ভাবতে লাগলাম। এদিকে মিঃ মিত্র খুব ভাল হিন্দী জানতেন। অথচ স্যার দিগেন্দ্র হিন্দী জানতেন না। তিনি কয়েক মাস হয়তো পাটনায় থেকে কোন একজন মাস্টার রেখে হিন্দীটা আয়ত্ত করে নিয়েছিলেন মাত্র, কিন্তু তাতে করে কাজ চললেও ছদ্মবেশের কাজ চালানো যায় না।
তবে কি হিন্দীভাষায় অনূদিত সাত সমুদ্র তেরো নদীর পারে বইখানা তাঁরই? আমি এবারে উৎকণ্ঠিত ভাবে প্রশ্ন করলাম।
হ্যাঁ। কিরীটী আবার বলতে লাগল, এসব ছাড়াও তিনি নতুন করে আফিং খেতে শুরু করেছিলেন, কেননা মিঃ মিত্রের নাকি আফিংয়ের নেশা ছিল। তাছাড়া এই ঘটনা ঘটবার আগের দিন নকল মিঃ মিত্র ও কুমারসাহেব স্যার দিগেন্দ্রর বেনামীতে দুজনে দুখানা চিঠি পান। সে হাতের লেখাও মিলিয়ে দেখছি, সেই লেখা স্যার দিগেন্দ্রর হাতের লেখার সঙ্গে হুবহু মিলে যায়। পুলিশের ফাইলে স্যার দিগেন্দ্রর হাতের লেখার নমুনা ছিল। সেই চিঠিগুলো একপ্রকার সবুজ কাগজে পেনসিল দিয়ে লেখা। পেনসিল পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে। পেনসিল সাধারণত চার শ্রেণীর হয়। কারবন’, ‘সিলিকেট’ ও ‘লোহা’ দিয়ে মিশিয়ে যে পেনসিলের সীসা তৈরী হয় তার লেখা সাধারণত ধূসর কালো রংয়ের হয়। গ্রাফাইট’, সিলিকেট’ ও ‘লোহা দিয়ে যে পেনসিলের সীসা তৈরী হয় তার লেখা সাধারণত বেশ ঘন কালো রংয়ের হয়। রংয়ের পেনসিলগুলো সাধারণত ওর সঙ্গে রং মিশিয়ে তৈরী হয়। আর কপিং পেনসিল তৈরী হয়। অ্যানিলিন রং’, ‘গ্রাফ্রাইটু ও কেওলিন দিয়ে। পেনসিল দিয়ে লেখা সেই চিঠিটার গায়ে ‘অ্যাসিটিক এসিডের’ ও ফেরোসায়োনাইডের একটা সলুশন ঢেলে দেওয়া হয়–তার ফলে লেখাগুলো একটা রাসায়নিক ক্রিয়ায় রঙীন হয়ে যায়। মাইক্রোসকোপ দিয়ে পরীক্ষা করে বুঝতে পারা গেছে, ঐভাবে লেখা সাধারণত রঙীন হওয়া উচিত নয়। ঐ সলুশন দিয়ে এবং ঐ রং দেখেই আমরা ধরতে পেরেছি। কোন শ্রেণীর পেনসিল দিয়ে চিঠিটা লেখা হয়েছিল। বোঝা যায় লেখাটা কপিং পেনসিল দিয়েই লেখা হয়েছিল এবং সাধারণত এইচ. এইচ. কপিং পেনসিল দিয়ে লিখলে ঐ ধরনের লেখা হয়। সুব্রত, বোধ হয় মনে আছে, ঐ ধরনের একটা পেনসিল এ বাড়িতেই আমি পেয়েছি ডেস্কে, গতকাল বলেছিলাম। এখন বুঝতে পারছি, সেই পেনসিলটা দিয়েই ওই দুখানা চিঠি লেখা হয়েছিল।
এই পর্যন্ত বলে কিরীটী মাধবের আনীত অ্যাটাচি কেস থেকে সাত সমুদ্র তোরো নদীর পারে বইখানা বের করল। এই বইখানা নিয়ে মিঃ মিত্র প্রায়ই অরুণ করের সঙ্গে আলোচনা করতেন এবং এই বইখানা কুমারসাহেবের খাবার ঘরে চেয়ারের ওপর পাওয়া যায়। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে প্রথম পাতায় একটা নাম লেখা ছিল, তারপর রবার দিয়ে ঘষে সেটা তুলে ফেলা হয়েছে। আমরা এটারিও ফটোগ্রাফ নিয়ে পরীক্ষা করেছি। ফটো নেওয়া হয়েছিল ‘অরথোক্রোম্যাটিক প্লেটে’; একটা নেগেটিভ তোলা হয় এবং তাকে ছোট করে ‘পারক্লোরাইড অফ মারকারি’ দিয়ে জোরালো করা হয়। তারপর সেটা শুকোলে ফ্রেমে বসিয়ে তার সঙ্গে লাগিয়ে আর একটা প্লেটে ফটো নেওয়া হয়। এইভাবে প্রায় ছ-সাত বার ফটো নেওয়া। ফটোয় কি নাম পাওয়া গেছে দেখুন!
আমরা সকলে নেগেটিভের দিকে বিস্ময়ে হ্যাঁ হয়ে গেলাম! পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে তাতে লেখা—দিগেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী। এরপরও অবিশ্বাস করা চলে না যে, স্যার দিগেন্দ্রনারায়ণই স্বয়ং আমাদের ছদ্মবেশী মৃত মিঃ শুভঙ্কর মিত্র! তবে এখন প্রশ্ন ওঠে, আসল শুভঙ্কর মিত্র কোথায়? স্যার দিগেন্দ্র তাকে খুন করেন। কিন্তু কোথায় তবে মিঃ মিত্র খুন হলেন? বিকাশবাবু গত ডিসেম্বর মাসে পাটনা থেকে মিঃ শুভঙ্কর মিত্রকে পাঞ্জাব এক্সপ্রেসে ফিরে আসতে দেখেছিলেন। এবং পাটনা থেকে ফিরে এসেই কিছুদিন পরে মিঃ মিত্ররূপী স্যার দিগেন্দ্ৰ কুমারসাহেবের কাছে চাকরি নেন। তাহলে বোধ হয় ট্রেনের মধ্যেই স্যার দিগেন্দ্র কােজ সারেন এবং আসল মিঃ মিত্রের মৃতদেহটা খেলাধুলার সাজ-সরঞ্জাম রাখবার বড় বোক্সর মধ্যে ভরে সঙ্গে নিয়ে আসেন।
বিখ্যাত শিকারী ও স্পোর্টসম্যান হিসাবে মিঃ মিত্র সর্বত্রই সুপিরিচিত। অতএব বিনা হাঙ্গামায় বাক্সবন্ধ হতভাগ্য মিত্রের মৃতদেহটা নিয়ে আসতে তাঁকে এতটুকুও বেগ পেতে হয়নি। মৃতদেহ রাস্তায় ফেলতে পারেননি পাছে তাঁর প্ল্যান ভেস্তে যায়। মৃতদেহ সঙ্গে করেই এনেছেন। কিন্তু কোথায় রাখবেন—এই হল তাঁর সমস্যা। এইখানেই তিনি সব চাইতে বুদ্ধির খেলা দেখালেন, মিঃ মিত্রের মৃতদেহ মিঃ মিত্রের বাড়ীতে লুকিয়ে রাখলেন। এখানে এসেই আগে তিনি পুরাতন চাকরীদের বিদায় করে মাধবকে রাখলেন, পাছে তাকে কেউ সন্দেহ করে। তারপর এখানে এসে যখন তিনি মিঃ মিত্রের বন্ধুদের সঙ্গে মিশতে গেলেন তখন তিনি দেখলেন—সেদিনকার ঘটনা আমরা মিঃ চৌধুরীর মুখেই শুনেছি, কেননা মিঃ চৌধুরী সেদিন উপস্থিত ছিলেন, এবং সে রাত্রে প্রফেসর শর্মার কথা শুনতে শুনতে হঠাৎ মিঃ মিত্র কেমন অসুস্থ হয়ে পড়ে যান তাও আমরা জানি। মিঃ মিত্ররূপী স্যার দিগেন্দ্র নিমেষে। বুঝতে পারলেন সে রাত্রে অসাধারণ চতুর আসল মিঃ মিত্রের শিশুকালের বন্ধু প্রফেসার শৰ্মার চোখে তিনি ধূলো দিতে পারেননি। তিনি তাকে চিনে ফেলেছেন। এখানে এসে অরুণ করের সঙ্গে আলাপ হয়ে স্যার দিগেন্দ্র ঠিক করেন অরুণের মাথায় হাত বুলিয়ে বেচারীর টাকা কটা বাগাতে হবে, কেননা মিঃ মিত্রের অনুসন্ধান নিয়ে দেখলেন মিঃ মিত্রের আর্থিক অবস্থা অত্যন্ত খারাপ ছিল। খুনের রাত্রে বোধ করি টাকার কথা বলবার জন্যই তাঁকে লুকিয়ে ওপরের ঘরে এসে দেখা করতে বলেন এবং টাকা ধারের কথা মিঃ চৌধুরীকেও বলেন। তাঁর ইচ্ছা ছিল আর একটা কোন জায়গা থেকে প্রচুর অর্থ নিয়ে এবং অরুণ কর ও হতভাগ্য মৃত মিঃ মিত্রের ঘরবাড়ি বন্ধক রেখে প্রভূত অর্থ নিয়ে এদেশ ছেড়ে চিরতরে চম্পট দেবেন।