মিঃ চৌধুরী কিরীটীর কথায় কেঁপে উঠলেন। কিরীটী বলতে লাগল, কিন্তু এর মধ্যে তার চাইতেও চতুর আর এক চতুর চূড়ামণি এসে দেখা দিলেন। তিনি হচ্ছেন আমাদের হতভাগ্য প্রফেসর শর্মা!
সেইজন্য প্রায়ই প্রফেসার শর্মা এখানে আসতে লাগলেন মৃতদেহের খোজে। কেননা তখনও তিনি বুঝতে পারেননি যে স্যার দিগেন্দ্ৰ মৃতদেহ কোথায় কী ভাবে লুকিয়ে রাখতে পারেন। একটু ভাবলেই বোঝা যায় এবং তাই ভেবেই হয়তো মিঃ শৰ্মা অনুমান করেছিলেন নিশ্চয়ই, এ বাড়িরই কোথায়ও তাঁর মৃতদেহ লুকিয়ে রাখা হয়েছে, কেননা সেটাই হবে সবচাইতে বুদ্ধিমানের কাজ। কিন্তু কোথায়? বাগানে? না, তাতে লোক-জানাজানি হবে। সবচাইতে ভাল হবে অস্তুগারে। কেননা সেটা সব চাইতে নির্জন।
মিঃ মিত্র যে আসল নয় জাল এবং খুঁজতে খুঁজতে অস্ত্ৰঘরেই যে সে লুকানো আছে প্রফেসর শর্মা এই ঠিক করলেন এবং দেখলেন এ মজাই হল—তিনি কোন কিছু না ভেঙে সুযোগের অপেক্ষায় রইলেন, কেননা তাঁরও অবস্থা তখন চাকরিবাকরি না থাকার দরুন ‘অদ্যভক্ষো ধনুৰ্গণঃ’। তাছাড়া অরুণ করের টাকায় তাঁর মত একজন অতি বিলাসী লোকের চলাও সম্ভবপর ছিল না।
১৪. কিরীটী একটু থামল
কিরীটী অল্পক্ষণের জন্য এবারে একটু থামল। তারপর সহসা চেয়ার ছেড়ে উঠে হাসতে হাসতে বললে, এবার চলুন বন্ধুরা, কুমারসাহেবের মার্বেল প্যালেসের দিকে যাওয়া যাক। অকুস্থানে বসেই আমার রহস্যের ওপর যবনিকা টানব।
তখুনি আমরা গাড়িতে চেপে রওনা হলাম। এবং রাত্রি প্রায় সোয়া বারোটায় আমরা সকলে বেহালায় কুমারসাহেবের মার্বেল প্যালেসের সামনে এসে নোমলাম। একটা সুমধুর হাওইন গিটারে সুরের আলাপ কানে ভেসে এল। চকিত অতীতের অন্ধকারে যেন আলোর রশ্মি এসে পড়ল। এই সুর কোথায় শুনেছি! এ যে বহুকালের চেনা! আশ্চর্য এত রাত্রেও নীচের হলঘরে আলো জ্বলছে দেখতে পেলাম।
ঘরে ঢুকে আরও আশ্চর্য হয়ে গেলাম।
কুমারসাহেব!
অথচ শুনেছিলাম আজই বিকেলে যে, তিনি আজ দুপুরে মধুপুর চলে গেছেন।
একটা সোফার ওপর গা এলিয়ে দিয়ে কুমারসাহেব হাওইন গিটার বাজাচ্ছেন।
কিরীটী ঘরে ঢুকেই উল্লাস ভরা কণ্ঠে বললে, শুভরাত্রি ডাঃ স্যান্যাল।
আমাদের এতগুলো লোককে এত রাত্রে ঘরে ঢুকতে দেখে বাজনোটা হাতেই কুমারসাহেব সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন, তারপর সহসা কিরীটীর হাতের দিকে নজর পড়তেই চমকে উঠলেন যেন।
হাত তুলুন! কিরীটীর গলা শুনে তার হাতের দিকে চেয়ে দেখি কিরীটীর হাতে চকচক করছে একটা রিভলবার।
সুব্রত, এগিয়ে গিয়ে ডাক্তারের পকেট থেকে রিভলবারটা বের করে নাও। আর এই নাও, এই সিন্ধা-কর্ডটা দিয়ে ওঁর হাত দুটো শক্ত করে বেঁধে ফেলো।
আমি এগিয়ে গিয়ে কুমারসাহেবের পকেট থেকে রিভলবারটা বের করে হাত দুটো কিরীটীর দেওয়া সিল্ক-কর্ড দিয়ে বেঁধে হোেললাম।
এসবের মানে কি কিরীটীবাবু? ক্ষুঃস্বরে কুমারসাহেব বললেন।
বসুন আপনারা সবাই। শুনুন ডাক্তার সান্যাল ওরফে কালো ভ্রমর, ওরফে ছদ্মবেশী কুমারসাহেব। স্যার দিগেন্দ্রনারায়ণ ও প্রফেসর শর্মার হত্যাপরাধে আপনাকে আমি গ্রেপ্তার করলাম। কিন্তু ডাক্তার, এতখানি জঘন্যতা আপনার কাছে আমি আশা করিনি কোন দিনও। বরাবর একটা শ্রদ্ধা আপনার ওপরে আমার ছিল। আপনারা হয়তো ভাবছেন ওঁকে আমি চিনলাম কী করে, না? মাত্র দুটি কারণে, এক নম্বর ওঁর হাতের লেখা দেখে, যার নমুনা এখনও আমার কাছে আছে। মনে পড়ে তোমাদের, মৃত স্যার দিগেন্দ্রর পকেটে হলুদে রংয়ের তুলট কাগজ গোটা দুই পাওয়া গিয়েছিল? এই দেখ সেই কাগজ। আর এই দেখ এতে ভ্রমর আঁকা। এই চিঠি পেয়েই গতরাত্রে মিঃ মিত্ররূপী স্যার দিগেন্দ্র ওঁকে চিনতে পারেন যে উনি কালো ভ্রমর।
উনি যে কুমার দীপেন্দ্র নন, স্যার দিগেন্দ্র প্রথম দর্শনেই তা টের পেয়েছিলেন, পাঁচ বছর আগে প্রথম যেদিন উনি ভাইপোর পরিচয়ে তার কাছে আসেন। কিন্তু তখন তিনি কোন কথা প্রকাশ করেননি। ইচ্ছা ছিল গোপনে একদিন তিনি একে শেষ করবেন, কিন্তু তার সে চেষ্টা নিস্ফল হয় এবং পাগলা গারদে তাকে যেতে হয়। এরই প্রচেষ্টায়। সেই থেকে তিনি উপায় খুঁজছিলেন কেমন করে সে অপমানের প্রতিশোধ নেবেন! তাঁর ইচ্ছা ছিল একে সরিয়ে টাকা হাতিয়ে সরে পড়বেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য র্তার, যে পরিচয়ে তিনি এখানে এসেছিলেন আমাদের তীক্ষ্ণবুদ্ধি অসাধারণ চতুর ও কৌশলী কালো ভ্রমরের চোখে তা ধরা পড়ে গেল। কিন্তু প্রফেসর শর্মাও এর আসল পরিচয় পাননি। তার ফলেই তিনি একে উৎসাহিত করেছিলেন মিঃ মিত্ররূপী স্যার দিগেন্দ্ৰকে হত্যা করবার জন্যে। তিনি স্যার দিগেন্দ্রর আসল পরিচয় এঁর কাছে বলেছিলেন; এবং এও তার ধারণা ছিল ইনি অর্থাৎ কুমারসাহেব নিজেও আসল কুমারসাহেব নন; এবং সে কথা এক দিগেন্দ্র ও প্রফেসর শর্মা ছাড়া আর কেউ জানতে পারেনি। কিন্তু কেউই জানতেন না যে ইনি ছদ্মবেশী স্বয়ং কালো ভ্ৰমর। তাহলে হয়তো কেউ এতটা উৎসাহিত বোধ করতেন না। ভেবেছিলেন ইনি সামান্য একজন প্রতারক মাত্র। প্রফেসারের ইচ্ছা ছিল একে দিয়ে স্যার দিগেন্দ্রকে খুন করিয়ে একে হাতে রেখে যখন-তখন blackmail করে প্রচুর, অর্থলাভ করবেন, অথচ নিজে এর মধ্যে জড়াবেন না।
প্রথম থেকেই আমি জানতাম খুনী স্বয়ং কালো ভ্রমর। এবং তিনি ছদ্মবেশী কুমারসাহেব! কিন্তু সেই চিঠি থেকে প্রমাণ হল কী করে ইনি স্বয়ং কালো ভ্রমর! এর হাতের লেখা এদের স্টেটের ফাইলে পেয়েছি, তা ছাড়া গতকাল উনি যে কমিশনার সাহেবকে দশ হাজার টাকা পুরুস্কার ঘোষণা করে ফর্ম সই করে এসেছেন, সেই লেখার সঙ্গে কালো ভ্রমরের চিঠির হুবহু মিল হয়ে গেছে। উনি বর্ময় থাকতেই hashish সিগারেট খেতেন তা আমি জানতাম।