তারপর? আমি প্রশ্ন করলাম।
তারপর সেই রাত্রে একজন লোককে নাকি কালো একটা ওভারকেট গায়ে, মাথায় কালো একটা টুপি, চোখের পাতা পর্যন্ত নামানো, ডাক্তারের বাড়ি থেকে বের হয়ে আসতে একজন প্রহরারত পুলিস দেখেছিল। প্রহরারত পুলিসটা তখন নাকি সেই রাস্তা দিয়েই ফিরছিল। পুলিস যাকে সেই রাত্রে ডাঃ রুদ্রের বাড়ির সামনে রাস্তা দিয়ে যেতে দেখেছিল সেই লোকটি পুলিসের দিকে একটিবারও না তাকিয়ে তার পাশ দিয়েই রাস্তা ধরে নাকি চলে যায় খোসমেজাজে একটা গানের সুর শিস দিতে দিতে। পুলিস তাকে সন্দেহ করেনি, কারণ তাকে সে কোন একজন সাধারণ পথচারীই ভেবেছিল।
আগেই বলেছি। পরদিন ভোরবেলা ডাক্তারের মুণ্ডুটা তাঁরই ল্যাবরেটারী-ঘরে টেবিলের ওপর রক্ষিত একটা কাচের জারের মধ্যে পাওয়া যায়। সে যাই হোক, এই এতগুলো ঘটনাকে যদি এক সূত্ৰে গাঁথা যায়। তবে একটা কথা বিশেষভাবে মনের মধ্যে স্বতঃই উদিত হয়।
কী? আমি প্রশ্ন করলাম।
স্যার দিগেন্দ্ৰ বোধ হয় এখনও জীবিত। এবং তঁর সেই বিকৃত-মস্তিষ্কের কল্পনা—
কিরীটী হঠাৎ চুপ করে গেল।
কিরীটী কি বলতে বলতে থেমে গেল জানি না, তবে আমার মনে হল স্যার দিগেন্দ্র। এখনও যেন রাতের অন্ধকারে বিকৃত একটা রক্ত-নেশায় কুমার দীপেন্দ্রর পিছু পিছু ছায়ার মতই ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
মনটার মধ্যে যেন সহসা কি একটা অজানিত আতঙ্কে ছাঁত করে উঠল।
একটা অদৃশ্য ভয় যেন অন্ধকারে অক্টোপাশের মতই ক্লেদাক্ত পিচ্ছিল অষ্টবাহু দিয়ে আমার চারপাশে ঘন হয়ে উঠছে।
গাড়ির মধ্যকার মৃদু নীলাভ আলোয় কিরীটীর মুখের দিকে দৃষ্টিপাত করলাম-কিরীটীর দুটি চক্ষু বোজা।
কি এক গভীর চিন্তায় যেন সে তলিয়ে গেছে।
বাকি দুজন ভদ্রলোক, যাঁরা ঠিক আমার পরেই সেই একই সীটে পাশাপাশি বসে অন্ধকারে তাদের মুখগুলো যেন পাথরের মতই কঠিন ভাবহীন।…
আমি চোখটা ফিরিয়ে নিলাম।
০২. গাড়িটা মৃদু ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে গেল
গাড়িটা একটা মৃদু ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে গেল। একটা মৃদু গোলমাল অস্পষ্ট গুঞ্জনের মত আমাদের কানে এসে বাজাল।
আমরা এসে গেছি সুব্রত। চল, নামা যাক। কিরীটী বললে।
আমরা দুজনে গাড়ি থেকে নোমলাম প্রথমে এবং আমাদের সঙ্গে সঙ্গে বাকি দুজন
ভদ্রলোকও গাড়ি থেকে নামলেন।
কুমার দীপেন্দ্রর প্রাসাদতুল্য মার্বেল প্যালেস আজ নানা বর্ণের আলোকমালায় ফুল ও পাতাবাহারে সুশোভিত। সবুজ, নীল, লাল নানা বর্ণ-বৈচিত্ৰ্য আলোর নয়নাভিরাম দৃশ্য।
বহু সুবেশ ও সুবেশা নরনারীর কলকাকলীতে সমগ্র প্রাসাদটি মুখরিত।
দরজার গোড়ায় একজন ভদ্রলোক অভ্যাগতদের অভ্যর্থনার জন্য দাঁড়িয়েছিলেন, আমাদের কক্ষে প্রবেশ করতে দেখে সাদর আহ্বান জানালেন। বললেন, আসুন আসুন।
কিরীটি তার পরিচয় দিতেই সেই ভদ্রলোক বললেন, ওঃ, আপনি মিঃ কিরীটী রায়? কুমারসাহেব ওপরে আছেন,-সোজা ওপরে চলে যান।
সামনে একটা সুপ্ৰশস্ত মাৰ্ব্বেল পাথরে বাঁধানো টানা বারান্দা গোছের। ডানদিকে প্রকাণ্ড একটা হলঘর। সেখানে টেবিল চেয়ার পেতে আধুনিক কেতায় অতিথি-অভ্যাগতদের খাবার বন্দোবস্ত করা হয়েছে। সেই হলঘরের বা দিকে একটা ছোট ঘর, কয়েকখানি সোফা পাতা, সাত-আটজন ভদ্রলোক খোসাগল্পে মগ্ন।
ঘরে ঘরে অত্যুজ্জ্বল বৈদ্যুতিক আলো। বারান্দার এক পাশ দিয়ে দোতলায় ওঠবার সিঁড়ি, সেটাও মার্কেল পাথরে তৈরী। ভদ্রলোকের নির্দেশমত আমরা সিঁড়ি দিয়ে দ্বিতলের দিকে অগ্রসর হলাম।
দ্বিতলে উঠে কিরীটী সঙ্গের সেই দুজন ভদ্রলোকের যেন নিম্নকণ্ঠে কি বললে, তারা সঙ্গে সঙ্গে নীচে চলে গেল। আমরা অতঃপর দোতলায় উঠেই সামনে যে প্ৰকাণ্ড হলঘর, সেই হলঘরের মধ্যে গিয়ে প্রবেশ করলাম। প্রচুর সাজসজ্জায় ও আলোকমালায় যেন ইন্দ্রপুরীর মতই মন হচ্ছিল ঘরটাকে।
ঘরের মেঝেত দামী পুরু লাল রংয়ের কাশ্মীরী কর্পেট বিছানো। হলঘরের সংলগ্ন একটা নাতি-প্রশস্ত ঘর দেখা যায়। হলঘরের সঙ্গে যোগাযোগ করে পর পর পাশাপাশি দুটি দরজায় দামী সবুজ রঙের পর্দা ঝুলছে; এবং পর্দা ভেদ করে সেই ঘর থেকে আনন্দ-কলরব কানে ভেসে আসে মাঝে মাঝে।–
হলঘরের মধ্যে ছোট ছোট সব গোলাকার টেবিল পেতে তার চারপাশে চেয়ার রাখা হয়েছে। ভদ্রলোকেরা সেই চেয়ারে বসে চা ও সরবৎ। সহযোগে খোসাগল্পে মত্ত।
একজন ভদ্রলোককে দেখে কুমারসাহেবের খোঁজ নিতেই, কুমারসাহেব ঐ সামনের ঘরে আছেন বলে ভদ্রলোকটি দুই-দরজাওয়ালা ঘরটি আমাদের দেখিয়ে দিলেন। আমরা এগিয়ে গেলাম।
ঘরের ঠিক নীচে দিয়েই ট্রাম-রাস্তা চলে গেছে। ট্রাম-রাস্তার দিকে মুখ করে ঘরে প্রায় পাঁচ-ছটি জানলা, প্রত্যেকটিতে দামী নেটের বাহারে পর্দা টাঙানো। ঘরের বা দিকে কতকগুলো দেওয়াল-আলমারির মত আছে। তাতেও পর্দা ঝুলানো। বোধ হয় সেগুলিতে জিনিসপত্র রাখা হয়। ঘরের ডান দিকের দেওয়ালটা ঘরের ছাদ থেকে ডিমের মত ঢালু। হয়ে যেন মেঝেতে নেমে এসেছে; মাঝখানে একটা দরজা। ঘরের মধ্যে সোফা ও চেয়ারে বসে কয়েকটি ভদ্রলোক গল্প করছেন। কুমারসাহেব সেখানে নেই।
মাঝে মাঝে উচ্চহাসির রোল উঠছে।
ঘরের দেওয়ালে দেওয়ালে দামী ফ্রেমের সব সুদৃশ্য ছবি ঝুলছে। ঘরের মাঝখানে একটা টেবিলের চারপাশে বসে চারজন ভদ্রলোক তাস খেলছেন।
ঘরে ঢুকে যেটাকে গা-আলমারি মনে হয়েছিল, হঠাৎ সেই দিকের পর্দার আড়াল থেকে একটা হাসির শব্দ শোনা গেল; কিরীটী আর আমি দুজনেই চমকে সেদিকে ফিরে তাকলাম।