দু নম্বর কারণ সেই ছুরিটা, যেটা আমরা অরুণ করের বাগানে দেখি। সেটা বর্মী অস্ত্ৰ। সেখানকার লোকেরা ঐ ধরনের অস্ত্ৰ খুনখারাপি করতে ব্যবহার করে। কিন্তু কথা হচ্ছে, একে অপরাধী বলে মনে হল কেন? মনে আছে তোমাদের, মৃত স্যার দিগেন্দ্রর আঙুলের নখে একটা জিনিস পাওয়া গিয়েছিল, সে হচ্ছে কালো রংয়ের সার্জের প্যান্টের সুতো। সেই সুতো এর প্যান্টের কাপড়ের সুতোর সঙ্গে অবিকল মিলে গেছে। গতকাল উনি যখন প্রফেসর শর্মাকে খুন করে রক্তাক্ত জামা-কাপড়ে। এখানে ফিরে আসেন, সেই কেট-প্যান্ট উনি সরিয়ে ফেলবার অবকাশ পাননি। হরিচরণ ওঁর শয়ন ঘরের সোফার নীচে পেয়ে নিয়ে গেছে। ওঁর অবর্তমানে ম্যানেজারকে ঘুষ দিয়ে আজ দ্বিপ্রহরে এখানে এসে। সেই প্যান্টের সুতোর সঙ্গে মৃত স্যার দিগেন্দ্রর নখের মধ্যে আটকে ছিল যে সুতো দুটো অবিকল মিলে গেছে।
ট্যাক্সি-ড্রাইভারকে ধরে জানা গেছে সে এই বাড়িতে একজনকে পৌঁছে দিয়ে গিয়েছিল কাল রাত্রে। তা ছাড়া সেই বাগানের ছুরিটার হাতলে যে আঙুলের ছাপ ছিল এবং এর আঙুলের ও কালো ভ্রমরের আঙুলের যে ছাপ আমার কাছে আছে, তার সঙ্গে হুবহু মিলে গেছে। তাছাড়া তোমার মনে পড়ে সুব্রত, প্রফেসর শর্মাকে যে ভাবে হত্যা করা হয়েছে, সে সাধারণ লোকের পক্ষে সম্ভব নয়, ডাক্তার বলেই ওভাবে হত্যা করা এর পক্ষে সম্ভব হয়েছিল! স্যার দিগেন্দ্ৰ যে মুহুর্তে চিনতে পেরেছিলেন তাঁর ভাইপো আসলে কে, তখনই তিনি প্রাণভয়ে ব্যাকুল হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু ইনিও তখন বুঝতে পেরেছেন, জীবনে যে জঘন্য কাজ কোন দিনও করেননি। আজ তাই তাকে করতে হবে। স্যার দিগেন্দ্ৰ যদি একবার হাতের বাইরে চলে যান। তবে তাঁর পক্ষে এই ছদ্ম পরিচয়ে বাঁচা আর সম্ভব হবে না। তাই চির-জীবনের মত স্যার দিগেন্দ্রকে পথ থেকে সরিয়ে দেবার মনস্থ করেছিলেন। এইবার ডাক্তার সান্যাল দয়া করে বলুন, মিঃ মিত্ৰকে কিভাবে খুন করেছিলেন সে রাত্রে? কেননা ও ব্যাপারটা এখনও আমার কাছে রহস্যাবৃতই রয়ে গেছে। এখনও বুঝে উঠতে পারছি না।
ডাঃ সান্যাল মৃদু হাসলেন, চমৎকার বুদ্ধি আপনার মিঃ রায়! সম্পূর্ণ হার মানলাম আপনার বুদ্ধির কাছে। সত্যিই আমি কালো ভ্রমর, ডাঃ এস. সান্যাল। কুমারসাহেব আমি নই, কোনদিন ছিলামও না। আপনি অনেক কিছু জানেন বা জানতে পেরেছেন, কিন্তু একটা কথা এখনও জানেন না। সেটা হচ্ছে এই, দিগেন্দ্রর অতীত ইতিহাস। এই দিগেন্দ্র। এতকাল এই কলকাতায় থেকে আমারই দলে কাজ করত। সে ছিল আমার কলকাতার দলের প্রতিভূ। সেবার আপনাদের যখন আমি বর্ময় নিয়ে যাই, দিগেন্দ্র তখন সেখানে। সে-ই বনমালী বসু (‘কালো ভ্ৰমর’ দ্বিতীয় ভাগ দ্রষ্টব্য।—লেখক) নাম নিয়ে সনৎবাবুকে তঁদের আমহাস্ট স্ট্রীটের বাসা থেকে চুরি করে আনে। মৃত্যুগুহায়’ সে রাত্রে আমি একজাতীয় বুনো গাছের তৈরী ঔষধ শরীরে ফুটিয়ে পাঁচ ঘণ্টার জন্য অজ্ঞান থেকে আপনার হাত থেকে বাঁচবার চেষ্টা পাই এবং আপনারা আমাকে ইরাবতাঁর জলে ভাসিয়ে দিয়ে আসেন। আমার অন্যতম বিশ্বস্ত অনুচর রামু ইরাবতাঁর মধ্যেই খানিকটা দূরে নৌকো নিয়ে অপেক্ষা করছিল, আমায় তুলে বাঁচায় সে। আমার পরিধানে তখন ছিল রবারের পােশাক। তাই জলে ভেসেছিলাম, ড়ুবিনি। আর ঐ ঔষধটার এমন গুণ ছিল যে, জল মুখে ঢুকলে তার কাজ নষ্ট হয়ে যায়। আমি সব রকম কিছু ভেবে আগে থেকেই সে রাত্রে প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিলাম, সবই pre-arranged.
কয়েক দিন পরে একটু সুস্থ হয়ে ধনাগারে খোঁজ নিতে গিয়ে দেখি ধনাগার শূন্য, একটা কপর্দকও নেই। বর্ময় ফিরে এসে দেখি দিগেন্দ্ৰ উধাও। ব্যাপার সব বুঝলাম। প্রতিশোধের হিংসায় জ্বলে।পুড়ে মরতে লাগলুম। তারপর সেখান থেকেই দিগেন্দ্রকে একটা চিঠি দিই, ওই চিঠিটা এইজন্য দিয়েছিলাম, যাতে দিগেন্দ্ৰ জানতে পারে। আমি বেঁচে উঠেছি এবং ভয়ে ধনরত্নগুলো ফিরিয়ে দেয়। কিন্তু he was clever, তাই চুপচাপ রয়ে গেল, আমার চিঠির কোন জবাবই দেওয়া প্রয়োজন বোধ করলে না।
হ্যাঁ হ্যাঁ, মনে পড়েছে বটে, আমরা পরের দিন ধনাগারে ধনরত্ন আনতে গিয়ে দেখি ধনাগার শূন্য, কিছুই নেই। কিরীটী বললে।
তখন ডাক্তার আবার বলতে লাগলেন, কিন্তু মুখ সে, তাই আমার কথায় কান দিল না। ওর সব ইতিহাস আমি জানতাম, সুতরাং ওর মৃত ভাইপের পরিচয়ে এখানে এসে ঢুকলাম। বুঝলাম ও আমায় সন্দেহ করেছে, এবং পরে টের পেলাম ও আমাকে মারবার জন্যে প্রস্তুত হয়ে সুযোগ খুঁজছে। কিন্তু মারতে এসে একদিন সে ধরা পড়ে গেল, ও নিজেকে সাফাই করবার জন্য পাগলের ভান করলে। কিন্তু আমার চোখকে ফাঁকি দিতে পারল না।
ধরা পড়ল এবং ওকে গারদে পাঠালাম। কিন্তু আবার গারদ ভেঙে ও পালাল। খুন করা আমি চিরদিন ঘৃণা করি। কিন্তু নরাধম। আমাকে বাধ্য করলে ওকে খুন করতে। কিন্তু প্রফেসর শর্মা একদিন আমাকে এসে বললে মিঃ মিত্রের আসল পরিচয় কী। কিন্তু নির্বোধ জানত না। এ সংবাদ তার ঢের আগেই আমার জানা হয়ে গেছে। আমিও দেখলাম, ও যখন জেনেছে তখন ওকে বাদ দিয়ে কাজ করা তো চলবে না! এইখানেই আমার সব চাইতে বড় ভুল হল। মুর্থ আমাকে পেয়ে বসল। আমিও নিরুপায় হয়ে কিল খেয়ে কিল হজম করতে লাগলাম। প্রায়ই ও আমার কাছ থেকে টাকা নিত। কেননা আমি যে আসল কুমার নই সে ও টের পেয়েছিল। আসল কাজ হবে না ভেবে ওকে টাকা দিয়ে আমি নিরস্ত রেখেছিলাম। ভবিষ্যতে একদিন ওর পাওনা মেটাব বলে। প্রফেসার যখনই জানতে পারে আসল মিঃ মিত্র আমার সেক্রেটারী নয় এবং আসলে যে স্যার দিগেন্দ্র, তখন থেকেই সে উল্লাসে নাচতে লাগল। আমার জন্মোৎসবের রাত্ৰে সকলেই এখানে আমরা উপস্থিত, ছদ্মবেশী স্যার দিগেন্দ্র, আমি, প্রফেসর শর্মা।