৰ্বক্ষণ তাকিয়েছিল এবং সেদিক থেকে দৃষ্টি না সরিয়েই একসময় মৃদুকণ্ঠে বলল, আচ্ছা! কুমারসাহেব, আপনি স্যার দিগেন্দ্রকে ঠিক চিনলেন কি করে? এক বছরে কি তাঁর দেহের কোন পরিবর্তনই হয়নি?