কী? কিরীটী সাগ্রহে প্রশ্ন করল।
ডাক্তার বলতে লাগলেন, ওদের ফ্যামিলিতে নাকি কবে কোন এক পূর্বপুরুষের ‘এপিলেপিসি’ (অনেকটা ফিটের মত ব্যারাম) ছিল। যাহোক স্যার দিগেন্দ্রকে পরীক্ষা করে। দেখলাম, দেহ তার বেশ সুস্থ ও সবল এবং রোগের কোন লক্ষণমাত্রও নেই। তবে চোখের দৃষ্টি-শক্তি একটু কম ছিল। সম্ভবত অতিরিক্ত পড়াশুনার জন্যই সেটা হয়ে থাকবে। লোকটি উঁচু, লম্বা, বলিষ্ঠ গঠন। চোখের তারা দুটো অন্তৰ্ভেদী ও স্থিরপ্রতিজ্ঞ। ভদ্রলোক বহু ভাষায় সুপণ্ডিত। কথায় কথায় একসময় স্যার দিগেন্দ্র বললেন, বিকেলের দিকে সমুদ্রের ধারে একটিবার আসবেন ডাক্তার, আপনাকে আরও গোটাকতক কথা বলব।
জবাবে বললাম, বেশ তো। এবং কথামত বিকেলের দিকে সমুদ্রের ধারে স্যার দিগেন্দ্রর সঙ্গে দেখা হল। খানিকটা ঘুরে বেড়াবার পরই সন্ধ্যা হয়ে এল। সমুদ্রের ধারে একটু অপেক্ষাকৃত নির্জন স্থান দেখে নিয়ে বালুবেলার ওপরেই দুজনে পাশাপাশি বসলাম। নানা
মৃদুস্বরে বললেন, দেখুন ডাক্তার, দীপু যাই বলুক না কেন, আমার নিজের ব্যাপারটা আমি নিজেই আপনাকে বুঝিয়ে বলছি, শুনুন।
শান্ত গভীর কণ্ঠে স্যার দিগেন্দ্র বলতে লাগলেন, সত্যি বলতে কি, আমার মনে সত্যি সত্যি কোন abnormal idea বা instinct বা কোন কুৎসিত ভয়ঙ্কর গোপন ইচ্ছা লুকিয়ে আছে কিনা আমি নিজেই তা জানি না বা আজ পর্যন্ত ঘৃণাক্ষরেও কোনদিন টেরও পাইনি। আর এও আমি মনে করি না, যদি বা অমন কুৎসিত ভয়ঙ্কর কোন গোপন ইচ্ছা আমার মনের কোথাও থাকেই, সেটা আমার পুরুষানুক্রমে পাওয়া। আমার নিজের যতদূর মনে হয়, ছেলেবেলা হতেই অদ্ভুত অদ্ভুত সব বই পড়ে পড়ে ও-রকম একটা কুৎসিত ভয়ঙ্কর ইচ্ছা আমার মনে মাঝে মাঝে আমার চিন্তাশক্তির অজ্ঞাতে আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। মানুষকে যেমন ভুতে পায় এও অনেকটা তেমনি। এটা আমার অবচেতন মনের একটা ক্ষণিক পাগলামিও বলতে পারেন; কিংবা দুর্বলতাও বলতে পারেন।
একটু থেমে আবার স্যার দিগেন্দ্র বলতে শুরু করলেন, ডাক্তার, শিশু বয়স থেকেই আমি চিরদিন অনুভব করেছি, আমার মনের চিন্তাশক্তি যেন একটু বেশী প্রখর। সেটাকে অবিশ্যি সাধারণ অকালপক্কতাও বলতে পারেন। যে বয়সে যা ভাবা উচিত নয় চিরদিন আমি সেই সব ভেবেছি। অদ্ভুত ছিল আমার মনের ভাবনাগুলি। অন্য সকলের কাছে যেটা মনে হবে অসংবদ্ধ অসম্ভব এলামেলো অর্থহীন, আমার কাছে সেগুলো ছিল একান্ত স্পষ্ট ও সত্য। যাহোক, কেন জানি না, ছোটবেলা হতেই মধ্যযুগের শক্তিমান ইংরেজ লেখকদের লেখা সব বই পড়তে আমার বড় ভাল লাগত। বিশেষ করে যেসব লেখকদের লেখা একটু বেশী রকম কল্পনাময়, সেইগুলির আমি বেশি পড়তাম। যেমন ধরুন ‘বডিলেয়ার’ ‘ডিকুইনসি’ ‘পোয়ে’ ইত্যাদি। এদের বইগুলো পড়তে পড়তে আমার কি মনে হত জানেন? যেন একটা অদৃশ্য দুৰ্নিবার অদ্ভুত ইচ্ছা আমার সমগ্র চিন্তা ও মনের ভিতরকার ভাল-মন্দের বোধশক্তিকে ঘুম পাড়িয়ে ফেলছে। ধীরে ধীরে, যেমন করে সাপুড়ের হস্তচালনায় সাপ হয়ে পড়ে মন্ত্ৰমুগ্ধ! বিশেষ করে, রাত্রের ঘন অন্ধকারে যেন একটা অদম্য রক্ত দেখবার লালসা ভূতের মতই আমায় তাড়া করে ফিরছে। সেই অদ্ভুত তাড়নায় কতদিন আমি পাগলের মতই হয়ে উঠেছি। রক্ত! রক্ত চাই! টাটুকী, তাজা, লাল টকটকে রক্ত, তা সে মানুষেরই হোক বা পশু-পক্ষীরাই হোক-রক্ত। রক্ত চাই! মনে হয়েছে রক্তের জন্য আমার সমগ্ৰ দেহ ও মন যেন মরুভূমির মতই তৃষ্ণকাতর হয়ে উঠেছে। আমি যেন কতকালের তৃষ্ণগর্ত বুভুক্ষিত উপবাসী।
ডাঃ চট্টরাজ বলতে লাগলেন, আমরা সেই অন্ধকার সাগরকিনারে বালুবেলার ওপরে বসে, কেউ কোথাও নেই; শুধু মাথার ওপরে কালো আকাশপটে অগণিত তারা মিটমিটি জুলছে আর নিভছে। অদূরে উচ্ছসিত সাগর-তরঙ্গ সেই স্নান নক্ষত্ৰলোকে যেন কোন এক ক্ষুধার্ত হিংস্র ভয়ঙ্কর পশুর ধারালো দাঁতের মত মনে হয়। একটা অশরীরী ভয়ে যেন সহসা বুকের মধ্যে শির শির করে ওঠে।
দুই হাতে হ্যাঁটুটা জড়িয়ে স্যার দিগেন্দ্র বসে। অস্পষ্ট আলো-আঁধারিতে তাঁকে যেন কেমন অশরীরী ভয়াবহ বলে মনে হচ্ছিল। সহসা এক সময় আমার মুখের দিকে তাকিয়ে স্যার দিগেন্দ্ৰ কেমন যেন একপ্রকার কুৎসিত বীভৎস হাসি হাসলেন। অন্ধকারেও তার চোখের তারা দুটো ঝকঝাক করে জ্বলছিল। ভদ্রলোকের গায়ের রং ছিল অস্বাভাবিক রকম ফরসা। মুখে ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি।
স্যার দিগেন্দ্র আবার বলতে লাগলেন, ডাক্তার, আপনার কাছে আমি গোপন করব না। খুন আমি অনেকগুলো করেছি, এবং প্রায় করি। রাত্রের নিঃশব্দ অন্ধকারের সঙ্গে সঙ্গে আমার শিক্ষা, সংযম, সভ্যতা, কৃষ্টি সব কিছু নিঃশেষে লোপ পায়। আমি যেন পাগল হয়েই রক্ত-তৃষ্ণায় ক্ষুধিত হায়েনার মত ছুটে বেড়াই। ডাক্তার, ডাক্তার, তুমি পালাও, আমার কাছ থেকে শ্রীঘ্র পালাও। Get away! Get away from me!
এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সহসা পাগলের মতই বুকপকেট থেকে একটা ধারালো কালো হাড়ের বঁটওয়ালা ক্ষুর স্যার দিগেন্দ্ৰ টেনে বের করলেন। অস্পষ্ট আলোয় ক্ষুরের ইস্পাতের ধারালো ফলাটা যেন মৃত্যু-ক্ষুধায় লক্লক করে উঠল। আমি বিদ্যুৎগতিতে এক লাফে উঠে দাঁড়িয়েই ছুটিলাম। সঙ্গে সঙ্গে একটা দুৰ্দমনীয় অট্টহাসির বেগ সমুদ্রের একটানা গর্জনকে ছাপিয়ে হা হা করে সাগর-কুল সচকিত করে তুলল। উঃ, সে কী হাসি! যেন শরীরের সমস্ত রক্ত জমাট বেঁধে বরফ হয়ে যাবে। সারারাত ঘুমিয়ে দুঃস্বপ্ন দেখলাম। ঐ দিনই গভীর রাত্রে আমার ঘরের দরজায় কার মৃদু করাঘাতে আমার ঘুম ভেঙে গেল। কে যেন অতি মৃদু মিষ্টি কোমল স্বরে দরজার ওপাশ থেকে আমায় ডাকছে—দরজা খোল! দরজা খোল! আমি ভয়ে কাঠ হয়ে মড়ার মত বিছানায় চোখ বুজে পড়ে রইলাম। ঘামে সর্বাঙ্গ আমার ভিজে যেতে লাগল। পরের দিন ভোরেই পুরী থেকে রওনা হয়ে এখানে ফিরে আসি। এরই দু-তিন দিন বাদে শুনলাম, স্যার দিগেন্দ্র ধারালো ক্ষুর দিয়ে নাকি নিজের ভাইপোকেই কাটতে উদ্যত হয়েছিলেন।