কিরীটী মৃতদেহটার আপাদমস্তক বেশ ভাল করে দেখে নিয়ে মৃদু হেসে বললে, না ঠিক আছে। দেহটা lock up করে রাখুন। এই নিন পুলিস কমিশনারের অর্ডার। একটা বেলে রঙের ছাপানো কাগজ সার্জেনের হাতে কিরীটী এগিয়ে দিল।
***
ময়নাঘর থেকে বের হয়ে আমরা সকলে সোজা বরানগরে মিঃ মিত্রের বাড়িতে এসে হাজির হলাম।
কড়া নাড়তেই মাধব এসে দরজা খুলে দিল।
ভিতরে চল মাধব। একটা শাবল যোগাড় করে আনতে পার মাধব এখুনি? কিরীটী বললে।
হ্যাঁ, কেন পারব না বাবু! চলুন।
শাবল! শাবল দিয়ে কী হবে মশাই? বিস্মিত চৌধুরী প্রশ্ন করলেন।
দরকার আছে, চলুন না। এস সুব্রত। হ্যাঁ, আর একটা লণ্ঠন জ্বলিয়ে নিয়ে এস মাধব।
১৩. আমিও ভেবে পেলাম না
আমিও ভেবে পেলাম না কিরীটী হঠাৎ শাবল আনতে বললে কেন আর শাবল দিয়ে কী এমন কাজ হবে! যাহোক, একটু পরেই মাধব একটা শাবল ও একটা লণ্ঠন নিয়ে সেই ঘরের মধ্যে ফিরে এল। শাবলটা হাতে নিয়ে একটা টর্চ হাতে আমরা কিরীটীর পিছু পিছু রান্নাঘরের দিকে চললাম।
তারপর সিঁড়ি দিয়ে নেমে শুভঙ্কর মিত্রের অস্ত্ৰঘরের দিকে চললাম। ব্যাপার কি? কিরীটী কোথায় চলেছে? সে বলেছিল। আজ সন্ধ্যার আগেই খুনীকে ধরিয়ে দেবে, কিন্তু এখানে কোথায় চলেছে? তবে কি খুনী ঐ বদ্ধ ঘরের মধ্যেই লুকিয়ে আছে নাকি কোথায়ও? ঘরের সামনে এসে কিরীটী সদ্য চুনকাম করা দেওয়ালটার দিকে এগিয়ে গেল।—আলো উঁচু করে ধর সুব্রত, এই দেওয়ালটা খুঁড়তে হবে।–
দেওয়ালটা সাত্যসত্যই সে শাবল দিয়ে খুঁড়তে লাগল। অল্পক্ষণ পরেই কতকগুলো ইট ঝুরঝুর করে পড়ে গেল। পাগলের মত শাবল দিয়ে কিরীটী চারপাশের ইট খুলতে লাগল। দেওয়ালের খানিকটা ভেঙে একটা গর্ত মত দেখা গেল।
সেই গর্তের মধ্যে পা দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে, কিরীটী শাবল দিয়ে কিসের ওপর আঘাত করল। ঠিক করে একটা শব্দ হল। শাবলের সাহায্যেই চাড় দিয়ে কি যেন ভেঙে ফেলল। তারপর পকেট থেকে টৰ্চটা বের করে সেই গর্তের মুখে ফেলে আমাদের ডাকল, আসুন মিঃ চৌধুরী, চেয়ে দেখুন। ঐ কাঠের বাক্সর মধ্যে। চেয়ে দেখুন তো, আপনার মক্কেল সত্যিকারের শুভঙ্কর মিত্রকে চিনতে পারেন কি না? ঐ—ঐ হচ্ছে সত্যিকারের শুভঙ্কর মিত্র। আর একটু আগে ময়নাঘরে যাকে দেখে এলাম, সে কে জানেন? কিরীটী আমাদের মুখের দিকে চেয়ে বলতে লাগল, কুমার দীপেন্দ্রনারায়ণের কাকা-রাঁচি পাগলা গারদের পলাতক। স্যার দিগেন্দ্ৰ নারায়ণ।
মিঃ চৌধুরী একপ্রকার চিৎকার করে উঠলেন, অসম্ভব! আপনি কি পাগল হলেন, মিঃ রায়?
না, পাগল আমি হইনি।
একটা ভীষণ দুর্গন্ধে সেখানকার সমস্ত বাতাস বিষাক্ত হয়ে উঠেছে। একটা পচা গলা মৃতদেহ বাক্সের মধ্যে বীভৎস আকারে পড়ে আছে। কিন্তু বিকৃত হলেও বুঝতে কষ্ট হয় না যে, একটু আগে যে দেহটা ময়নাঘরে দেখে এলাম তার সঙ্গে এই মৃতদেহের খুব সামান্যই পার্থক্য আছে। হুবহু একেবারে মিল, যেন দুটি যমজ ভাই!
এই কি তবে বিশ্বাস করতে বলেন মিঃ রায় যে, মিঃ চৌধুরী বলতে লাগলেন, স্যার দিগেন্দ্র আসল শুভঙ্করকে হত্যা করে এইখানে তার মৃতদেহ লুকিয়ে রেখে এতদিন ধরে
আমারও যেন সব কেমন গোলমাল হয়ে যাচ্ছিল। আমি বললাম, তাহলে অন্য কেউ স্যার দিগেন্দ্রকে খুন করেছে এবং তারপর প্রফেসর শর্মাকে সে-ই খুন করেছে?
কিরীটী মৃদু হেসে বললে, চলুন, সব কথা এবারে খুলে বলব।-ওপরে চলুন।
আমরা সকলে ওপরে এসে শুভঙ্কর মিত্রের শয়নঘরে বসলাম। মাধব একটা টেবিলল্যাম্প জেলে দিয়ে গেল।
কিরীটী মাধবকে বললে, গাড়িতে আমার একটি অ্যাটাচি-কেস আছে, ড্রাইভারের কাছ থেকে সেটা নিয়ে এস তো মাধব।
মাধব কিরীটির নির্দেশ পালন করতে চলে গেল।
এবারে কিরীটী বলতে লাগল, আপনারা সকলে খুব আশ্চর্য হয়েছেন না? প্রথম থেকেই হত্যার ব্যাপারে আপনারা ভুল পথে ছুটে চলেছিলেন, কিন্তু একটু ভেবে দেখলেই ব্যাপারটা বুঝতে পারতেন।
স্যার দিগেন্দ্ৰ কোন একটা কারণে শুভঙ্কর মিত্রের ছদ্মবেশ নিয়েছিলেন। পাটনায় যখন আসল স্পোর্টসমান মিঃ শুভঙ্কর মিত্র ছিলেন, সেই সময় তাঁর সঙ্গে দিগেন্দ্রর কোন সূত্রে হয়তো আলাপ হয়। স্যার দিগেন্দ্ৰ অত্যন্ত চতুর এবং বুদ্ধিমান ব্যক্তি ছিলেন। তিনি অবিকল তার মত দেখতে এমন একটি লোককে খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন। এমন সময় মিঃ মিত্রের সঙ্গে তার বোধ হয় আলাপ-পরিচয় হয় এবং স্যার দিগেন্দ্ৰ লক্ষ্য করলেন মিঃ মিত্র অবিকল র্তারই মত দেখতে শুধু তাঁর নিজের নাকটা একটু ভোঁতা। আর মিঃ মিত্রের নাকটা চোখা। স্যার দিগেন্দ্রর ফ্রেঞ্চকটি কালো দাড়ি আছে, মিঃ মিত্রের তা নেই। নাকের খুঁতটা স্যার দিগেন্দ্ৰ ডাঃ রুদ্রের সাহায্যে অপারেশন করে ঠিক করে নিলেন এবং চেহারা বদলাবার আগে স্যার দিগেন্দ্রর পক্ষে মিঃ মিত্রের সঙ্গে কয়েক সপ্তাহ খুব ঘনিষ্ঠভাবে মিশে তাঁর স্বভাব্যচরিত্র, ভাবগুলো অনুকরণ করে নিতে এতটুকুও বেগ পেতে হয় নি। কিন্তু এত করেও একটা জিনিস স্যার দিগেন্দ্রর চোখে ধরা পড়েনি, সেটা হচ্ছে মিঃ মিত্রের ডান কনের কাছে ছোট সিকি-ইঞ্চি পরিমাণ লাল জড়ুল-চিহ্ন। এই ঘরে মিঃ মিত্রের ফটো দেখে সেইটা আমার নজরে পড়ে, আমি তখনি মিলিয়ে দেখবার জন্য ময়নাঘরে ছুটে যাই। কিন্তু মৃত ব্যক্তির ডান ক্যানের নীচে কোন জড়ুল-চিহ্ন পাই না। এতেই বুঝলাম যে কুমারসাহেবের বাড়িতে যে খুন হয়েছে সে মিঃ মিত্ৰ নিশ্চয়ই নয়, জন্মের দাগ কখনও মিলায় না। তখন ভাবতে লাগলাম মৃতব্যক্তি যদি মিঃ মিত্ৰ নাই হয়, তবে আসল মিঃ মিত্ৰই বা কোথায় এবং এই মৃত ব্যক্তিই বা কে? এদিকে এই বাড়ির অস্ত্রঘরের সামনে গিয়ে দেখলাম, একটা দেওয়ালে নতুন চুনকাম করা হয়েছে। সন্দেহ হল সমস্ত দেওয়াল বাদ দিয়ে এক জায়গায় মাত্র চুনকাম করা হয়েছে কেন? তবে কি ঐ চুনকাম করা দেওয়ালের আড়ালে কোন রহস্য লুকিয়ে আছে?