ঐ যে কুমারসাহেবের গলা, চল, পর্দার ওধারে বসে আছেন বোধ হয়!
কিরীটী আমার হাত ধরে মৃদু আকর্ষণ করল।
দুজনে পর্দার দিকে এগিয়ে গেলাম।
কিরীটীর অনুমানই ঠিক। গা আলমারি না হলেও অনেকটা গা-আলমারি মত খানিকটা জায়গা। সেখানে অর্ধ-চন্দ্ৰাকৃতি একটা ভেলভেট মোড়া দামী সোফা পাতা। এবং তার সামনে ঐ আকারেরই একটি ছোট টেবিল। টেবিলের ওপর নীল রংয়ের ঘেরা টোপে ঢাকা একটি ক্ষুদ্র টেবিল-ল্যাম্প জ্বলছে। টেবিল-ল্যাম্পের মৃদু নীলাভ আলো সামনে ঝুলন্ত নীল রংয়ের পর্দার সঙ্গে যেন মিশে একাকার হয় গেছে—তাই ওদিক থেকে তেমন বিশেষ কিছু বোঝা যায়নি।
সোফার ওপর সাহেবী বেশ-পরিহিত চোখে কালো কাচের চশমা একজন ভদ্রলোক ও অন্য একজন প্রৌঢ় ভদ্রলোক বসে মৃদুস্বরে গল্প করছিলেন, আমাদের দেখে সাহেবী বেশপরিহিত ভদ্রলোকটি উঠে দাঁড়ালেন এবং সসম্রামে বললেন, হ্যালো মিঃ রায়, গুড ইভনিং! ইনিই বোধ হয় মিঃ সুব্রত রায়? আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন।
কিরীটী নমস্কার করে বলল, হঁয়া কুমারসাহেব, ইনিই সুবিখ্যাত মিলিও-নিয়ার সুব্রত রায় আমার বিশিষ্ট বন্ধু ও সহকারী।–
কিরীটীর কথায় বুঝলাম বক্তাই কুমারসাহেব।
কুমারসাহেবের দিকে ভাল করে চেয়ে দেখলাম। নীতি-দীর্ঘ সবল দেহাবয়ব; মাথায় লম্বা কঁচা-পাকা চুল, মাঝখানে সিঁথি কাটা, পরিধানে দামী সার্জের সুট, চোখে একজোড়া রঙিন কাচের চশমা। তাছাড়া মুখের ভাব অত্যন্ত শান্তশিষ্ট প্রকৃতির।
এই সময় দ্বিতীয় প্রৌঢ় ভদ্রলোকটি বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। আমরা তিনজনে সোফার ওপর কুমারসাহেবের নির্দেশক্রমে উপবেশন করলাম।
ইনিই আমাদের কুমারসাহেব দীপেন্দ্রনারায়ণ, সুব্রত। কিরীটী বললে আমার দিকে এবারে তাকিয়ে।
একজন বেয়ারা ট্রেতে করে কাপ-ভর্তি ধূমায়িত চা ও প্লেটে করে কিছু প্লাম-কেক দিয়ে গেল। ট্রের ওপর হতে একটা ধূমায়িত চায়ের কাপ তুলে নিয়ে কাপে মৃদু চুমুক দিতে দিতে কিরীটী বলল, জানিস, ভারী বৈচিত্ৰ্যপূর্ণ এর জীবন-কথা সুব্ৰত!
এমন সময় দামী সুট-পরা একজন বৃদ্ধ গোছের ভদ্রলোক পর্দা তুলে এসে সেখানে শু বেশ করলেন।
হ্যালো ডাঃ চট্টরাজ। কলকাতায় কবে ফিরলেন? কিরীটী সোল্লাসে বলে উঠল।
এই তো কদিন হল। তারপর রায়, তোমার সংবাদ কী বল? ডাঃ চট্টরাজ কিরীটির দিকে চেয়ে প্রশ্ন করলেন এবং সহাস্যমুখে বললেন, দাও। হে রহস্যভেদী, একটা বিমর্ণ সিগার দও তোমার। অনেক দিন খাই না। খেয়ে দেখি!
কিরীটী মৃদু হেসে তার পকেট থেকে সুদৃশ্য হাতাঁর দাঁতের সিগার কেন্সটা বের করে ডাক্তারকে একটা সিগার দিল।
কুমারসাহব বললেন, মিঃ রায়, আপনারা ততক্ষণ আলাপ করুন, আমি ওদিকটা একটু দেখে আসি।
কুমারসাহেব চলে গেলেন।
তারপর ডাক্তার, আপনি এক সময় স্যার দিগেন্দ্রর চিকিৎসা করেছিলেন, না? কিরীটী প্রশ্ন করলে ডাঃ চট্টরাজের মুখের দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে।
হ্যাঁ, সে প্রায় বছর তিন সাড়ে তিন আগেকার কথা। কিন্তু তাহলেও তার সম্পর্কে সব কিছুই আমার আজও বেশ স্পষ্ট মনে আছে।
একটা কথা আপনাকে আজ জিজ্ঞাসা করব ডাঃ চট্টরাজ?
বলুন!
আচ্ছা, স্যার দিগেন্দ্রর কি সত্যি সত্যিই মাথার কোন গোলমাল হয়েছিল বলে আপনার মনে হয়?
ডাঃ চট্টরাজ যেন অল্পক্ষণ কি একটু ভাবলেন, তারপর মৃদুস্বরে বললেন, দেখুন। আমার যতদূর মনে হয়, ভদ্রলোকের Hyperoes—thisia ছিল। তাঁর মধ্যে প্রায়ই একটা খুনোখুনি করবার যে tendency জেগে উঠেছিল তাতে ও ধরনের ব্যাপারকে Lust Murder বলা যায়, অর্থাৎ যাকে সহজ ভাষায় খুন করবার একটা ইচ্ছা বলা চলে এবং স্যার দিগেন্দ্রর মত ঠিক ঐ ধরনের ‘কেস’ আমার ডাক্তারী-জীবনে চোখে বড় একটা পড়েনি। ডাক্তারী শাস্ত্র ও নানা প্রকারের নজির থেকে বলা যায়, এধরনের মনের বিকৃতি যাদের হয় তারা প্রিয়জনের বড় একটা ক্ষতি করে না। অথচ আশ্চর্য, স্যার দিগেন্দ্র তার অতি প্রিয় ভাইপোকেই শেষটায় খুন করতে গিয়েছিলেন। ভাগ্যে বেচারা চিৎকার করে লোকজন জড়ো করে; তা ছাড়া কুমারসাহেবের গায়েও অসীম ক্ষমতা ছিল। ভদ্রলোককে আমন হাবাগবা বোকাটে ধরনের দেখতে হলে হবে কি, গায়ে শুনেছি নাকি অসুরের মতই ক্ষমতা রাখেন।
ডাক্তার আবার বলতে লাগলেন, আমি তখন স্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্য পুরী বেড়াতে গেছি, সেই সময় হঠাৎ একদিন সকালে কুমারসাহেবের বাড়ি থেকে call পেয়ে স্যার দিগেন্দ্রকে দেখতে যাই। সেও আজ বছর কয়েক আগেকার কথা। সকালবেলা রোগী দেখতে গেলাম, পুরীতে সমুদ্রের ধারেই ওঁদের সুন্দর একখানা বাংলো প্যাটার্নের বাড়ি আছে। স্যার দিগেন্দ্র তখন বারান্দায় একটা ডেকচেয়ারে বসে শেকস্পীয়র পড়ছিলেন; কুমারসাহেবও তাঁর কাকার পাশেই বসেছিলেন, আলাপ পরিচয় হবার পর স্যার দিগেন্দ্ৰ আমার দিকে চেয়ে হাসতে হাসতে বললেন, দীপু আমার জন্য বডড ব্যস্ত হয়ে পড়েছে ডাক্তার চট্টরাজ।
আমি হাসতে হাসতে বললাম, কেন?
স্যার দিগেন্দ্ৰ জবাবে বললেন, ওর ধারণা আমার কিছুদিন থেকে রাত্রে ভাল ঘুম হচ্ছে না বলে শীঘ্রই নাকি অসুস্থ হয়ে পড়ব।
বলতে গেলে অতঃপর কুমারসাহেবের বিশেষ অনুরোধেই স্যার দিগেন্দ্রকে আমি পরীক্ষা করি এবং আশ্চর্য আমি স্যার দিগেন্দ্রকে খুব ভাল ভাবেই পরীক্ষা তো করলামই এবং অনেকক্ষণ ধরে সে রাত্রে তার সঙ্গে কথাবার্তাও বললাম, দেখলাম মাথার কোন গোলমাল নেই, চিন্তাশক্তিও স্বাভাবিক শান্ত ও ধীর; মস্তিষ্কের কোন রোগের লক্ষণই পাওয়া গোল না। তবে পূর্বপুরুষদের ইতিহাস জানতে গিয়ে একটা জিনিস পাওয়া গেল।