এবার হয়েছে, আমাকে বলতে দিন ডাক্তার। কিরীটী সহসা বলে উঠল।
বলুন। ডাক্তার মৃদু হেসে জবাব দিলেন, কিন্তু হাতের বাঁধনটা খুলে দিতে বলুন। ভয় নেই, পালিয়ে বাঁচবার ইচ্ছা আর আমার নেই। পর পর দু-দুটো খুন করে এ জীবনে আমার ঘৃণা হয়ে গেছে। কুমারসাহেব ও আমার নিজের উপার্জিত সমস্ত সম্পত্তি আমি গতকালই উইল করে জনসাধারণের মঙ্গলের জন্য দান করে দিয়েছি, আর তার অছি নিযুক্ত করেছি কাকে জানেন?
কিরীটী অধীর স্বরে বললে, কাকে?
আমার জীবনের সব চাইতে বড় শত্রু ও সবার বড় বন্ধু আপনাকে ও সুব্রতবাবুকে।
ধন্যবাদ ডাক্তার। কিরীটী বললে।
এর পর ডাক্তারের হাত-পায়ের বাঁধন খুলে দেওয়া হল। মূহুর্তকাল কিরীটী চুপ করে রইল। তারপর আবার ধীরস্বরে বলতে লাগল, তাহলে এঁদের কৌতূহলটা মিটিয়ে দিই। হ্যাঁ শুনুন আপনার সেক্রেটারী অর্থাৎ স্যার দিগেন্দ্ৰ ৮.৫৫ মিনিট পর্যন্ত আপনার খাবার ঘরেই ছিলেন। তারপর সেখান থেকে তিনি বের হয়ে আসেন বোধ করি ঠিক ৮.৫৫ মিনিটে এবং সাড়ে নটার সময় আমাদের ধারণা ও দেখা অনুসারে তিনি প্রাইভেট রুমে ঢোকেন। এই যে ৩৫ মিনিট সময়-এই সময়টা কেউ তাকে দেখতে পায়নি। এই সময় তিনি খাবার ঘর, ড্রইংরুম, হলঘর, শোবার ঘর, লাইব্রেরী ঘর বা নীচে বা সিঁড়িতে কোথাও ছিলেন না। তবে নিশ্চয়ই তিনি ঐ সময় আপনার প্রাইভেট রুমে ছিলেন এবং খাবার ঘর থেকে বের হয়ে সোজা তিনি ঐখানেই গিয়ে ঢুকেছিলেন।
এটাও ঠিক ডাক্তার যে, ৮.৫০-৮.৫২ মিনিটের সময় আপনার ম্যানেজারের সঙ্গে দোতালার সিঁড়িতে আপনার দেখা হয়। তাহলে নিশ্চয়ই ধরা যায় ঠিক ঐ সময়ই মিঃ মিত্ররূপী স্যার দিগেন্দ্র যখন আপনার খাবার ঘর থেকে বের হয়ে আসেন, দোতলার হলঘরে আপনাদের দুজনের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। কেমন কিনা, am I right?
হ্যাঁ, আপনার কথাই ঠিক মিঃ রায়। আমি সন্ধ্যার সময়েই ঠিক করেছিলাম মনে মনে, স্যার দিগেন্দ্রকে আজ শেষ করব। কেননা ও যা ভয়ানক লোক, সুযোগ পেলেই আমাকে অনায়াসে খুন করবে। তাই সন্ধ্যার অল্প পরেই আমার নিজ স্বাক্ষরে ওকে চিঠি দিলাম ঃ তোমার সময় উপস্থিত, আজই–প্রস্তুত থাক।-ইতি। ‘কালো ভ্রমর’। সারা বাড়িতে তখন উৎসবের হুল্লোড়ি; নটা বাজবার কয়েক মিনিট আগে ম্যানেজারের কাছ থেকে এসে hashish দিয়ে তৈরী কয়েকটা সিগারেট চেয়ে নিই। কেননা আপনি জানেন আমি বাড়িতে মরফিয়া ইনজেকশন নিতাম। এখানেও ওটা অভ্যাস করে ছিলাম। কিন্তু মাঝে মাঝে মরফিয়া বন্ধ করবার জন্য অত্যন্ত ক্লান্তি বোধ হত। রাতে ভালো ঘুম হত না। প্রফেসর শর্মাকে এ কাজে নিয়েছিলাম, কেননা দুজনে না হলে এতগুলো লোকের চোখে ধুলো দেওয়া যাবে। না। শৰ্মা আমায় বলে গেল, ওকে নিয়ে আমি খাবার ঘরে যাচ্ছি। তুমি সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা কর। যখন সে খাবার ঘর থেকে বের হয়ে আসবে ওর সঙ্গে দেখা করবে। কিন্তু সাবধান, তোমাকে যেন কেউ লক্ষ্য না করে।
৮.৫৫ মিঃ কি ৯টার সময় দিগেন্দ্ৰ খাবার ঘর থেকে বের হয়ে এল। ওপরের হলঘরে তখন বড় একটা কেউ ছিল না। যে দু-চারজন ছিল তারা তখন তাঁস খেলায় মত্ত। বাকি অভ্যাগতরা নীচের হলঘরে গান-বাজনায় জমে উঠে। প্রফেসার যখন খাবার ঘরে দিগেন্দ্রকে নিয়ে যায়, আমি সেই ফাকে এক সময় প্রাইভেট রুমে ঢুকে দেওয়াল থেকে তলোয়ারটাকে নামিয়ে সোফার ওপর গদির তলায় রেখে আসি। হলঘরে দাঁড়িয়ে আছি সিঁড়ির কোণায়। দিগেন্দ্র ঘর থেকে বেরিয়ে আসতেই ওকে ইশারায় ডেকে প্রাইভেট রুমে গিয়ে ঢুকি, কেউ দেখেনি। আমার মুখে একটা জ্বলন্ত সিগারেট ছিল। একসময় দুজনে কথা বলতে বলতে টুপ করে সেটা মেঝোয় ফেলে দিই। ইচ্ছা করে। দিগেন্দ্র সেটা যেমন কুড়িয়ে নিতে নীচু হয়েছে, চক্ষের নিমেষে গদির তলা থেকে ভারী তলোয়ারটা টেনে নিয়ে তার গলা দু ভাগ করে দিই। তারপর মাথাটা নিয়ে মাঝখানে রেখে দিই। এখন বুঝতে পারছেন আপনারা, মৃতদেহের position ওরকম ছিল কোন!
তারপর ৯.১০ মিনিটের সময় আমি একটা চাদর জড়িয়ে ওঘর থেকে বের হয়ে সোজা শোবার ঘরে গিয়ে ঢুকি। সেখানে দেড় থেকে দু মিনিটের মধ্যে পোষাক বদলে আপনাদের সঙ্গে গিয়ে দেখা করি। আমি আগেই আপনাকে দিগেন্দ্রর লেখা চিঠি পাঠিয়ে এখানে এনেছিলাম। অত্যধিক অহঙ্কারেই ঐ কাজ করতে গিয়ে এইভাবে ধরা পড়লাম। নাহলে এ জগতে কারও সাধ্য ছিল না। আমাকে ধরে। কিন্তু শর্মাকে যখন বললাম। সে ভয়ে শিউরে উঠল। মনে মনে আমি হাসলাম এবং আমাদের পরামর্শমত ঠিক রাত্রি সাড়ে নটায় আমাদের চোখের সামনে দিয়েই শর্মা প্রাইভেট রুমে গিয়ে ঢুকলো। এবং ঠিক যখন প্রায় সে অদৃশ্য হয়েছে, তখন আপনার দৃষ্টি ওদিকে আকর্ষণ করলাম। এদিকে শর্মা ঘরে ঢুকে সঙ্গে সঙ্গে হলঘরের দরজা দিয়ে বের হয়ে যাবার সময়ে খুব ক্ষিপ্রতার সঙ্গে চাকরীদের ডাকার ঘণ্টার দড়িটা টেনে, চকিতে খাবার ঘরের দরজার সামনে দিয়ে ঘুরে একেবারে আপনার হরিচরণের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলে। বেয়ারাকে আগে থেকেই শর্মা ওঘরে যাবার জন্য বলে রেখেছিলর
কিন্তু মিঃ মিত্রের পকেট থেকে চাবিটা চুরি করেছিল কে?
আমি। আমিই খুন করে আসবার সময় নিয়ে আসি। শর্মা আমাকে এগুলো নিয়ে আসতে বলেছিল।
তারপর কী হয়েছিল সে চাবি নিয়ে জানেন?
হ্যাঁ, জানি। শর্মা ঐ রাত্রেই মিঃ মিত্রের ওখানে গিয়ে তার সমস্ত কাগজপত্র সরিয়ে ফেলে; আর তার ধারণা ছিল অস্ত্রঘরে আসল মিঃ মিত্রের মৃতদেহ লুকানো আছে, তাই সে অস্ত্ৰঘরের চাবি চুরি করে রেখেছিল।